আদালতের রায় মেনে ‘জয় বাংলা’ বাধ্যতামূলক করা সরকারের দায়িত্ব
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৪:৪৮
২০২০ সালের ১০ মার্চ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণের জন্য হাইকোর্টের বিচারপতি নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দেন। জয় বাংলা কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার পর জাতীয় দিবসগুলোতে উপযুক্ত ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদাধিকারী ও রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকর্তা সরকারি অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান যাতে উচ্চারণ এবং সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাত্যহিক সমাবেশ শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ যাতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেন সেই আদেশ প্রদান এবং তা আগামী তিন মাসের মধ্যে কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই আদেশ কার্যকরের জন্য সরকারকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে বলেছেন আদালত। হাইকোর্ট যেহেতু সংবিধান সংশোধন বা আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা রাখেন না— তাই আদালত বলেছেন, সরকার চাইলে সংসদে আইন পাস করে কিংবা সংবিধান সংশোধন করেও বিষয়টিকে স্থায়ী রূপ দিতে পারে।
বাংলাদেশ নামক এই জাতিরাষ্ট্রের উৎস থেকে উৎসারিত জন্মধ্বনি জয় বাংলা। বাঙালির আত্মপরিচয়জ্ঞাপক এই স্লোগান বাঙালির শৌর্য-বীর্য, সংগ্রাম-সংস্কৃতি ও জাতীয় আবেগকে খুবই তীব্র ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে পূর্ণ মাত্রায় ধারণ করে। জয় বাংলা যেমন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি তেমনি আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকল নাগরিককে স্ব-দায়িত্ব পালনে উজ্জীবিত করার বীজমন্ত্র। অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, প্রগতি ও দেশপ্রেমে আত্মপ্রত্যয়ী করতে ‘জয় বাংলা’ শব্দ যুগল প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে যে দ্যোতনা তৈরি করে তার উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হতে হবে আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
বাঙালি তার হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় সুবর্ণ সময় অতিক্রম করছে। বাংলাদেশ নামক এই জাতিরাষ্ট্রের সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ মুজিববর্ষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত বাঙালির জন্মস্বর জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারি, আইন প্রণয়ন বা রায় বাস্তবায়নের কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। মুজিববর্ষ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে (১৬ই ডিসেম্বর, ২০২১) ২৮ সেপ্টেম্বর আধুনিক বাংলাদেশের নিপুণ কারিগর, বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৫তম জন্ম জয়ন্তী (প্লাটিনাম জয়ন্তী)। জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ জাতীয় মননে স্থায়ী রূপ দিতে জনগুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট সকলের বিবেচনায় আনার সুবর্ণক্ষণ এখনই।
১. হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় দিবসগুলোতে উপযুক্ত ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদাধিকারী ও রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকর্তা সরকারি অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষে এবং সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাত্যহিক সমাবেশ শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করতে হবে।
২. রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যসহ সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে বর্ণিত সকল সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তি শপথের অধীন। সাংবিধানিকভাবে যাদের শপথ গ্রহণপূর্বক দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়, সকল শপথের (গোপনীয়তার শপথসহ) শেষ বাক্য হোক ‘জয় বাংলা’। সেই সঙ্গে সংসদ সদস্য ও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিদের শপথেও জয় বাংলা উচ্চারণ বাধ্যতামূলক করা হোক।
৩. সেনাবাহিনীসহ সকল শৃঙ্খলা বাহিনীর অফিসার ও সদস্যদের বিধি অনুযায়ী যে শপথ গ্রহণ করতে হয় সেখানেও জয় বাংলা যুক্ত করতে হবে। বিভিন্ন পেশাজীবী, স্বেচ্ছাসেবক, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিকর্মীসহ বাংলাদেশের সব শ্রেণির নাগরিককে বিশেষ দিবস, ইস্যু বা অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে শপথ নিতে হলে জয় বাংলা উচ্চারণ করতে হবে।
৪. সকল প্রকার রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত যাপিত জীবনে ‘জয় বাংলা’ সম্বোধন, অভিবাদন, সৌজন্যতা ও কল্যাণসূচক বাক্য হিসেবে ব্যবহার করতে সবার উদ্যোগী হতে হবে। ছালাম, আদাব, খোদা হাফেজ, হাই, গুড মনিং/অফটারনুন/নাইট.. ট্র্যাডিশনাল কোনো রীতিকে পরিহার না করে তার সঙ্গে শুধু ‘জয় বাংলা’ যুক্ত করতে হবে।
৫. বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ সকল ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার সংবাদ, অনুষ্ঠান, তথ্যচিত্র, চলচ্চিত্রে শেষবাক্য হিসেবে জয় বাংলা ব্যবহার করতে হবে।
৬. করোনা উত্তর বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলামে যুগান্তকারী ইতিবাচক পরিবর্তনের কাজ শুরু হয়েছে। শিশুদের মনে জয় বাংলার বীজ বপন করতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন বিষয়বস্তু ও মুখবন্ধে জয় বাংলার যথোপযুক্ত ব্যবহার করতে হবে। সেই সঙ্গে সকল শ্রেণিতে ‘উপস্থিত স্যার’ বা ‘ইয়েস স্যার’ না বলে ‘জয় বাংলা’ বলতে নির্দেশনা জারি করতে হবে।
৭. যুগে যুগে ধর্মজীবীদের জন্য জয় বাংলা সবচেয়ে বড় শত্রু। এটি হিন্দুদের স্লোগান বলে তারা প্রচার করে থাকে। অথচ হিন্দ বা হিন্দু শব্দটি এসেছে সিন্ধুনদ থেকে। ইসলামী ফাউন্ডেশন এ ক্ষেত্রে উদ্যোগী হতে পারে। যেহেতু দেশপ্রেম সব ধর্মেই খুব পবিত্র বিষয় তাই সকল প্রকার ইসলামী জলসা, মাহফিল ও অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা’ ব্যবহার করার উদ্যোগ নিতে হবে।
৮. সরকারি-বেসরকারি সকল অনুষ্ঠান, দাওয়াতপত্র, শুভেচ্ছা বার্তা, বই-পুস্তকের মুখবন্ধ, ক্রোড়পত্রে জয় বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৯. বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ‘‘জয় বাংলা’ কে যথোপযুক্তভাবে ব্যবহার করতে হবে। সংগঠনের নিবন্ধনের প্রাক-শর্ত হিসেবে জয় বাংলা উল্লেখিত প্যাডে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের (নির্বাচন কমিশন, সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর) নিকট আবেদন বাধ্যতামূলক করতে হবে।
১০. লেখক-কবি-সাহিত্যিক, কলামিস্ট, ব্লগার, অনলাইন একটিভিস্ট সবাইকে অফলাইন, অনলাইনে ‘জয় বাংলা’ বিষয়ক বিভন্ন লেখা লিখতে হবে। এছাড়া নিজের সকল প্রকার লেখা ‘জয় বাংলা’ দিয়ে শেষ করার রীতি প্রচলন করতে হবে।
প্রাসঙ্গিকতা
উপমহাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে বিভিন্ন স্লোগান বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনাকে নানাভাবে উদ্দীপ্ত করেছে। সব স্লোগানকে ছাপিয়ে ‘জয় হিন্দ’, ‘জিয়ে পাকিস্তান’ ও ‘জয় বাংলা’ যথাক্রমে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এই ৩ দেশের জনগণের লড়াই-সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের পরম্পরায় সার্বজনীনভাবে উচ্চারিত যা তিন দেশেই জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান ভারতবর্ষে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ভারতের সকল জাতিগোষ্ঠীর দেশপ্রেমিক সচেতন জনগণ জয় হিন্দকে নিত্য ব্যবহৃত অভিবাদন বাক্যে পরিণত করেছে। এর পাশাপাশি জয়ধ্বনি বা রণ হুংকার হিসেবে ৯০-এর দশকে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয় ‘জয় হিন্দ’। ভারতীয় সেনা সদস্যগণ পাসিংআউট প্যারেডে শপথ গ্রহণ করে ‘জয় হিন্দ’ উচ্চারণ করে। ভারতীয় সেনা সদস্যরা শুধু স্যালুটেশনে নয়, উঠতে বসতে দৈনিক প্রায় হাজারবার ‘জয় হিন্দ’ উচ্চারণ করে। ২০১২ সালে ইন্ডিয়ান আর্মি চিফ জেনারেল বিক্রম সিং ‘জয় হিন্দ’ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে একটি অফিস আদেশ জারি করেন।
Instead of a bland ‘Good Morning/Afternoon’ the Indian Army officers will now greet each other with a crisp salute accompanied with ‘Jai Hind’, immortalised by Subhas Chandra Bose as the battle cry for his Indian National Army. The new order is part of Army Chief General Bikram Singh’s mandate to his troops —“Back to Basics”. The new Indian Express, 16 Sept 2012.
গুজরাটে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে স্কুল পড়ুয়াদের নিজের উপস্থিতি জানান দিতে ‘ইয়েস স্যার’-এর স্থানে ‘জয় হিন্দ’ বলতে হবে হবে নির্দেশ জারী করেছে রাজ্যের শিক্ষা দফতর। নির্দেশনায় বলা হয়, ‘সার্কুলারটি সব সরকারি স্কুল, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুল ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতে কঠোরভাবে মেনে চলা হয়, তা নিশ্চিত করবেন জেলার শিক্ষা কর্মকর্তারা। (১জানুয়ারি, ২০১৯ দৈনিক ইত্তেফাক)।
এ বছরের মার্চে ভারতের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া নোটিশ জারি করেছে, যাত্রীদের উদ্দেশ্য করে ঘোষণার সময় তাদের প্রতিবার ‘জয় হিন্দ’ বলতে হবে।
পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগ ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান তোলে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ৪৭-এর দেশভাগের অব্যবহিত পরই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে গোটা উপমহাদেশে। পাকিস্তান আর্মিতে ‘জিয়ে পাকিস্তান’ ও ভারতীয় সেনা বাহিনীতে ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়। ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। শুধু বাঙালি নয়—বেলুচ, সিন্ধ, পাশতুন, পাঞ্জাবিসহ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। একমাত্র বাঙালি তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছিল। ধারাবাহিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শেষে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বুকে ধারণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে নিয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছিল আমাদের একজন বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিধায়। অন্যরা আজও মুক্তির লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ১৩ আগস্ট, ২০২০ দৈনিক ইত্তেফাকের একটি সংবাদ শিরোনাম—‘১৪ আগস্টে কালো দিবস পালন করবে সিন্ধু-বেলুচ, পাশতুনরা।’
যদিও পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রাদেশিক জাতিগোষ্ঠী এখনও কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার তথাপি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও সকল রাজনৈতিক দল ও সচেতন নাগরিকগণ ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’কে মুসলিম লীগ বা অন্যকোনো নির্দিষ্ট দলের নিজস্ব স্লোগান মনে করে না, জাতীয় স্লোগান হিসেবেই সার্বজনীনভাবে হৃদয়ে ধারণ করে।
‘জয় বাংলা’ উপমহাদেশে সবচেয়ে প্রেরণাদায়ী, তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান। অথচ ভারত ও পাকিস্তানে জয় হিন্দ ও পাকিস্তান জিন্দাবাদ যে সার্বজনীনতা পেয়েছে, জয় বাংলার ক্ষেত্রে তাকে পাড়ি দিতে হচ্ছে খুবই বন্ধুর পথ। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরেও জয় বাংলা রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও ধর্মান্ধতা ও প্রোপাগান্ডা বাংলাদেশের প্রধানতম সমস্যা। ’৭১ ও ’৭৫-এর শত্রুদের আমরা সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করলেও জাতীয় মানসে যে ধর্মভীরুতা রয়েছে তাকে পুঁজি করেই তারা গোপনে ও ভার্চুয়ালি এখনও অতীতের মতোই ক্রিয়াশীল । পাকিমনা সেই শত্রুরা ‘জয় বাংলা’র জায়গায় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর আদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছে— সেই সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ কে ইসলাম বিরোধী, হিন্দুয়ানী ও একটি রাজনৈতিক দলীয় স্লোগান হিসেবে প্রচার করছে।
শেখ হাসিনার বক্তব্য অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু কবি নজরুল ইসলামের কবিতা থেকে জয় বাংলা শব্দটি নিয়েছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা মাদারীপুরের স্কুল শিক্ষক পূর্ণচন্দ্র দাসের মুক্তির দাবীতে নজরুল রচনা করেন ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ (১৯২২) কবিতাটি।
‘জয় বাঙলা’র পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি অন্তরীণ,
জয় যুগে যুগে আসা সেনাপতি, জয় প্রাণ অন্তহীন।
এ সম্পর্কে আরেকটি তথ্য পাওয়া যায়, তা হলো, কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত নবযুগ পত্রিকার ৩রা বৈশাখ ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ (১৯৪২) সংখ্যায় ‘বাঙালির বাঙলা’ নামে প্রকাশিত তার রচনাটি শেষ করেন এভাবে, ‘বাঙলা বাঙালির হোক। বাঙালির জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।’
তবে অধিকাংশ রাজনৈতিক গবেষকের মতামত, ছাত্রলীগই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের উদগাতা। ’৬৯-এর সফল গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হয়ে ২১ জন সফরসঙ্গী নিয়ে পাকিস্তান সফর করেন। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আব্দুর রউফ বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন এবং করাচীতে বাঙালি ছাত্রদের নিয়ে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনকালে তাদের জনপ্রিয় স্লোগান ‘জিয়ে সিন্ধ’ এর আদলে নতুন স্লোগান তৈরিতে উদ্দীপ্ত হন। রাজনৈতিক গবেষক বিশেষ করে সিরাজুল আলম খান দাদাভাই’র অনুসারীগণের মতে, ১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধুর ক্যান্টিনে শিক্ষা দিবসের প্রস্তুতিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মীসভায় আফতাব আহমাদ এই স্লোগান প্রথম উচ্চারণ করেন যা প্রথম প্রতি-উত্তর করেছিলেন চিশতী শাহ হেলালুর রহমান।
১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এটি প্রথম জনসম্মুখে ধ্বনিত হয়। ওই সভামঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ডে দেবদারু পাতা দিয়ে ‘জয়বাংলা’ লেখা ছিল। ১১ জানুয়ারি পল্টনের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে এলে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে তাকে স্বাগত জানানো হয়। অনেকের মতে, ওই মঞ্চেই বঙ্গবন্ধু প্রথম ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন। তবে অধিকাংশের মত, ৭ই জুন রেসকোর্স ময়দানে ছাত্রলীগ গঠিত ‘জয়বাংলা বাহিনী’ কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেওয়ার সময় তিনি প্রথম ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন।
বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ সমাপ্ত করেছিলেন ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করে। এই ভাষণের পর থেকে এটি সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। ২৩ মার্চ সারাদেশে উত্তোলিত হয় ‘জয়বাংলার পতাকা’ (পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসের বিপরীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিরোধ দিবস)। ১৯৭১-এর মার্চ থেকে জনসভা, মিছিলে এবং প্রচারণায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ব্যবহৃত হতে থাকে। ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমান অস্থায়ী কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন তার শেষেও তিনি ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সময় ‘জয় বাংলা’ ব্যবহার করা হতো। এই বেতার কেন্দ্রের স্বাক্ষরসংগীত ছিল ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১১ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহ্মদের প্রথম বেতার ভাষণটি শেষ হয়েছিল ‘জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’ স্লোগান দিয়ে।
তবে জন্ম থেকেই ‘জয় বাংলা’কে প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। ছাত্র ইউনিয়ন জয় বাংলার বিপরীতে ‘জয় সর্বহারা’ স্লোগান দেয়। ‘মুসলিম বাংলা’ থিওরির প্রণেতা মজলুম জননেতা হিসেবে স্বীকৃত মাওলানা ভাসানী ১৯৭১-এর শুরু থেকেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের বিরোধিতা করে ‘স্বাধীন বাংলা জিন্দাবাদ’, ‘আজাদ বাংলা জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি স্লোগান ব্যবহার করতেন। কিন্তু ৭১ এ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের জোয়ারে সব ষড়যন্ত্রই ভেসে যায়। ‘জয় বাংলা’ এই একটি মাত্র স্লোগানই ধর্ম-বর্ণ-মতাদর্শ নির্বিশেষে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল মহান স্বাধীনতার সংগ্রামে। একদিকে যেমন পাক হানাদার ও রাজাকার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জয় বাংলা বাহিনী’ হিসেবে যমের মতো ভয় পেত, অন্যদিকে সাধারণ জনগণ অভয় পেত এই জয় বাংলা বাহিনী দেখলেই। শরণার্থীরাও কলকাতা, আগরতলায় জয় বাংলার লোক হিসেবেই পরিচিত ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধ শুরু করেন ‘জয় বাংলা’ বলে। যুদ্ধের বিজয়োল্লাসও করেন ‘জয় বাংলা’ বলে। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতেই সৃষ্টি বাংলাদেশ। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বাঙালি তার আত্মপরিচয়, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক নির্মাণ করে।
’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও কবর দেওয়ার চেষ্টা করে হত্যাকারীরা। খন্দকার মোশতাক পাকিপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবার আগে ‘জয় বাংলা’র জায়গায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেয়। এরপর টানা ২১ বছরের ইতিহাস সবার জানা। শুধু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে হত্যাকারীদের সুরক্ষা দেওয়াই নয়, সেই সঙ্গে রাজাকারদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন ও বাংলাদেশের বুক থেকে বঙ্গবন্ধু ও জয় বাংলাকে স্থায়ীভাবে মুছে দিতে কত চেষ্টাই না আমরা দেখলাম। যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের কম্পনে প্রকম্পিত হয়েছিল দেশ, আত্মসমর্পণের লজ্জায় নত হয়েছিল পাকিস্তান, সেই পাকিস্তানের ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর আদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ আদতে আমাদের ‘ফেলে দেওয়া থুথু ফের মুখে নেওয়ার চেষ্টা’। এর চেয়ে বড় আত্মপ্রবঞ্চনা আর হয় না।
আমরা যারা স্বাধীনতার প্রথম প্রজন্ম, তাদের একাত্তর দেখা হয়নি; তবে প্রথমবারের মতো ‘জয় বাংলা’র শক্তি অনুভব করেছি ১৯৯২ সালে শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ আদালত গঠনের সময়। ২০১৩ সালে দ্বিতীয়বার অদেখা মুক্তিযুদ্ধের স্বাদ পেয়েছি কোনো প্রকার দলীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া গড়ে ওঠা শাহবাগের গণজাগরণের সময়। অনেক বছর পর রক্ত দিয়ে কেনা হারিয়ে যাওয়া প্রিয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হলো সারা দেশ। ‘জয় বাংলা’ কোনো দলীয় স্লোগান নয়, এর মালিক বাংলাদেশ। তাই যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে দল-মত নির্বিশেষে আপামর গণ মানুষের মুখে মুখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হলো ‘জয় বাংলা’।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে একদা বঙ্গবন্ধু শব্দটিকে নির্বাসিত করা হয়েছিল এদেশ থেকে কিন্তু বঙ্গবন্ধু আবার ফিরে এসেছে আরও তেজদীপ্তভাবে। বলা হয়ে থাকে জীবিত বঙ্গবন্ধু চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু বেশি শক্তিশালী। বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনতে যে পরিমাণ সংগ্রাম করতে হয়েছে, সে তুলনায় ‘জয় বাংলা’কে পুণঃপ্রতিষ্ঠা করা অনেক সহজতর। যেহেতু সর্বোচ্চ আদলত জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল টানা তৃতীয়বারের মতো দেশ পরিচালনা করছে, তাই লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে যেন হাইকোর্টের রায় চাঁপা পড়ে না থাকে। রায় বাস্তবায়নে আদালত তিন মাস সময় দিয়েছিলেন, অথচ দেড় বছর অতিক্রান্ত। মুজিববর্ষের মধ্যেই রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও যাপিত জীবনের সকল ক্ষেত্রে জয় বাংলা স্লোগানকে স্থায়ী ভিত দিতে নতুন আইন প্রণয়ন করা হোক। নতুন আইনের আলোকে উপযুক্ত ক্ষেত্রে জয় বাংলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহকে প্রজ্ঞাপন জারির উদ্যোগ নিতে হবে। সকল পশ্চাৎপদতা ও ধর্মান্ধতাকে জয় করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুখী সমৃদ্ধ আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ গড়তে জয় বাংলা স্লোগান আপামর জনগণ যত শীঘ্র হৃদয়ে ধারণ করবে ততই মঙ্গল। সংশ্লিষ্ট সবার দ্রুত বোধোদয় হোক। জয় বাংলা।
লেখক: কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ
সারাবাংলা/আইই