খুলতে না খুলতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফের তালা, বেপরোয়া ছাত্রলীগ
৭ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৩৬
দেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড গজবের মতো জেঁকে বসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে না খুলতেই। বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনার ছোবল মন্থর হওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে বেকায়দায় পড়েছে কোনো কোনো দেশ। সেটা করোনার নতুন ধকলের কারণে। কিন্তু, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতটা ভিন্ন। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষসহ কিছু ক্রিয়াকর্মে সর্বশেষ বন্ধ হয়েছে খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। এর পরপরই তালা পড়েছে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের হোস্টেলগুলোতে। তালা কাণ্ডটা শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ-চমেক দিয়ে।
ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষের জেরে ৩০ অক্টোবর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় চমেক। ২৭ দিন বন্ধের পর তা খুলে দেওয়া হয়েছে। ছাত্রলীগের দুপক্ষের সংঘর্ষে এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহাদি জে আকিবের গুরুতর আহতের ঘটনা গোটা জাতিকে নির্মমভাবে নাড়া দিয়েছে। করোনার কারণে প্রায় পৌণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর খুলতে না খুলতেই এপ্রিলের শেষদিকে আবারও ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে দফায়-দফায সংঘর্ষে জড়ায়। এতে উভয়পক্ষের অন্তত পাঁচজন আহত হন। এই মেডিকেল শিক্ষার্থীরা সবাই দেশসেরা মেধাবী।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-কুয়েটের ঘটনা আরেক মাত্রার। এটি বন্ধ হয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে নাজেহালের পর কুয়েট শিক্ষক লালন শাহ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জেরে। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে অধ্যাপক সেলিম হোসেন কুয়েট ছাত্রলীগের বেশ কজন নেতা-কর্মীর মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। হলের লাভজনক পদ ‘ডাইনিং ম্যানেজার’ নির্বাচন নিয়ে ড. সেলিমকে কিছুদিন ধরে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। এক পর্যায়ে ওই শিক্ষককে আটকিয়ে তড়িৎ প্রকৌশল ভবনে তার ব্যক্তিগত রুমে নিয়ে আধাঘণ্টা রুদ্ধদ্বারে নাজেহাল করা হয়। এরপর ড. সেলিম হোসেন দুপুরের খাবারের জন্য বাসায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ-খুমেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক জানিয়ে দেন ‘হি ইজ নো মোর’।
এ ঘটনার রেশে আরো অস্থিতিশীলতার শঙ্কায় ৩ থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হলে তৎক্ষণাৎ প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থীকে তড়িঘড়ি হল ছেড়ে চলে যেতে হয়। আর তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়েছে ছাত্রলীগের ৯ জনকে। এ নিয়ে আরেক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি কুয়েটে। চমেক-কুয়েটের তুলনায় ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের ঘটনা কিঞ্চিত হালকা। বা কম গুরুতর। পরিস্থিতি কিন্তু কাছাকাছি। উপরোক্ত ৩টি ক্যাম্পাসেই অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। কারণ ছাত্রলীগ। আর সমাধান পুলিশ!
কেন এমন দানবীয় চরিত্রে ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনটি? এ নিয়ে মতামত ও বিশ্লেষণ প্রচুর। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংকট ও ক্রান্তিকালে এ দল ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ভূমিকা ইতিহাসের অংশ। ক্ষমতা ও সময়ের চক্রে সম্পদ উপার্জনে অধিক মনোযোগ ছাত্রলীগকে কেবল বেপরোয়াই নয়, নিয়ন্ত্রণহীনও করে তুলেছে। এই মহামারিও রুখতে পারছে না তাদের। নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বাড়ছেই। দল থেকে তাদের শাসানো হয়েছে বহুবার। ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে ২০০৯ সালের ৩ এপ্রিল সংগঠনটির সাংগঠনিক নেত্রীর পদ ছেড়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের ধমকিয়েই চলছেন। কিন্তু, গর্জন দৃষ্টে বর্ষণ নেই। কোথাও কোথাও মূল সংগঠন আওয়ামী লীগ নেতারাও জড়িত ছাত্রলীগকে বেপরোয়া করার পেছনে। এই বেপরোয়াপনায় নিজেদের হাতে নিজেদের লাশও পড়ছে। এর পেছনে রাজনীতি তেমন নেই। ক্ষমতার দাপট ও আর্থিক কারণই মূখ্য।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/ এসবিডিই
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ছাত্রলীগ মোস্তফা কামাল