সময়টা কঠিন, নিয়ম মেনে সহজ করুন
২৫ আগস্ট ২০২১ ১৩:০৩
কিছুদিন আগে জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার, বর্তমান কোচ, আমার বন্ধু পারভেজ বাবুর ছোট ছেলেটা যখন ডেংগুতে মারা যায়, বড় ছেলেটা তখন আশংকাজনক অবস্থায় হাসপাতালে। আমার ছোট ভাইস্তাটার করোনার রিপোর্ট যেদিন পজিটিভ আসে, ভাইস্তিটার সেদিন ১০৪ ডিগ্রি জ্বরসহ, চোখের পিছনে ব্যাথা, হাত-পা ব্যাথা ইত্যাদি যন্ত্রণা শুরু হয়। আমরা আশংকা করলাম ডেংগু। কিন্তু টেস্ট করে দেখা গেলো ডেংগু নেগেটিভ; করোনা পজিটিভ। যাই হোক, আমি যা বোঝাতে চাইলাম তা হলো- গত বছরের মতো করোনা এখন আর দূরে বা পত্রিকার পাতায় সীমাবদ্ধ নেই। ধীরে ধীরে তা চলে এসেছে আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে, এমনকি নিজের ঘরে। এর অবশ্য অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো করোনার ভয় আমাদের মধ্য থেকে চলে যাওয়া এবং নিয়ম মানার প্রতি শিথিলতা দেখানো। সমস্যা প্রকট কিন্তু তার প্রতি গুরুত্ব যদি হয় আধা-খেঁচড়া তবে তার পরিণাম হয় ভয়াবহ; এবং তা-ই হয়েছে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে ডেংগু আতংক যা গত বছর ছিলো না। ১১ তারিখে সর্বশেষ লকডাউন তুলে নেয়ার আগের দিনও মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ২৬৪ জন।
কয়েকদিন আগে বগুড়ার একটা পরিবারে তিনজনের মৃত্যু এবং প্রায় সবাই পজিটিভ আসার পর প্রশাসন ঐ পরিবারটাকে কার্যত একঘরে করে দেয়। পরিবারের লোকদের মুখে সেই করুন অভিজ্ঞতা শুনে মনে হয়েছে যেন তারা মৃত্যুপুরীর বাসিন্দা তখন। কিন্তু এমন কথা শুনেও আমাদের অনেকের মধ্যেই যেন ভয়ের কোন লেশ নেই। করোনা ব্যাপার না! তাই নিয়ম মানার কোন দরকার না! এমন ভাব অনেকের মধ্যে। আমি-আপনি যদি এদ্দিন ধরে করোনার করাল থাবা দেখেও ঠিক না হই; তো আমরাই তো এ কঠিনতার মূল হোতা! তাই নয় কি?
করোনা প্রতিরোধে এখন বড় কাজ হলো টিকা নেওয়া। নিয়ম মানার ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্নভাবে জনগনকে জানান দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তথাপি এ কাজ চলতেই হবে। কারণ কোন কথায় কার কাজে লেগে যায় বলা তো যায় না। সেই প্রয়াস থেকেই আমার এই লেখা।
জনস্বাস্থ্যবিজ্ঞানের একজন ছাত্র ও গবেষক হিসেবে অনুরোধ করে বলি- করোনা এবং ডেংগু দুটোকেই গুরুত্ব দিন এবং দুটোর জন্যই নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। মনে রাখবেন, বাংলাদেশে ডেংগুর প্রকোপ শুরু হয় জুন মাসে এবং শেষ হয় অক্টোবরে।
ডেংগু ও করোনার লক্ষণের মধ্যে তফাৎসমূহ জেনে রাখা দরকার। আর তা হলো-
১. জ্বর– সাধারণত করোনার ক্ষেত্রে ৯৯-১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট, আর ডেংগুর ক্ষেত্রে ১০৪-১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্বর থাকে।
২. ডায়রিয়া- করোনার ক্ষেত্রে কখনো কখনো হয়; ডেংগুর ক্ষেত্রে খুবই কম।
৩. শুষ্ক কাশি- করোনার একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ; ডেংগুর ক্ষেত্রে হয় না।
৪. শরীর ব্যথা- করোনার ক্ষেত্রে সম্ভাবনা থাকে; ডেংগুর ক্ষেত্রে হয়।
৫. নাক বন্ধ/পানি পড়া- করোনার ক্ষেত্রে হতে পারে; ডেংগুর ক্ষেত্রেও হতে পারে।
৬. বমি বমি ভাব- করোনার ক্ষেত্রে হতেও পারে; ডেংগুর ক্ষেত্রে হয়।
৭. মাথা ব্যাথা- করোনার ক্ষেত্রে হতে পারে; ডেংগুর ক্ষেত্রে চোখের পিছন থেকে শুরু করে মাথা ব্যাথা একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ।
৮. ক্লান্তি ভাব- করোনার ক্ষেত্রে হয়; ডেংগুর ক্ষেত্রেও হয়।
এই লক্ষণগুলো দেখে আমরা আমাদের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষন করে করোনা ও ডেংগুর লক্ষণ জেনে ডাক্তারকে জানাতে পারি এবং অবশ্যই টেস্ট করে চিকিৎসা শুরু করে দিতে পারি। ডাক্তারকে না জানিয়ে উড়ো প্রেসক্রিপশন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা উচিৎ নয়।
করোনা ও ডেংগুকালীন এই কঠিন সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে সবার আগে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সহযোগিতা করে সময়জ্ঞান। যেমন- ঠিক সময়ে সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার গ্রহন পুরো দিনকে নিয়মের আওতায় নিয়ে আসে। তাছাড়া সময়ের বিভিন্ন ভাগের সাথে শরীরের রয়েছে যোগসাজশ।
তাই আসুন জেনে নেই কোন সময়ে কোন কাজ করা উচিত-
* ভোরে ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক সাধনার অভ্যাস আছে যাদের তারা সাধনার পরপরই সকালের ব্যায়াম (ফুসফুসের ব্যায়ামসহ) ও রোদ পোহানোর কাজটা সেরে নিন। সকাল সাতটার মধ্যে সকালের ব্যায়াম করে ফেলা উচিত।
* সকালের নাস্তা অবশ্যই আটটার মধ্যে সম্পন্ন করুন। গ্যাসট্রিকের সমস্যা থাকলে নাস্তার পর দু-চিলতে কাঁচা পেপে খেয়ে নিন।
* দুপুরের খাবার একটা থেকে দেড়টার মধ্যে সম্পন্ন করুন। মূল খাবারের পর মিষ্টি মাল্টা বা পাকা আমের মতো ফল চলতে পারে।
* আক্রান্তরা অবশ্যই দুপুরের খাবারের আধাঘন্টা পর ঘুমাবেন। দুপুরে এক ঘন্টা ঘুম শরীর মনে বড় পরিবর্তন আনে।
* বিকালের ব্যায়াম পাঁচটায় সম্পন্ন হবে। ফুসফুসের ব্যায়ামসহ।
* বিকালের নাস্তা সাড়ে পাঁচটায়।
* রাতের খাবার আটটায়। পরে ক্ষুধা লাগলে পাকা পেঁপে, পাকা আম চলতে পারে। গ্যাস সমস্যা থাকলে দু-চিলতে কাঁচা পেপে চলবে।
* সন্ধ্যার পর লেবু, জাম্বুরার মতো ভিটামিন সি জাতীয় ফল না খাওয়াই ভালো।
* রাতের খাবারের পর পরই শুতে যাবেন না; দশ মিনিট বসে তারপর হালকা হাঁটাহাটি করতে পারেন।
* ফুসফুসের ব্যায়াম সাড়ে নয়টায়।
* রাতের ঘুম দশটায়। আক্রান্তদের কারো কাশি সমস্যা থাকলে প্রতি ঘন্টায় কালিজিরা চিবিয়ে খাওয়ার পর রঙ চা চলতে পারে।
উল্লিখিত সময়গুলোকে খাবার গ্রহনের মাইলফলক হিসেবে ধরে নিতে পারলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি দিনের সব কাজও ঠিক সময়ে সম্পন্ন করা যায়। সেইসাথে আজীবন নীরোগ ও সুস্বাস্থ্যের জীবনযাপন করা যায়। খাবারের ব্যাপারে আরেকটা তথ্য হলো যে খাবারে যার এলার্জি তার উচিৎ সেই খাবার পরিহার করে চলা। এই এলার্জি মানে কিন্তু শুধু চুলকানিকেই বুঝায়না। খাবারে এলার্জিক মানে হলো কোন নির্দিষ্ট খাবার গ্রহন করার পর যে কোনো ধরনের অস্বস্তি অনুভব করা। যেমন- পেটব্যাথা, ডায়রিয়া, আমাশয়, চুলকানি, শরীর ফুলে যাওয়া ইত্যাদি। এক্ষেত্রে বিকল্প খাবার গ্রহন করা উচিত। যেমন- দুধে যাদের এলার্জি তাদের উচিত দুধের বদলে বিকল্প আমিষ ও স্নেহ গ্রহণ করা যেমন –ডাল, মাছ, ডিম, জলপাইর তেল, ইত্যাদি । কালিজিরা, আমলকি, জাম্বুরা, লেবু, কাঁচা হলুদ, কচুশাক, পালংশাক, ডাটা শাক ইত্যাদি হলো স্বাস্থ্যকর পথ্য।
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিক, হার্ট, লিভার, কিডনি সমস্যাসহ সব রোগীদেরকেই ডাক্তার/পুষ্টিবিদের দেওয়া পুষ্টি চার্ট অনুযায়ী খাবার গ্রহণ করা উচিৎ। চল্লিশোর্ধ সবারই উচিৎ খাবার গ্রহনে নিয়মের প্রতি কঠোর মনোযোগী হওয়া। আরেকটা কথা, ঈদ মৌসুমে বিভিন্ন হাসপাতালে হার্ট এটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগীদের ভর্তির হার বেড়ে যায়। একটু-আধটু খেতে খেতে রোগীরা শেষে অসুস্থ হয়ে পড়েন, এমনকি মারাও যান। তাই, খাবার গ্রহণের চেয়ে বেঁচে থাকাকে প্রধান্য দিয়ে খেতে হবে।
আপনার হার্টবিট, রক্তের তাপ-চাপ, চোখের ঘুম ও চাহনি, এবং হাটার গতিপ্রকৃতিই বলে দিবে কেমন আছেন আপনি। নিজের শরীরের মতিগতি খেয়াল রাখুন এবং সেভাবেই তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিন। মৃত্যু নিশ্চিত, কিন্তু নিয়ম মেনে না চলা আগ বাড়িয়ে মৃত্যুকে গ্রহণ করার শামিল। এই নিয়ম মানা শুধু মাস্ক পরা আর হাত ধোয়াকেই বুঝায়না; বরং নানা রোগবালাইর সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকার জন্য ইমিউন সিস্টেমকে শক্ত-পোক্ত রাখার চলমান প্রচেষ্টাকেই বেশি করে বোঝায়। আক্রান্ত/অনাক্রান্ত সবারই একথা মনে রাখা উচিৎ।
লেখক: জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই