নজরুল জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীর তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি কেন?
২৯ আগস্ট ২০২১ ২৩:২১
“আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো,
দিবো না ভুলিতে।”
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতার এই পঙক্তি দুটোকে সত্যিতে রূপান্তর করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে সবসময় চিরযৌবনা। একাধারে তিনি বিদ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, অসাম্প্রদায়িকতার কবি। বাংলা সাহিত্য তার অবদান ভোলার নয়।
কবি নজরুল ছিলেন বাংলা সংগীত জগতের এক মহান ব্যক্তিত্ব। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে ভালোবেসে কলকাতা থেকে ১৯৭২ সালে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এমনকি তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্বও দেওয়া হয়। অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে এমনকি পাঠ্যবইয়েও জাতীয় কবির জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছাপা হচ্ছে, যা কোনো সচেতন ব্যক্তি মেনে নিতে পারে না।
ধূমকেতুর মতো আবির্ভাবের কবির জন্ম ইংরেজি ১৮৯৯ সনের ২৪ মে, এবং বাংলা সনাতন পঞ্জিকা অনুসারে ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ। আর মৃত্যু, ইংরেজি ১৯৭৬ সনের ২৯ আগস্ট, এবং বাংলা সনাতন পঞ্জিকা অনুসারে ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ। কিন্তু কবির এই জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে জন্ম নিয়েছে তারিখজনিত বিভ্রান্তি।
নজরুলের জন্মতারিখ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীর বইয়ে বিভিন্ন জন্মতারিখ দেখানো হয়েছে। জন্ম সাল ঠিক আছে— ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ; ১৩০৬ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসও ঠিক আছে। কিন্তু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে জন্মতারিখ নিয়ে। যেমন ২০১৮ সালের ৪র্থ শ্রেণীর ‘আমার বাংলা’ বইয়ের ৭৭ পৃষ্ঠায় এবং ৫ম শ্রেণীর ‘আমার বাংলা’ বইয়ের ৯ পৃষ্ঠায় কবির জন্মতারিখ লেখা হয়েছে ২৫ মে।
২০১৯ সালের ৫ম শ্রেণীর ‘আমার বাংলা’ বইয়ের ৯ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে ২৫ মে। একাদশ শ্রেণীর ‘সাহিত্যপাঠ গদ্য ও কবিতা’ ২০১৯ সালের বইয়ের ৭৯ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে ২৫ মে। ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ‘চারুপাঠে’ ৬৯ পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে ২৪ মে। ২০২০ সালের ৭ম শ্রেণীর ‘বাংলা প্রথমপত্র’ পৃষ্ঠা নং ৬৯ এবং ‘বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ পৃষ্ঠা নং ৯৮-এ লেখা হয়েছে ২৪ মে। ২০২০ সালের ৮ম শ্রেণীর ‘বাংলা প্রথমপত্র সাহিত্য কণিকা’র ১০ পৃষ্ঠায় ও ১০৯ পৃষ্ঠায় ২৪ মে লেখা রয়েছে।
৮ম শ্রেণীর ‘বাংলা দ্বিতীয়পত্রে’ ১১০ পৃষ্ঠায় ২৫ মে, ১৮৯৯ লেখা হয়েছে। ৮ম শ্রেণীর ‘ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রে’ কবির জন্ম দেখানো হয়েছে ২৫ মে, ১৮৯৯। একই শ্রেণীর ‘বাংলা প্রথমপত্রে’ এক জন্মতারিখ এবং ‘বাংলা দ্বিতীয়পত্র’ ও ‘ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রে’ অন্য জন্মতারিখ!
২০২০ সালের ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর ‘বাংলা প্রথমপত্রে’র ৮৩ ও ২২৭ পৃষ্ঠায় কবির জন্মতারিখ লেখা হয়েছে ২৪ মে। আমার ধারণা, যারা এসব বই সংকলন, রচনা ও সম্পাদনা করেন, তারা বইয়ের মধ্যে কী আছে তা দেখেন না, অথবা কবির প্রতি অবজ্ঞা ও অনীহা থেকে এ বিভ্রান্তি ঘটছে।
হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত ‘নজরুল ইসলাম কিশোর জীবনী’র পৃষ্ঠা নং ৯৯-এ কবির জন্মতারিখ ২৪ মে ১৮৯৯ লেখা হয়েছে। ‘নজরুলগীতি অখণ্ড’, সম্পাদনা আব্দুল আজীজ আল আমান, হরফ প্রকাশনী, ১২৬ কলেজ স্ট্রিট মার্কেট কলকাতা ৭০০০০৭, পরিমার্জিত সংস্করণ ২০০৬-এ কবির জন্মতারিখ ২৪ মে ১৮৯৯ লেখা রয়েছে।
‘নবযুগ ও নজরুল জীবনের শেষ পর্যায়’, সম্পাদনা শেখ দরবার আলম-এ বইয়ের অনেক জায়গাতেই উল্লেখ আছে কবির জীবিত অবস্থায় নজরুল জয়ন্তী উৎসব ২৫ মে ১১ জ্যৈষ্ঠ পালিত হয়েছে, অথচ ওই বইয়ের ৩৮১ পৃষ্ঠায় কবির জন্ম ১১ জ্যৈষ্ঠ ২৪ মে, ১৮৯৯ লেখা রয়েছে। সময়ের আবর্তনে ১১ জ্যৈষ্ঠ ২৪ অথবা ২৫ মে হতে পারে; কিন্তু তিনি যেদিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই ১৮৯৯ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ ইংরেজি মাসের কত তারিখ ছিল?
একইভাবে কবির মৃত্যুতারিখ নিয়েও আছে নানা বিভ্রান্তি। খ্রিস্টিয় সন অনুসরণ করলে ২৭ আগস্ট কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুদিবস নয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবি নজরুল পরলোক গমন করেছেন। আর যদি বাংলা সনকে মানি, অনুসরণ করি, তাহলে ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র, কবি নজরুলের মৃত্যুদিন। ২৭ আগস্ট আর ২৯ আগস্টের একটা বিতর্ক, বিভ্রান্তির জন্ম কিন্তু আমাদের এক দু’দিনের বাংলাপ্রেমের ফসল।
অনেকেই দ্বিধান্বিত হয়ে যায়,আসলে কবির মৃত্যুর তারিখ কবে, ২৭ আগস্ট না ২৯ আগস্ট? এর পেছনের রহস্যটা একটু বর্ণনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
উল্লেখ্য ড.মেঘনাথ সাহা প্রস্তাবিত একটি বাংলা দিন পঞ্জিকা মৃদু সংস্কারসহ তৎকালীন বাংলা একাডেমি প্রণীত ও সামরিক জান্তা এরশাদ সরকারের গৃহীত নিয়ম অনুযায়ী ১৯৮৩ সাল থেকে জাতীয়ভাবে সনাতন বাংলা পঞ্জিকাকে পরিহার করে। এরপর থেকে আধুনিক নতুন বাংলা দিনপঞ্জিকা অনুসরণ করা হচ্ছে। এই পঞ্জিকার প্রচলনের সময় ইংরেজি দিন পঞ্জিকাকে মাপকাঠি ধরে অধিবর্ষজনিত এবং বিশেষ বিশেষ নক্ষত্রমণ্ডলীর সৌরজগতের অতিক্রমণের সময় হিসেবের বিচ্যুতি সমূহকে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে সমৃদ্ধ এবং আধুনিক করা হয়েছে।
তাই জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী সনাতন পঞ্জিকা অনুসারে ১২ ভাদ্র পালন করা হয়। বাংলা পঞ্জিকা স্থির হয়ে যাওয়ার কারণে ১২ ভাদ্র ইংরেজি পঞ্জিকাতে ২৭ আগস্ট হয়ে যায়। আর যেহেতু আমরা সনাতন পঞ্জিকা অনুসারে নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে থাকি, তাই অনেকেই ভেবে বসে নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকী ২৭ আগস্ট। এভাবে অনেকেই বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো বাংলা তারিখকে ধরে ২৭ আগস্ট কবি নজরুল ইসলামের মৃত্যুদিবস হিসেবে পালন করে। অথচ এই বাংলা তারিখের হিসেব রাখার বিষয়টি রবীন্দ্র-নজরুলের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীতেই সীমাবদ্ধ। এই সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের সব কাজে ইংরেজি তারিখ ব্যবহার করে। আজও করেছে। তারা নজরুলের মৃত্যুদিনের যে খবর ছেপেছে তার ডেটলাইনে বাংলা তারিখ ব্যবহার করেনি। করেছে ইংরেজিকে। অথচ নজরুলের মৃত্যুদিন ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী ২৯ আগস্ট। তারা যদি ২৭ তারিখকেই নজরুলের মৃত্যুদিন বলে মানে তবে তাদের নজরুলের মৃত্যুদিনের নিউজের ডেটলাইনে বাংলা তারিখটা ব্যবহার করা উচিত ছিল। ইংরেজি নয়। কারণ বাংলা সনের ১২ ভাদ্র কবি নজরুলের মৃত্যুদিন। উইকিপিডিয়া, বাংলা বিশ্বকোষসহ অন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কবির মৃত্যুদিন ২৯ আগস্ট লেখা আছে। এদের অনেকেই ইংরেজি তারিখের পরে বন্ধনীর ভিতরে বাংলা তারিখটি উল্লেখ করেছে।
সংবাদমাধ্যমগুলোর কথা বাদ দিয়ে যারা নজরুল গবেষক পরিচয়ে গর্বিত, বা আমাদের বাংলা একাডেমির চোখেও কি বিভ্রান্তিটা ধরা পড়ে না? তারা কি বোঝেন না এই দুই নীতির কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন? কারণ আমরা আমাদের জীবনের সবক্ষেত্রে যেখানে এখন ইংরেজি তারিখ ব্যবহারে অভ্যস্ত সেখানে একদিন বিশেষ ব্যক্তির ক্ষেত্রে বাংলা তারিখ অনুসরণ করতে হবে কেন? এই বিশেষ ব্যক্তিত্বরা যেদিন জন্মেছেন বা মৃত্যুবরণ করেছেন সেদিনের কি কোনো ইংরেজি তারিখ ছিল না?
তবে এই বিভ্রান্তি দূর করা যে খুব কঠিন, তা কিন্তু নয়। হয় নজরুল, রবীন্দ্রনাথের মতো নক্ষত্রদের জন্ম, মৃত্যু দিবস ইংরেজি সন, তারিখ অনুসরণ করে পালন করা, নয়তো আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সরকারি, রাষ্ট্রীয় সব কাজে, সব ক্ষেত্রে বাংলা সনের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। এই নজরুলের জন্মতারিখ নিয়ে ভ্রান্তি, বিভ্রান্তি গোলযোগের একমাত্র হেতু নজরুলের জন্ম, মৃত্যুদিন পালনের জন্য বাংলা সন, মাস, তারিখ অনুসরণ করা। অথচ আমরা কি বাংলা সন তারিখ জানি, না মানি? পঞ্জিকা,ক্যালেন্ডার না দেখে শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষই বলতে পারবে না আজ বাংলা মাসের কত তারিখ।
আমরা যেখানে রাষ্ট্রীয়,সরকারি, বেসরকারি সব কাজে সারাবছর ইংরেজি তারিখকেই প্রাধান্য দেই, ইংরেজি তারিখ ব্যবহারে অভ্যস্ত সেখানে রবীন্দ্রনাথ,কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম এবং মৃত্যুদিন পালনে বাংলা সন, তারিখ ব্যবহার করা হচ্ছে কোন যুক্তিতে? এই একদিনের বাংলাপ্রীতি চরম বিভ্রান্তির জন্ম দিয়ে চলছে। আমরা আমাদের মহান শহিদ দিবস ৮ ফাল্গুন পালন করি না, পালন করি ২১ ফেব্রুয়ারিতে, বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরে, স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস ২৬ মার্চে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদত দিবস, জাতীয় শোক দিবস পালন করি ১৫ আগস্টে।
এ রকম সব জাতীয় দিবস পালন করি খ্রিস্টিয় সন, মাস, তারিখ অনুসরণ করে। সেখানে কেন, কোন যুক্তিতে, কার বুদ্ধিতে নজরুল, রবীন্দ্রনাথের জন্ম, মৃত্যুদিন বাংলা সনকে অনুসরণ করে পালন করতে গিয়ে বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছি? অনায়াসে যা সংশোধন করা যায়, তা সংশোধন না করে ঝুলিয়ে রাখছি কেন? কোন যুক্তিতে? আমাদের উচিত সবক্ষেত্রে বাংলা সন নয়তো খ্রিস্টিয় সন যে কোনো একটির অনুসরণ করা। তা হলেই বিভ্রান্তি কাটবে।
এসব বিভ্রান্তি দূর করার জন্য সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। পাঠ্যবইয়ে এ বিষয়গুলো উল্লেখ্য করা উচিত, যেন কেউ বিভ্রান্তির শিকার না হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই