Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গণমাধ্যমে চ্যালেঞ্জ জয়ের নতুন অভিজ্ঞতা

মোস্তফা কামাল
১ নভেম্বর ২০২১ ১৯:০৯

বাংলায় ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ ইংরেজিতে ‘ইউর এইম ইন লাইফ’ রচনা স্কুল জীবনের প্রায় প্রতি ক্লাসে সবারই লিখতে হয়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, জজ, ব্যারিস্টার, অধ্যাপক হবার লক্ষ্যের কথাই বেশি লেখা হয়। বানিয়ে বা গ্রন্থগত বিদ্যায় চমৎকার রচনা লিখে আচ্ছা নম্বর তোলার প্রতিযোগিতা চলে। আর্টস বা কমার্সের শিক্ষার্থীদের কেউ-কেউও ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা লেখে। তাই বলে নম্বর কম দেয়া হয় না। সাংবাদিক হওয়ার লক্ষ্যের কথা ক’জনে লিখেছে?

বিজ্ঞাপন

সাংবাদিক হওয়ার মতো লক্ষ্য স্থির করার কারণ ছিল না। তা এখনও কম। সাংবাদিকতা বিষয়ে এখন উচ্চতর শিক্ষা রয়েছে দেশের প্রায় সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে । প্রাইভেটেও আছে বেশ ক’টিতে। ট্র্যাজেডি হচ্ছে, সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়েও এই শিক্ষার্থীদের সবার সাংবাদিকতার লক্ষ্য থাকছে না। সবাই সাংবাদিকতায় আসছেও না। এর যথেষ্ট কারণ ও ব্যাখ্যা রয়েছে। পেশাগত মানদণ্ডে সাংবাদিকতা এখনো পূর্ণতা না পাওয়া এর অন্যতম কারণ। সপ্তাহের প্রথম দিন গত ৩০ অক্টোবর শনিবার ঢাকায় সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত ‘৫০ বছরের বাংলাদেশ: গণমাধ্যমের অর্জন ও আগামীর চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সেমিনারে উঠে এসেছে পেশাটির হাল অবস্থার নানা দিক। বিভিন্ন মত ও আদর্শের সম্পাদকরা সভায় রাখঢাকের মধ্যেও বলার তেমন বাকি রাখেননি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করা কতো কঠিন তা উঠে এসেছে সম্পাদকদের বক্তব্যে। দেশে সাংবাদিকতার নানান প্রতিকূলতা তুলে ধরে তারা বলেছেন, এর মধ্যে টিকে থাকাও বড় অর্জন।

বিজ্ঞাপন

সম্পাদক পরিষদের সেমিনারটির সামান্য ক’দিন আগে, প্রকাশ হয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস-সিপিজের ‘গ্লোবাল ইমপিউনিটি ইনডেক্স-২০২১’। দেশে-দেশে গণমাধ্যম কর্মী নিপীড়ন ও হত্যার তথ্যে ঠাঁসা ইনডেক্সটি। এতে দেখা যায়, বিশ্বে সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম। সিপিজের ওয়েবসাইটে দেয়া প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়া দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষে আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া। সোমালিয়ার পরে রয়েছে যথাক্রমে সিরিয়া, ইরাক, দক্ষিণ সুদান, আফগানিস্তান, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, ব্রাজিল, পাকিস্তান ও রাশিয়া। তালিকায় ১১ নম্বরে থাকা বাংলাদেশের পরেই ভারতের পজিশন। বাংলাদেশে গত এক দশকে ছয় সাংবাদিক খুনের বিচার ঝুলে রয়েছে। আর ভারতে রয়েছে ২০টি। ২০১১ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১০ বছরে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিক হত্যা এবং এসব হত্যা মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করে তৈরি হয়েছে সূচকটি। গত ১০ বছরে খুন হওয়া সাংবাদিকদের ৮১ শতাংশই বিচার পাননি।

কেবল হত্যাই নিপীড়ন নয়। পীড়ন বা নিপীড়নের আরো নানা দিক রয়েছে। সম্পাদক পরিষদের সেদিনের সেমিনারটিতে সাংবাদিকদের মধ্যে পেশাগত ঐক্যের বদলে বিভেদের কথা এসেছে। এ বিভেদ তৈরি সাংবাদিক নিপীড়ন নিশ্চিতের একটি কৌশল কি-না ভেবে দেখার দাবি রাখে। আইনে স্পষ্ট লেখা আছে, একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে একাধিক মামলা হতে পারে না। কেবল সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিই মামলা করতে পারবে। তাহলে কেন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একই ঘটনার জন্য মামলার বন্যা শুরু হয়। যে বা যারা সংক্ষুব্ধ নন, তারাও মামলা করেন। আদালত সেগুলো গ্রহণ করে। এটি কি আইনের খেলাপ নয়? সবচেয়ে প্রধান যে আইন সাংবাদিকতাকে প্রতিহত করছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন। আদতে সাইবার ক্রাইম কি বন্ধ হয়েছে?

