আমাদের মুশতারী আপা— আত্মগোপন কমিউনিস্ট পার্টির পরম শুভার্থী
২৩ ডিসেম্বর ২০২১ ১৮:১৯
ভিত্তি ছিল দ্বিজাতি তত্ত্ব। তাতে ভর করে হিন্দু-মুসলিম গলা কাটাকাটি করে হাজার মাইলের ব্যবধানে গঠন করা হলো পাকিস্তান রাষ্ট্র। কমিউনিস্ট পার্টির ভাষায় ছিল ‘কৃত্রিম রাষ্ট্র’। পরিচালিত হতো জমিদার ভূ-স্বামী কায়েমি স্বার্থবাদী সামরিক ছাউনি থেকে। সেই রাষ্ট্র কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করে। চালায় চরম অত্যাচার নির্যাতন। সঙ্গে একের পর এক গ্রেফতার-হুলিয়া। এর মধ্যেই কমিউনিস্ট পার্টি আত্মগোপনে থেকে লড়াই সংগ্রাম পরিচালনা করতে থাকে।
‘বেআইনি’ অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টিকে আত্মগোপনে কাজ করতে হয়েছে নানা অত্যাচার-নিপীড়ন সয়ে। কঠিন ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে অনেক সুহৃদ শুভার্থী পার্টিকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। আশ্রয় দিয়েছেন। সহযোগিতা করতে গিয়ে অনেক শুভানুধ্যায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জীবনের ঝুঁকিতে পড়েছেন।
শ্রদ্ধেয় মুশতারী শফী আপার পরিবারও ছিল ‘বেআইনি’ আত্মগোপন কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ সুহৃদ শুভাকাঙ্ক্ষী। এরকম আরও অসংখ্য পরিবার ছিল সারাবাংলায়। জনারণ্যের অন্তরালে সে এক ভিন্ন ইতিহাস।
পাকিস্তানি হানাদার কবলিত চট্টগ্রাম শহরে প্রতিরোধ প্রস্তুতির এক পর্যায়ে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টির সংগৃহীত গোলা-বারুদ সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল খ্যাতিমান চিকিৎসক ডা. শফি সাহেবকে। এ ছিল ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব। যেকোনো মুহূর্তে বিপদ ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। কেমন করে পাকিস্তানি দালালরা তা জেনে যায়। যা হওয়ার তাই হলো। হানাদার বাহিনী সদলবলে ডাক্তার সাহেবের বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে পরিবার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। নৃশংসভাবে খুন করা হলো বেগম মুশতারী শফীর জীবনসঙ্গী ডা. শফি সাহেবকে। সঙ্গে খুন করা হলো মুশতারী আপার ছোট ভাইকে। এক পরিবারে দুইটি খুন। দু’জন শহিদ হলেন।
আরও পড়ুন-
শহিদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা নিয়ে চিরঘুমে শহিদজায়া
সেই থেকে আমাদের আপা বেগম মুশতারী শফী শহিদজায়া এবং শহিদভগ্নী। বেছে নিলেন লড়াই-সংগ্রামের বন্ধুর কঠিন জীবন। স্বাধীনতার পর মনকে শক্ত করে লড়তে লড়তে তিনি ৫০টি বছর পার করলেন। অসম সাহসে লড়েছেন জীবনের শেষ অবধি। জীবন সংগ্রামের অভিযাত্রায় বাংলাদেশও পা রাখল সুবর্ণজয়ন্তীতে।
বেদনায় নীল হয়ে ঘরে বসে থাকেননি শহিদজায়া মুশতারী। অসম সাহসে সংগ্রাম সংগঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। মহিলা পরিষদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। নারী আন্দোলনের সাহসী নেত্রী ছিলেন। সব অন্যায়-অত্যাচার নিগ্রহের বিরুদ্ধে সামনে থেকে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। শুধু তাই নয়, হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। লিখে গেছেন অবিরাম, যতদিন শক্তি সাধ্য ছিল— একেবারে জীবনের শেষ পর্যন্ত। কবিতা, গল্প, ছড়া, উপন্যাস, ইতিহাস, স্মৃতিকথা— কী লেখেননি! সৃজনশীল জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রেখেছেন। সঙ্গে গুছিয়েছেন নিজের সমস্যা জর্জরিত সংসার সন্তান।
শহিদজায়া মুশতারী ছিলেন চট্টগ্রাম তথা দেশের সুস্থ অসাম্প্রদায়িক ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম দিশারী। ছিলেন চট্টগ্রাম উদীচীর সভাপতি। একাত্তরের ঘাতক-দালালবিরোধী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে সামনে থেকে চট্টগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
শোষক-লুটেরা হার্মাদ দুবৃত্ত খুনি ধর্ষকের বিরুদ্ধেও ছিলেন তিনি সদা সোচ্চার। এদের ঘৃণা করতেন। আপাত সুবিধার জন্য কোথাও নিজের শহিদ জীবনসঙ্গী ও ভাইকে অপমান করেননি কখনো। ইস্পাত কঠিন নৈতিকতা নিয়ে আপসহীন জীবন অতিবাহিত করেছেন। সুবিধাবাদ অনৈতিকতা তাকে গ্রাস করতে পারেনি।
প্রয়াণের মাত্র দেড় মাস আগে অসুস্থ শরীর নিয়েও মুশতারী শফী ছুটে এসেছিলেন সম্প্রতি পূজা মণ্ডপসহ সারাদেশে নৃশংস সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ও হত্যার প্রতিবাদ জানাতে। চট্টগ্রামের ডিসি হিল পার্কে আয়োজিত বিক্ষোভ-সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন।
কোথায় ছিলেন না শহিদজায়া মুশতারী শফী। যেখানে অন্যায়-অত্যাচার-অবিচার, অসভ্যতা-অনাচার, হত্যা-ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতা, খুন, অসাম্য-বৈষম্য, নিপীড়ন-নির্যাতন-দুর্বৃত্তপনা দেখেছেন, সাহসের সঙ্গে ছুটে গেছেন আমাদের প্রিয় মুশতারী আপা। কুণ্ঠাহীন চিত্তে দাঁড়িয়েছেন নিপীড়িত-নিগৃহীত নারীসহ সাধারণ মানুষের পাশে। একটি শোষণমুক্ত সুখি-সুন্দর বাংলাদেশ ছিল তার সব সংগ্রামের আলোকিত অধ্যায়।
শহিদ ডাক্তার শফি সাহেবের জীবনদানকে মহিমান্বিত করেছের ৫০ বছর ধরে, রাজপথে সাহসী সংগ্রাম করে করে। সাহস জুগিয়েছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। ছিলেন কঠিন কঠিন লড়াইয়ের উৎসাহের ভরসাস্থল।
দেশমাতৃকার বেদীমূলে উৎসর্গ করেছেন তিনি নিজের সমগ্র জীবন সংগ্রামকে। অমূল্য জীবনকে। সাহসী নেত্রী বেগম মুশতারী শফী। স্বাধীনতার সূর্যকন্যা।
সার্থক জনম তার। সালাম, প্রণাম আপা। আপনাকে মনে থাকবে অনেক অনেক দিন।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চট্টগ্রাম জেলা
সারাবাংলা/টিআর