রূপকথার এক রাজকন্যার গল্প
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২৩:৪৫
ইদানীং অবসর পেলে ইউটিউবে পাকিস্তানের কিছু ভিডিও দেখি। উর্দু বুঝি না। কিন্তু ভাষাভঙ্গি, কিছু ভাঙা ভাঙা শব্দের অর্থ ধরে ভিডিওগুলোর মূলভাব ঠিকই ধরে ফেলি। ২০১৮-এ ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পর ঘোষণা দিয়েছিলেন ৫ বছরের মধ্যে পাকিস্তানকে সুইডেন বানিয়ে দেবেন। তখন এক টিভি শোতে আলোচকরা পাল্টা বলে বসেন, ‘খুদা কি ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানা দো।’ ৫ বছরে সুইডেন নয়, আগামী দশ বছরে বাংলাদেশ বানিয়ে দিলেই তারা খুশি। একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে! যে পাকিস্তান ভুখা-নাঙা বাঙালিদের সারাজীবন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে গেল, এখন তারা সেই বাঙালিদের মতো হতে চাচ্ছে! একি মতিভ্রম?
এ আকুতির পেছনের রহস্য সেই আলোচকরাই ফাঁস করে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের রপ্তানি যেখানে ২২ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশের ৪০ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের স্টক এক্সচেঞ্জের তহবিলে যেখানে ১০০ বিলিয়ন ডলার আর বাংলাদেশের ৩০০।
গেল তিন বছরে ব্যবধান আরো বেড়েছে। পাকিস্তানের ১৯৮ রুপির মান এখন বাংলাদেশের ১০০ টাকার সমান। অথচ স্বাধীনতার পর পর চিত্র ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ১৬৫ টাকায় মিলত ১০০ রুপি। ১৯৭১-এ পাকিস্তানীদের শোচনীয় পরাজয়ের পর তারা দেশে ফিরে একটা সান্ত্বনা দিত এই বলে, যাক একটা বোঝা সরেছে। ভুখা-নাঙা বাঙালিদের বইতে হবে না।
রাতারাতি এমন কী হলো, দুটো দেশের অবস্থান বদল হয়ে গেল। সেই বিস্ময় পাকিস্তানীদের কাছেও। পাকিস্তান তুলা উৎপাদন করে। অথচ পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে অনেক এগিয়ে। পাকিস্তানে আছে মজবুত অবকাঠামো আর জনসম্পদ। বিস্তীর্ণ খোলা জায়গা। অথচ বিনিয়োগ আসছে বাংলাদেশে। পাকিস্তানে না। এর নেপথ্যে রূপকথার এক রাজকন্যার জাদুর কাঠির কারসাজি আছে। কী সেই যাদুর কাঠি?
মাত্র ১ যুগ আগের কথা। বাংলাদেশ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দুর্বল রাষ্ট্র। একসময় জঙ্গিবাদের লাগামছাড়া উত্থানের কারণে দেশটির কপালে জুটেছিল ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা। ঋণ-দাতা রাষ্ট্র ও সংস্থা সে দেশকে কান ধরে ঘুরাতো। বারো বছরের মাথায় সেই দেশ এখন পৃথিবীর অন্যতম সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে স্থিতিশীল অর্থনীতি। যে চলত ঋণের টাকায়, সে এখন ক্যারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে অন্যকে ঋণ দেয়।
না, এর মধ্যে এ দেশে কোন তেলের কিংবা স্বর্ণের খনি আবিষ্কৃত হয়নি। উৎপাদন ব্যবস্থায় আসেনি আহামরি কোন পরিবর্তন। পরিবর্তন যা এসেছে শাসন ব্যবস্থায়। তাতেই বদলে গেছে দেশটি।
মোড়লদের কথা মত না চলায়, দুর্নীতির অভিযোগে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়ো প্রকল্পে বিনিয়োগ না করার ঘোষণা দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। সেই মহীয়সী রাজকন্যা সেদিন ঘোষণা দিয়েছিলেন, নিজেদের টাকায় আমরা পদ্মা সেতু বানাব। লেজকাটা শৃগাল যেমন অন্যের লেজ খসে পড়লে খুশি হয়, এদেশের কিছু লুটেরাও তখন খুব খুশি হয়েছিল। প্রচার হয়েছিল, শুধু প্রধানমন্ত্রীর জিদ মেটাতে গিয়ে রাজকোষ ফাঁকা হয়ে যাবে। অর্থনীতিতে ধ্বস নামবে। কেউ উপহাস করে বলেছিলো, নিজেদের অর্থে বাঁশের সেতু হবে। কেউ কেউ উপদেশ দিয়েছিলেন সেই সেতুতে না উঠতে। বহুভাবে দুর্নীতির অপবাদ দেয়া হয়েছিল।
অথচ ১০ বছরের মাথায় সেই উপহাস আজ ফিরে গেছে নিন্দুকের পানে। শত্রুর মুখে ছাই। পদ্মাসেতু আজ বাস্তবতা। যারা দুর্নীতির কথা বলে ভ্রুকুটি করেছিল, তারাই স্বীকার করেছে সততার। সেই রাজকন্যা পেয়েছেন পৃথিবীর সেরা তিন সৎ রাষ্ট্রনেতার মধ্যে স্থান। তৃতীয় বিশ্বের আধমরা এক দেশ কী বিস্ময় দেখিয়ে দিল, বড় বড় চোখ করে বিশ্ব মোড়লরা দেখে।
শুধু পদ্মা সেতু নয়, হচ্ছে দুটো বৃহৎ গভীর-সমুদ্র বন্দর। দেশের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত গড়ে তোলা হচ্ছে শক্তিশালী রেল নেটওয়ার্ক। বন্দরকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক আমদানি রপ্তানির কেন্দ্রবিন্দু হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
হচ্ছে ৫৫ টি সরকারি ও ১১ টি বেসরকারি ইকনোমিক জোন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, ফেনী ও নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ সমুদ্রতট ফুঁড়ে জেগে ওঠা বঙ্গবন্ধু ইকনোমিক জোন, যা একাই যোগান দেবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি। তের হাজার একরেরও অধিক ভূমি নিয়ে গড়ে উঠছে এক বিস্ময়। ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরে দ্বিতীয় রানওয়ে ও তৃতীয় টার্মিনালের কাজ চলছে। শেষ হলে এটাই হবে এশিয়ার সেরা বিমানবন্দরগুলোর একটি। সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি বিমানবন্দরকে দেখা যাবে ঢাকার কুর্মিটোলায়। কক্সবাজারে রানওয়ে বিস্তৃত করে সুপরিসর বিমান উঠানামা করার উপযোগী করা হচ্ছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দর হতে যাচ্ছে আঞ্চলিক বিমানবন্দর। এই তিন বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর-হংকঙের মতো একটি এভিয়েশন হাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে দ্রুত।
অথচ বঙ্গবন্ধুর হত্যার ৬ বছর পর তার বড়কন্যা যখন দেশে ফিরেছিলেন, কেউ ভাবেনি সামরিক জান্তার মুঠো থেকে এ দেশ কখনো মুক্তি পাবে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব হাতে তুলে নেন। স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ে ফ্রন্টলাইনার হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। একাধিবার তাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে। ১৯৮৮-এর ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ দিয়ে তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে বাঁচিয়েছিল। সেদিন একটা কিছু হয়ে গেল আজকের এই জেগে ওঠা বাংলাদেশ আমাদের কাছে অধরাই থেকে যেত।
এরপর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু সামরিক সরকারের ঔরসজাত সংগঠনটি গেল ক্ষমতায়। গণতন্ত্র রূপ নিল প্রহসনে। বোমা গ্রেনেডে প্রকম্পিত হতে লাগল ৫৬ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ড। আবারও নেতাকর্মীর প্রাণব্যূহ বাঁচিয়ে দিল নেত্রীকে। ২০০৪-এর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে তথাকথিত গণতান্ত্রিক দলটির ছদ্মবেশ উন্মোচিত হলো। সারা পৃথিবী বুঝে গেল বাংলাদেশ ভবিষ্যতের এক নরক হতে যাচ্ছে। অর্থনীতি বলুন সুশাসন বলুন, প্রতিটি সূচকই সেই কথা বলছিল।
কিন্তু গল্পটা যে এক রাজকন্যার। যার বাবা অনেক কষ্ট করে একটা দেশ স্বাধীন করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতায় জেঁকে বসে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিনিধিরা। সেই রাজকন্যা অনেক কষ্ট করে দেশে ফিরল। ২১ বছর আন্দোলন সংগ্রাম করে ক্ষমতায় গেল। মৃত বাবার কাছে কথা দিয়েছিল, তার স্বপ্নের দেশটিকে সে গড়ে তুলবে। সেই প্রত্যয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছে দিনমান। তার সুফল এখন চারদিকে দৃশ্যমান।
সেই রাজকন্যার আজ ৭৫ তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন জননেত্রী শেখ হাসিনা। আরো দীর্ঘ হউক আপনার জন্মযাত্রা। আরো এগিয়ে যাক প্রাণের বাংলাদেশ।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক: অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়; সদস্য, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
সারাবাংলা/এসবিডিই
অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান মত-দ্বিমত রূপকথার এক রাজকন্যার গল্প শেখ হাসিনার ৭৫ তম জন্মদিন শেখ হাসিনার জন্মদিন