সাম্প্রদায়িকতার বিকট বীভৎস সাইবার ক্রাইম সাংবাদিকরা করেছে? বরং এই সময়টায় গণমাধ্যম কেবল সাবধানী নয়, সংযত এবং সংবেদনশীল ভূমিকা রেখেছে। যা ক্ষমতাসিন-ক্ষমতাহীন রাজনৈতিক দলও করেনি। অথচ আইনটি যথেচ্ছভাবে সাংবদিকদের বিরুদ্ধেই অপপ্রয়োগ হচ্ছে। এতে এই আইন সাইবার সিকিউরিটির বদলে গণমাধ্যম প্রতিহতকরণ নিশ্চিত করছে। টিকে থাকার একটা সংগ্রাম আছে। তা একটি চ্যালেঞ্জ।

অস্তিত্বের প্রশ্নে অর্জনের এই পাল্লা আরও ভারী করতে হবে গণমাধ্যমকর্মীদেরই। সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্যের ঘাটতি রয়েছে। পেশাদারিত্ব বাড়ানোর গরজও কম। রাজনৈতিক বিভাজনের মতো সাংবাদিকদের সংগঠন অনেক। অস্বীকারের কোনো জো নেই যে, গোটা বিশ্বের গণমাধ্যমই কঠিনেরও কঠিন সময় পার করছে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। তা প্রিন্ট-ইলেক্ট্রনিক সব মাধ্যমেই। রাজনৈতিক ভাবাদর্শ এবং রাষ্ট্রীয় নীতি ছাড়াও বৈশ্বিক মহামারি করোনা দুনিয়ার গণমাধ্যম জগতকে খাদে ফেলেছে। জীবনের সঙ্গে আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করেছে সংবাদকর্মীদের। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইনসহ বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো এমন কঠিন সময়ে আর পড়েনি। করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন মালিকসহ সংবাদকর্মীদের অনেকে। মারাও গেছেন বেশ কয়েকজন। টেলিভিশনগুলোর অবস্থাও করুণ। পত্রিকাগুলোর সার্কুলেশনের সঙ্গে মার্কেটিংয়ে খরার টান। টেলিভিশনগুলোরও তাই। বলা বাহুল্য বিজ্ঞাপনই সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমের আয়ের বড় উৎস। সেখানে এক সঙ্গীন দশা।

এমন করুণ পরিস্থিতি গণমাধ্যমের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। করোনা গত দেড়-দুই বছরে সাংবাদিকতার তাল-লয় পাল্টে দিয়েছে। গোটা বিশ্বেই ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন জনপ্রিয়। অবস্থার অনিবার্যতায় ফেসবুক, গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তফাৎ প্যাঁচিয়ে গেছে। ফেসবুকের কোনো সম্পাদক না থাকায় এর কর্তৃপক্ষ নেই। জবাবদিহিতা নেই। দায়িত্বশীলতাও নেই। ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে ঘুরে বেড়ায় অনেক ফেক নিউজ, ভুল তথ্য, বিকৃত তথ্য। এই চাপে মূলধারার গণমাধ্যমও আক্রান্ত। তা পেশাদার গণমাধ্যমের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। কারো কারো মতে, হয়রানির শিকার হওয়ার পেছনে সাংবাদিকদের নিজেদেরও দায় আছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা নিয়ে শত শত অনলাই সংবাদ পোর্টাল চলছে। হাতেগোণা কিছু সংবাদ পোর্টাল বাদ দিলে বাকিদের বেশিরভাগই মূলত কপি-পেস্ট করে। এদের একটি অংশ উদ্ভট সব শিরোনাম দিয়ে ভুয়া ও হাস্যকর ‘সংবাদ’ প্রকাশ করে। এইসব অনলাইন পোর্টালের হালের নতুন উৎপাত আইপি টিভি। অনুমোদনহীন এসব আইপি টিভি এখন ইন্টারনেট দুনিয়া কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে।

ছোট-বড়, সাময়িক-দীর্ঘমেয়াদি মিলিয়ে নানা ধরনের সংকটকে সঙ্গী করেই চলতে হয় গণমাধ্যমকে। ইতিহাস তাই বলে। অন্যভাবে বলা হয়, সংকট বা দুর্গতি নিয়েই গণমাধ্যমের জন্ম। যুদ্ধ-মহামারিসহ কালে কালে নানা ধরনের সংকট-দুর্যোগ মোকাবেলা করেই টিকে ছিল সংবাদপত্র। সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে আগামীর পথচলার ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দেয়।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

সারাবাংলা/এসবিডিই

গণমাধ্যমে চ্যালেঞ্জ জয়ের নতুন অভিজ্ঞতা মত-দ্বিমত মোস্তফা কামাল

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর