ক্ষণজন্মা এক লড়াকু নেতা
১৭ মার্চ ২০২২ ১৪:০০
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষণজন্মা লড়াকু নেতা। বাঙালির আপসহীন এই নেতার আবির্ভাব না হলে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। তারই বজ্রকন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহবান। বাঙালি জাতির চেতনাকে, ভেতরের সুপ্ত শক্তিকে অভূতপূর্ব যাদুতে নাড়া দিয়েছিলেন এই মহান নেতা। তিনি আমাদের মাঝে সময়োপযোগী আত্মপোলব্ধির উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাঙালি জাতিকে বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী। আজ বাঙালি জাতির অপার আনন্দের দিন। বাংলাদেশের খুশির দিন। বঙ্গবন্ধু যখন বেঁচে ছিলেন তখন জন্মদিন পালন করেছেন শিশুদের নিয়ে। শিশুদের সঙ্গে গল্প করতেন। খেলা খেলতেন। তিনি শিশুদের খুব আদর, স্নেহ করতেন। ভালোবাসতেন। শিশুদের নিয়ে তার ছিল অনেক স্বপ্ন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত। আগামীতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দেবে শিশুরা। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে তাই জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম নেওয়া শেখ মুজিব ১৯৪৭–এ দেশভাগের পর থেকে বাঙালিদের প্রতি তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের কল্পনাতীত বৈষম্যমূলক আচরণ, অবর্ণনীয় অত্যাচার আর অকথ্য দুর্ব্যবহার, নিপীড়ন, শোষণ এবং দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের দাবি আদায়ের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ধাঁচের রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার উদাত্ত আহ্বান এসেছিল এই মহান বীরের কাছ থেকেই। ১৯৫২–এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪–এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২ সালের শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ৬৬ সালের বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ ৬ দফা, ৬৮–এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯–এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০–এর নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয় ইত্যাদি সম্ভব হয় তার নেতৃত্বে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগেই বাংলার আপামর জনসাধারণ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘জাতির পিতা’ খেতাবে ভূষিত করে। কোথায় নেই বঙ্গবন্ধুর পদচারণ? ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই ঐতিহাসিক কালজয়ী ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…জয় বাংলা’—উদ্দীপ্ত বক্তব্য পুরো বাঙালি জাতিকে এক অবিস্মরণীয় শক্তিতে উদ্দীপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহসী করে তোলে। সেই ঐতিহাসিক ভাষণ তরঙ্গায়িত হয়ে পৌঁছে যায় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে মূলমন্ত্র এবং অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রেরণা হিসেবে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বাংলার জনতা। যার ফলে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম দেশ—বাংলাদেশ। আমাদের গৌরব ও অহংকারের বাংলাদেশ। গবেষকরা বলেন, যদি ১৬ ডিসেম্বর পরাজয় স্বীকার না করে পাকিস্তানি সেনারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতো, তাহলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেই ৯৩ হাজারের কেউ আর জীবিত পাকিস্তানে ফেরত যেতে পারতো না। অথচ পৃথিবীর ইতিহাসে এতো বৃহৎ সংখ্যক প্রশিক্ষিত সৈন্য দিয়ে গঠিত একটি বাহিনী ঘটা করে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অপর একটি অপেশাদার মুক্তিবাহিনীর নিকট নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। এমন নজির বিশ্বের বুকে আর কোনো দেশে নেই।
বঙ্গবন্ধুর ৮টি জন্মদিন কেটেছে কারাগারে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে নানা প্রহসনমূলক মামলায় বিনা বিচারে ১৩ বছর ৯ মাস বঙ্গবন্ধুকে কারাবরণ করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম ১৯৫০ সালে তার ৩১তম জন্মদিন কারাগারে কাটান। পাকিস্তান সরকার তাকে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি বন্দি করে। টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে কাটিয়ে তিনি মুক্তি পান ১৯৫২ সালে। ওই একই দফায় বন্দিদশায় ১৯৫১ সালে তার ৩২তম জন্মদিনও কাটে জেলে। এরপর আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে ১৯৫৮ সালের ১১ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে টানা ১১৫৩ দিন বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে কাটাতে হয়। গ্রেফতারের ১৪ মাসের মাথায় তিনি মুক্তি পেলেও সেদিনই কারা ফটকে আবারও গ্রেফতার হন। এ সময় তার ৪০তম (১৯৫৯ সাল), ৪১তম (১৯৬০) ও ৪২তম (১৯৬১) জন্মদিন কাটে জেলখানায়। ওই দফায় ১৯৬১ সালের শেষ দিকে মুক্তি পাওয়ার কয়েক মাসের মাথায় ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি তিনি ফের গ্রেফতার হন এবং মুক্তি পান একই বছরের ১৮ জুন। এ কারণে ৪৩তম (১৯৬২) জন্মদিনও তাকে জেলে কাটাতে হয়। এরপর ১৯৬৭ সালে ৪৮তম এবং ১৯৬৮ সালে ৪৯তম জন্মদিনও জেলখানায় কাটে বঙ্গবন্ধুর।
