আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি ও সামাজিক অঙ্গীকার
৯ আগস্ট ২০২১ ১১:৫১
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান রচিত হয়েছিল মান্দি, কোচ, বর্মণ আদিবাসী এলাকায় মধুপুর শালবনের দোখলাতে। কিন্তু সংবিধানে ‘আদিবাসী’ পরিচয়ে আদিবাসী জনগণের স্বীকৃতি মেলেনি আজও। বাংলাদেশে আদিবাসী জনগণের সাংবিধানিক পরিচয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০-এর ২(১) এবং ধারা ১৯ এ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গা, বম, পাংখোয়া, চাক, খিয়াং, খুমি, লুসাই, কোচ, সাঁওতাল, ডালু, উসাই(উসুই), রাখাইন, মণিপুরী, গারো, হাজং, খাসিয়া, মং, ওরাও, বর্মণ, পাহাড়ী, মালপাহাড়ী, কোল এবং বর্মণ নামে মোট ২৭ জনগোষ্ঠীর নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। পরবর্তীতে কুর্মি মাহাতো, কন্দ, গঞ্জু, গড়াইত, মালো, তুরি, তেলী, পাত্র, বানাই, বাগদী, বেদিয়া, বড়াইক, ভূমিজ, মুসহর, মাহালী, রাজোয়ার, লোহার, শবর, হদি, হো এবং কড়া এ ২১ আদিবাসী জাতির নাম ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’ এ তফশিলভুক্ত হয়।
‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টি ঘিরে অধিকাংশ সময় রাষ্ট্র ও তথাকথিত মূলধারার মনোজত যেসব তর্ক উসকে দিয়েছে, তার প্রধান ধারা হলো ‘আদিবাসীরা’ কি বাংলাদেশের ভূমিজ সন্তান না বহিরাগত? মূলে সমস্যা রয়ে গেছে ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টির ভাষিক ব্যবহার ও বিন্যাসে। দেশের গরিষ্ঠভাগ বাঙালি জনগণের ভাষিক ময়দানে ‘আদিবাসী’ ও ‘আদিবাসিন্দা’ শব্দদ্বয় খুবই কাছাকাছি। এবং এক্ষেত্রে বাঙালি ভাষিক ময়দান থেকে এর অর্থ দাঁড়ায় আদিবাসিন্দা। যা অনেকক্ষেত্রেই কোনো বৃহৎ জনগোষ্ঠীর পূর্বজনের জ্ঞাতিসম্পর্ককে টেনে আনা, স্থানান্তর, অভিবাসন ও বসতি স্থাপনের ঐতিহাসকতা মূর্ত করতে চায়। কিন্তু অধিপতি বাঙালির এই বর্ণবাদী মনস্তত্বের তলকে সরিয়ে আদিবাসী পরিচয়ের ঐতিহাসিকতা নিয়েই আলাপে সামিল হওয়া জরুরি। কারণ এটি এই জনপদের নিন্মবর্গের দার্শনিকতার সূত্রকে সংযুক্ত করে ও এক পরস্পরনির্ভরশীলতার সম্পর্কের ইশারা জানান দিতে পারে।
পরিচয় সতত পরিবর্তনশীল এবং নির্মিত হতে থাকা এক রাজনৈতিক অভিধা। বাঙালির আত্মপরিচয় থাকলে সাঁওতাল, লালেং, কডা, ম্রো, খুমী, মারমা, মান্দি বা হাজংদেরও নিশ্চয়ই আছে। নিশ্চয়ই একজনের আত্মপরিচয়ের অভিধা বা মাপকাঠি আরেকজনের পরিচয় নির্মাণ করে দিতে পারে না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে আত্মপরিচয়ে জাতিগত বৈচিত্র্য আছে, একে শুধুমাত্র বন্দুক বা বাহাদুরি দিয়ে দাবিয়ে রাখা যায় না। বাংলাদেশের আদিবাসীদের নিয়ে অধিকাংশ এথনোগ্রাফিক রচনা ও দলিলের একটা বিশেষ সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো আদিবাসীদেরকে এই ভূগোলের বহিরাগত হিসেবে প্রমাণ করা এবং দেখানো হয় তাদের অভিবাসন ঘটেছে এই ভূখন্ডের বাইরে থেকে। জাতিসংঘ ২০০৩ সনে আদিবাসী দিবস সূচনা করে এবং ২০০৮ সনে আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র তৈরি করে। কিন্তু এর অনেক আগ থেকেই দেশের বৃহত্তর বরেন্দ্রভূমি ও মধুপুর শালবনের সাঁওতাল, পাহাড়িয়া, ওরাঁও, মুন্ডা, মান্দি কোচ ও হাজংদের ভেতর ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টি বহুলভাবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৯৬২ সনে যখন টাঙ্গাইল মধুপুরে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয় তখন এর প্রতিবাদে স্থানীয় আদিবাসীরা যে স্মারকলিপি দেন তা শুরু হয়েছিল ‘আমরা মধুপুরের আদিবাসী’ এই বাক্য দিয়ে। বাংলা সাময়িকপত্রে আদিবাসীকথা পুস্তকের ভাষ্যমতে, নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আদিবাসী-চর্চা শুরু হয় যতদূর সম্ভব ১৮৮৫ সাল থেকে। সে সময়ে আদিবাসী সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে যেসব লেখালেখি হয়েছে তার অধিকাংশই বিদেশি মানুষেরা করেছেন। পরবর্তীতে উনিশ-বিশ শতকে বিভিন্ন বাংলা সাময়িকপত্র যেমন, বঙ্গদর্শন, বঙ্গবাণী, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ভারতবর্ষ, প্রবাসী, বিশ্বভারতী পত্রিকা, মাসিক বসুমতী প্রভৃতি অসংখ্য পত্র-পত্রিকায় বিদেশি লেখকদের অনুসরণ করে আদিবাসী জীবনের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে, বইপত্রও প্রকাশিত হয়েছে। সহজ, সরল নিরক্ষর আদিবাসীরা ওই ধরনের ভুল তথ্য পরিবেশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়নি। জন ক্লার্কা মার্শম্যানের সম্পাদনায় ভারত থেকে প্রকাশিত দিগদর্শন পত্রিকার ১৩শ ভাগের দ্বিতীয় খন্ডে ১৮২০ সালে লেখকের নাম উল্লেখ ছাড়া ‘নানাদেশীয় লোকের শববিষয়ক ব্যবহার’ নামে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়। পরবর্তীতে রাজন্দ্রেলাল মিত্রের সম্পাদনায় ১৭৭৪ শকাব্দে বিবিধার্থ-সংগ্রহে ‘ডোকো জাতির বিবরণ’ ১৮৫২ সালে সত্যার্ণব পত্রিকায় ‘ভেদ নামক অরণ্যের বন্য মানুষ’ এরকমের আদিবাসী বিষয়ক রচনা সমূহ প্রকাশিত হতে থাকে। নগেন্দ্রনাথ বসুর সম্পাদনায় ১৩১৩ সনের সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার ৪র্থ সংখ্যায় সতীশচন্দ্র ঘোষ লেখেন ‘চাকমাদিগের ভাষা-তথ্য। চাকমা দিগের ভাষা-তথ্য লেখায় সতীশ চন্দ্র ঘোষ জানিয়েছেন, চাকমাদিগ লোহিত অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র (যার-কিও-সাংপো)। ইহাদিগের দুইটি মাত্র প্রাচীন নিদর্শন এই সমুদয়ের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রামাণ্য। ‘ধনপতি রাধামোহনের উপাখান’ এবং ‘চাটিগাঁ-ছড়া’ আখ্যায়িকার সাক্ষ্য স্বীকার করিলে প্রাগুক্ত মত অগ্রাহ্য করা যায় না।
নেত্রকোণায় যখন সুসং রাজার অন্যায় হাতিবাণিজ্যের বিরোধীতা করেছিল বিদ্রোহী হাজংরা, তখন তাদের নাম দেয়া হয়েছিল ‘রাজা-অবাধ্য’। হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং উলগুলান বা মুন্ডা বিদ্রোহের সময় অনেক আদিবাসীকে বলা হয়েছিল ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’।
রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব (সংশোধিত) আইন ২০০৪ (The State aquisition and Tenancy (Amendment) act 2004) এর ৯৭ ধারায় আদিবাসীদের ‘Aboriginal’ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী সাঁওতাল, বনিয়াস, ভুঁইয়া, ডালু, হাদী, ভূমিজ, গারো, হাজং, খাসিয়া, কোচ, মগ, খোড়া, ওঁরাও, দালুজ, মেচ, মুন্ডা, তোড়ি, খারওয়ার, মাল, সুরিয়া, পাহাইয়াস, মন্ডিয়া, গন্ডা, তুরিস এই চব্বিশটি জাতির কথা নথিভূক্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের এরকম নানান আইন ও দলিলে যেমন ‘আদিবাসী’ শব্দটি আছে আবার ‘উপজাতি’ শব্দটিও আছে। ১৯১৮ সনের বঙ্গীয় আইনেও ‘আদিবাসী’ শব্দটি পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন’১৯৯৮ অনুসারে প্রান্তিক জাতি অধ্যূষিত এ অঞ্চল উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। রাষ্ট্রের সকল পাঠ্যপুস্তকে ‘উপজাতি’ শব্দের সাথে কোথাও কোথাও আদিবাসীও যুক্ত করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নবম জাতীয় সংসদ নিবার্চনী ইশতেহারে ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ , ‘আদিবাসী’ ও ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী’ শব্দসমূহ ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে ‘আদিবাসী’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’ ও ‘সংখ্যালঘু জাতিসত্তা’ শব্দগুলো ব্যবহার করেছে।
‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টি বেশ আগে থেকেই ব্যবহৃত এবং এর মানে কোনোভাবেই ‘আদিবাসিন্দা’ বোঝায় না। এটি জাতিগত বৈচিত্র্য ও ভিন্নতার আত্মপরিচয়কে তুলে ধরে। পাহাড়ি অঞ্চলে শব্দটির বহুল আদি ব্যবহার না থাকলেও পাহাড় ভিন্ন সমতলে এই শব্দ ব্যবহারের বহু আদি নিদর্শন আছে। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর অঞ্চলে এখনো প্রচুর প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে যেসবের অনেকগুলোই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে এবং সেরকম অনেক বিদ্যালয়ের নামেই ‘আদিবাসী’ শব্দটি আছে। স্থানীয় বাঙালিরা পাশের একটা সাঁওতাল, মুন্ডা বা ওঁরাও গ্রাম বোঝাতে এখনো উত্তরাঞ্চলে ‘আদিবাসী পাড়া’ শব্দটি ব্যবহার করেন। আর এভাবেই আদিবাসী প্রত্যয়টি বহু প্রান্তিক জাতির এক আত্মপরিচয় হয়ে ওঠেছে। যুক্তি, প্রমাণ আর বিশ্লেষণ ছাড়া কোনোভাবেই এই প্রত্যয়কে অস্বীকার করার উপায় নাই। আদিবাসী আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ কোনো জনগোষ্ঠী কি নামে নিজের পরিচয় নির্মাণ ও রূপান্তর করতে চায় সেই অধিকার রাষ্ট্রই তাদের দিয়েছে। আর এই আত্মপরিচয়কে সম্মান ও স্বীকৃতি না জানানোর মানে হলো এই জাতিসমূহকে আরো বেশি প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দেয়া। পিছিয়ে রাখা।
প্রতি বছর ৯ আগষ্ট বৈশ্বিকভাবে পালিত হয় আদিবাসী দিবস। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম জাতিসংঘ ঘোষিত এ বছরের প্রতিপাদ্যের বাংলা করেছে, ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়, আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহবান’। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার মূল সুর এবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্যে। ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’। এখন যদি সকল আদিবাসী সমাজকে সমাজ রূপান্তরের সকল প্রান্তে এগিয়ে আনতে হয়, তাহলে আদিবাসী আত্মপরিচয়য়ের স্বীকৃতি দরকার। কারণ আত্মপরিচয়কে পেছনে ফেলে রেখে বা গুম করে আদিবাসী সমাজ কীভাবে এক কাতারে উন্নয়নের ময়দানে সবার সাথে দাঁড়াবে? আদিবাসী সমাজের সামনে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে সামাজিক অর্ন্তভূক্তিকরণ, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, ঝুঁকি হ্রাস, অর্থনীতি, উৎপাদন, শিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ, মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন সবকিছু যেমন জরুরি তেমনি আদিবাসী আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতিও আদিবাসী জনগণের সাথে উন্নয়নের এক মৌলিক সামাজিক অঙ্গীকার। আশা করি রাষ্ট্র এই অঙ্গীকার মজবুত ও সুরক্ষিত করবে।
লেখক: গবেষক
সারাবাংলা/ এসবিডিই