বঙ্গবন্ধুর জেল জীবনের ডায়েরি নিয়ে ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর একটি জন্মদিন কাটানোর বিবরণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর মুক্ত জীবনের জন্মদিনগুলো ঘটা করে পালন করা না হলেও ১৯৬৭ সালের জন্মদিনটা কিছুটা আওয়াজ দিয়েই পালন কার হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ তার ৪৮তম জন্মদিনটা কেমন কেটেছিল বা জন্মদিনে তার দল আওয়ামী লীগ কী কর্মসূচি পালন করেছিল? জাতির পিতা তা অকপটে তুলে ধরে ডায়েরির পাতায় লিখেন, জন্মবার্ষিকী তিনি কোনো দিনই নিজে পালন করেননি। বেশি হলে তার স্ত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা ওই দিনটাতে তাকে ছোট্ট একটি উপহার দিতেন। বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করতেন জন্মদিনের দিনটিতে বাড়িতে থাকতে। ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী পালন করেছে বলে খবরের কাগজের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন বলে ডায়েরিতে উল্লেখ করেন তিনি। ওইদিন জেলখানায় আটক তার দলের নেতারা জন্মদিন উপলক্ষে তাকে গোলাপ, ডালিয়াসহ নানা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান বলেও উল্লেখ করেন। এছাড়া বিকেলে স্ত্রী ও সন্তানেরা ফুলের মালা ও অন্য একজনের পাঠানো কেক নিয়ে আসেন। এছাড়া ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগও বঙ্গবন্ধুর জন্য একটা বিরাট কেক ওইদিন পাঠিয়েছিল বলে ডায়েরিতে উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধুর মতে, ‘জেলে থাকার কারণেই ওই বছর এমনটি হয়েছিল।’ দল জন্মদিন পালন করেছে দেখে তিনি হেসেছিলেন বলেও ডায়েরিতে উল্লেখ করেন। জন্মদিন পালনের বিষয়টিকে তিনি ডায়েরিতে উল্লেখ করেন এভাবে, ‘আমি একজন মানুষ, আমার আবার জন্মদিবস!’ এমন সহজ সরল কথার মানুষ বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর চিন্তাচেতনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল জনগণ। নিজের জন্মদিন বা মৃত্যু নিয়ে ভাবার সময় তার ছিল না। তবে একাত্তরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন উপলক্ষে বায়তুল মোকাররম মসজিদে আছর নামাজের পর বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘায়ু কামনা করে মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন মাওলানা শেখ মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ বিন সায়িদ জালালাবাদী। পরের দিন ১৮ মার্চ দৈনিক পূর্বদেশ, ইত্তেফাক ও আজাদ পত্রিকায় এ সংক্রান্ত সংবাদ ছাপা হয়। মাহমুদ হাসানের ‘দিনপঞ্জি একাত্তর’ এবং ড. মোহাম্মদ হান্নানের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থেও একাত্তরের ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন সংক্রান্ত এ বিবরণ পাওয়া যায়।
১৯৭১ সালে শত্রুরা পরাজিত হলেও তারা বসে থাকেনি। তাদের ষড়যন্ত্র তখনও থেমে থাকেনি। ঘাতকরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যসহ আরও অনেককে হত্যা করে। বাঙ্গালি জাতির জীবনে নেমে আসে এক অন্ধকার অধ্যায়ের। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে অন্ধকারে পতিত হয় দেশ। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ হয়ে পড়ে অভিভাবকহীন–পরিচয়বিহীন এতিম দেশ। কলঙ্কিত হয় জাতি। লজ্জায় ডুবে মানবতা। ইতিহাস যেন আবার ঘুরে যায় পেছনের দিকে। সেই ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের বিষয়টাই যেন মুখ্য হয়ে উঠে। ‘আমি আমার দেশের মানুষদের একটু বেশিই ভালোবাসি। এটাই আমার দুর্বলতা।’ তা না হলে তিনি দেশের একজন রাষ্ট্রপতি হয়েও নিজের এবং পরিবারের কোনোরূপ নিরাপত্তার ব্যবস্থা আগে থেকেই কেনো নেননি? বঙ্গবন্ধুকে কেনো মাত্র অল্প সময়েই চলে যেতে হলো? বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন কেন এতো বড় একটা আঘাত পেলো? এসব প্রশ্ন এই প্রজন্মের গবেষক ও বিশ্লেষকদের ভাবিত করে। আহমদ ছফা যথার্থই লিখেছেন, ‘একজন ব্যক্তির শারীরিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক মিশনকে হত্যা করা যায় না। কারণ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে; কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই।’ দেশের মানুষ অনুধাবন করতে পারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নস্যাৎ করে দেশে পাকিস্তানি ভাবধারা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই স্বাধীনতা বিরোধীতাকারী এবং সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য, দেশি–বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা মিলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধ্বংস করা এবং এই দেশকে বিশ্ব দরবারে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করে তোলা।
বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই আমরা বাঁচতে শিখেছি, হাসতে শিখেছি, স্বাধীনতার কথা বলতে শিখেছি। তার জন্ম না হলে আজও বাঙালি জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতো। জাতির জনকের কাছে বাংলাদেশের সকল মানুষ ঋণী। বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে আমরা একটি সুখী সুন্দর সোনার বাংলা অনেক আগেই অর্জন করতে পারতাম। বিজয় অর্জনের পর সরকার গঠন করে তিনি একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে যেভাবে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটাই তার প্রমাণ বহন করে। স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তি এবং তাদের দোসররা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে সেই পথ রুদ্ধ করে দেয়। অথচ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরি তারই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে দেশ আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আগের মতো আর ভিন দেশের কাছে ধারদেনা, দান খয়রাতের অপেক্ষায় নেই বাংলাদেশ। পৃথিবীর বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি গৌরবের বাংলাদেশ। জন্মবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রজন্মের বিনম্র শ্রদ্ধা। আসুন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনাকে শক্তিতে পরিণত করে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে উজ্জীবিত হই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই