শিক্ষিত মানুষের অশিক্ষিত স্বভাব
৩১ মার্চ ২০২২ ১৭:৫৫
শৈশবে আমরা যখন নিজের খেলনার চেয়ে বন্ধুর খেলনাটা সুন্দর হলে তা সহ্য করতে পারতামনা বা সমবয়সী কাউকে প্রশংসা করা হলে মনে-মনে জ্বলে উঠতাম; তা ছিল আসলে আমাদের ভিতরজাত সমস্যা। কারণটা হলো, মানুষ জন্মগতভাবে সভ্য হয়ে পৃথিবীতে আসেনা। হিংসা, লোভ, ক্রোধ, অহম, কামাকাংখা, দম্ভ প্রভৃতি সহজাত দোষ নিয়ে আসে। শিক্ষা ও সামাজিকতার মাধ্যমে এই ভিতরজাত সমস্যাগুলোকে উপড়িয়ে মনুষ্যত্ববোধের আলো বের করে আনতে পারলেই “প্রাণী মানুষ হয় প্রকৃত মানুষ”। পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক; এর যেকোনো উপায়েই মানুষ এ শিক্ষাটা পেতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমরা অনেকেই শিক্ষিত/উচ্চ শিক্ষিত হয়েও এই সমস্যাগুলোকে সমূলে উপড়ে ফেলতে পারিনা। কারণ, ঐদিকে আমাদের মনোযোগ থাকে না; আমাদের মনোযোগ থাকে বহির্জাত বৈভবের দিকে। যে শিক্ষা মানবিক গুন প্রজ্জ্বলিত করে; তা আসে প্রধানতঃ সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক শিক্ষা থেকে। এই শিক্ষা আমাদের ভিতরে ত্যাগ, ধৈর্য, উদারতা ও সততার মতো নানান গুণের বাতি লাগিয়ে দেয়; আর বাতিগুলো ভিতরের সহজাত অন্ধকারগুলোকে বের করে দেয়। সাধারণতঃ আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এই বাতিওয়ালা শিক্ষা থাকেনা; নিজ উদ্যোগে তা শিখতে হয়। কেউ কেউ বই না পড়েও ঐরকম আলোকিত শিক্ষায় শিক্ষিতদের সংস্পর্শে গিয়ে আলো পেয়ে যায়। আবার কেউ কেউ শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির শিক্ষক/শিক্ষার্থী হয়েও ঐ আলো ধারণ করতে পারেনা, কারণ তাদের মনোযোগ থাকে ক্ষুৎ পিপাসাজাত জৌলুসের দিকে। অর্থাৎ নিজের ভিতরে আলো জ্বালানোর ইচ্ছা যদি কারো না থাকে তবে সেখানে আলো জ্বলবেনা। আরেকটা কথা, অনেক ক্ষেত্রে স্বল্পশিক্ষা ভিতরজাত সমস্যাগুলোকে বাড়িয়ে দেয়। নজ্রুল-রবীন্দ্রনাথদের মতো যারা; তারা ব্যাতিক্রম। তারা স্বল্পশিক্ষিত হলেও স্বশিক্ষা/সাধনার মাধ্যমে অন্তরে আলো জ্বালিয়ে থাকেন। স্বল্পশিক্ষিতদের কেউ কেউ দম্ভ ও অহংকারের আগুনে জ্বলতে গিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। এসব আমাদের জানা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যেও এমন সমস্যাগ্রস্ত মানুষ দেখা যায়। এমন কিছু গল্প আজকের লেখায় তুলে ধরা হবে। গল্পগুলো সমাজ থেকে তুলে নেয়া কিন্তু কাল্পনিক। চলুন গল্পে যাই।
১। সলিম ও কলিম নয়নপুর স্কুলে একসাথে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করে। ঐপর্যন্ত সলিম ছিল ক্লাশের ফার্স্ট বয় আর কলিমের স্থান থাকতো বিশেরও পরে। সলিম ষষ্ঠ শ্রেনীতে ঢাকায় এসে ভর্তি হয়। কলিম গ্রামেই থাকে। হঠাৎ করে ক্লাশ সেভেনে উঠে কলিমের মধ্যে মনোযোগ আসে এবং এই মনোযোগ ধরে রেখে সে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় পর্যন্ত চলে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কলিম তার বাল্যবন্ধু সলিমকে তারই বিভাগের বন্ধু হিসেবে পায়। কলিম প্রায়ই কথা বলতে চায়। কিন্তু সলিম কলিমকে এড়িয়ে যায়। কারণ সলিমের মধ্যে প্রাইমারি স্কুলের সেই দম্ভ এখনো কাজ করে যখন কলিম ছিল খারাপ ছাত্র আর সলিম ফার্স্ট বয়। কলিম অনার্সে ফার্স্ট হয়ে যায়; সলিম হিংসায় জ্বলে উঠে। শেষে কলিম হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর সলিম তার নিজের গ্রামের সেই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। সলিমের জ্বলুনি এখনো চলমান।
২। অধ্যাপক ডঃ আজমল খান নির্জনপুর গ্রামের প্রথম ব্যাক্তি যিনি বুয়েটে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং শিক্ষক হয়েছিলেন। আজমল খান যখন বুয়েটে পড়েন তখন তাদের বাড়িতে জমিলা নামে একজন বিধবা কাজ করত। মোহন নামে সেই মহিলার তিন চার বছরের একটা বাচ্চা ছিল। এই মোহন বড় হয়ে পড়াশুনা করে বুয়েটে আজমল সাহেবের বিভাগেই ভর্তি হয়। সব শোনার পর আজমল সাহেব হিংসায় জ্বলে উঠলেও চোরা হাসি দিয়ে তা চেপে রাখেন। অধ্যাপকের পরামর্শে মোহন হলে না উঠে তার বাসায়ই উঠে। কিন্তু মোহন দেখলো এখানে তাকে অনেক কাজ-কর্ম করতে হয়; তদুপরি আজমল সাহেব লোকদের সাথে এমন ভাব করেন যেনো তার কারনেই মোহন বুয়েটে চান্স পেয়েছে; তার দয়াতেই ঢাকায় আছে। মোহন বুঝে যায় ষড়যন্ত্র; অতিসত্বর বাসা ছেড়ে হলে উঠে। মোহন অনার্সে ফার্স্ট হয়। এই খবরটা অধ্যাপক আজমলের হিংসার আগুন বাড়িয়ে দেয়। ফার্স্ট ইয়ারে মোহন যখন ওনার বাসায় থাকতো তখন বলতেন মোহন তার দুঃসম্পর্কের আত্নীয়। এরপর থেকে তিনি বলে আসছেন মোহন তার কাজের বুয়ার ছেলে এবং ওনার কারনেই সে আজ বুয়েটে। মাস্টার্সেও মোহন ফার্স্ট হয়। কিন্তু আজমল সাহেবের কুটনামির কারণে বুয়েটের শিক্ষক হতে পারেনি। মোহন স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে চলে যায় এবং সেখানেই শিক্ষকতার সুযোগ পায়। আজমল সাহেব বলে বেড়ান আমাদের কাজের বুয়ার ছেলেটা এখন এমআইটি’র শিক্ষক।
৩। একই গ্রামের দরিদ্র ও কুৎসিত ছেলে কামাল এবং ধনীর দুলাল ও সুদর্শন ছেলে জামাল একই স্কুলে একই শ্রেনীতে পড়ে। কামাল ফার্স্ট বয় আর জামাল খারাপ ছাত্র। এ নিয়ে সহজ সরল কামালের প্রতি দাম্ভিক জামালের হিংসার আগুন জ্বলে। যাইহোক, বড় হয়ে কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর জামাল চতুর্থ গ্রেডের একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। জামালের পড়াশুনায় মন নাই। গার্লফ্রেন্ডের পরামর্শ ও সহযোগিতায় জামাল সিনেমার নায়ক হয়ে যায় এবং অতি দ্রুতই সেলিব্রিটি বনে যায়। কামাল জামালের খবরে খুশী হয় এবং মনে মনে ভাবে এবার সাংস্কৃতিক পরিবেশে থেকে ও একটু উদার হবে। কিন্তু কিসের কি! হয় উল্টোটা। একদিন জামাল ফেসবুকে লিখে – ডায়রিয়া হয়েছে। পাদে দুর্গন্ধ; কি করবো? এই স্ট্যাটাসে লাইক পড়ে ৫৯৫ হাজার আর কমেন্ট ২৫ হাজার। ঠিক সেদিনই কামালের একটা গবেষনা প্রবন্ধ বিশ্বখ্যাত জার্ণাল লান্সেটে প্রকাশ পায়। কামাল ফেসবুকে ঐ প্রবন্ধটার লিংক দিয়ে দেয়। এতে লাইক পড়ে মাত্র ৫টা; কমেন্ট নাই। এ নিয়ে কামালের মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু জামালের দম্ভের ঠেলায় পা মাটিতে পড়েনা!
৪। আকবর সাহেব ও আসগর সাহেব দুজনই শিক্ষিত এবং চাকুরি করেন একই কোম্পানীতে। এদের আরেকটা মিল হলো দুজনেই ফেসবুকে সময় দেন। আকবর সাহেব নিউজফিডে ভালো কিছু দেখলেই লাইক দিয়ে দেন, পোষ্টদাতা তার শত্রু হলেও তিনি তা করেন; এতে তার উদারতা প্রকাশ পায়। অন্যদিকে আসগর সাহেব শুধু অন্যের লাইকের আশা করেন, অন্যের স্ট্যাটাস ভালো হলেও লাইক দেন না। কারন অন্যের ভালো কিছু দেখলে তার ভিতরে জ্বলে। এই জ্বলে উঠার মাধ্যমে আসগর সাহেবের ভিতরের হিংসা, দাম্ভিকতা ও কুপমন্ডুকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
৫। আনোয়ার ও সানোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই তরুন। আনোয়ার পরোপকার করে আনন্দ পায়। অন্যদিকে সানোয়ার নাম, যশ, অর্থ ও পদবী লাভ করাকেই জীবনের ব্রত মনে করে। আনোয়ার অনার্স এবং মাস্টার্স উভয়টাতেই প্রথম শ্রেনীতে উত্তীর্ন হয়; কোথাও চাকুরীর আবেদন না করে নিজে একটা স্বাচ্ছাসেবী সংগঠন দাড় করায়। অন্যদিকে সানোয়ার ক্লাশের পড়াশুনা বাদ দিয়ে বিসিএস নিয়ে ব্যস্ত থাকে; দুটোতেই কোনোমতে দ্বিতীয় শ্রেনীতে উত্তীর্ন হয়। তবে বিসিএস পরীক্ষায় ভালো করে এবং দ্রুতই বড় সরকারী কর্মকর্তা বনে যায়। আনোয়ার তার সংগঠন থেকে দেশের মানুষের জন্য অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নে করে যায় যা সানোয়ারের চিন্তায়ও আসেনা। অন্যদিকে সানোয়ার তার পদবী কাজে লাগিয়ে গাড়ী-বাড়ি-নারী অর্জনে ব্যাস্ত থাকে। কিন্তু ফেসবুকে আনোয়ার ও সানোয়ারের অবস্থা সেই কামাল ও জামালের মতো। কারণ মনে মনে ঘৃণা করলেও এ সমাজের অধিকাংশ মানুষ সানোয়ারের মতোই হতে চায়।
৬। লাবু ও সাবু দুই বন্ধু। লাবু সৃজনশীল, সাবু নকলবাজ। কলেজ পর্যন্ত লাবু সাবুর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পর সাবু চালবাজি-নকলবাজি করে অনার্স ও মাস্টার্স উভয়টাতে প্রথম হয়ে যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বনে যায়। এরপর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র শিক্ষকের থিসিস নকল করে পিএইচডিও করে ফেলে সাবু। ঐদিকে লাবু একটা বড় দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক ও কলামিষ্ট। এতকিছু পেয়েও পত্রিকায় লাবুর কলাম দেখলে সাবুর ভিতরে হিংসার আগুন জ্বলে। একবার দেশের একটা বড় কোম্পানীর মালিকানাধীন জনপ্রিয় একটা দৈনিকে সম্পাদক হিসেবে জয়েন করার অফার পায় সাবু। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন বছরের ছুটি নিয়ে সানন্দে দায়িত্বটা গ্রহণ করে। সাবুর একান্ত ইমেইল বরাবর মাঝে মাঝে নতুন লেখকদের অনেক ব্যাতিক্রমধর্মী ও অসাধারণ লেখা আসে। সাবু সেগুলো রেখে দেয় এবং ছয়-সাত মাস পর পর লেখার শিরোনাম বদলিয়ে নিজের নামে ছাপিয়ে দেয়। অধ্যাপক সাবু এবার কলামিস্ট হিসেবে দেশজোড়া খ্যাতি পায়। যাইহোক, হঠাৎ একদিন এক নতুন লেখক তার লেখা বুঝতে পেরে সাবুর নামে মামলা করে দেয়। সাবু ফেঁসে যায়। ডিবি পুলিশ সাবুর পুরানো ইতিহাস ঘাঁটতে শুরু করে। পত্রিকার সব লেখা, সেই নকল থিসিস, নকল এসাইনমেন্ট সব বের হয়ে আসে একে একে!!
৭। অধ্যাপক নকুল কান্তি বিশ্বাস তার এক ছাত্রের কাছ থেকে ফেসবুক হ্যাকিং এর নিয়মটা শিখে নিয়েছিলেন। এই লকডাউনে তার এখন বড় নেশা হলো কোন ছাত্র কোন ছাত্রীর সাথে প্রেম করছে এবং প্রাইভেট মেসেঞ্জারে তারা কি ধরনের বিশ্রী বিশ্রী কথা, ছবি ও পর্ণ লিংক চালচালি করছে তা গোপনে দেখা। এভাবে অন্যদের প্রাইভেট জিনিস দেখা এখন তার নেশা। আর এইসব দেখতে দেখতে তার পড়াশুনা-গবেষনা সব চুলোয় গ্যাছে। ডিজিটাল যুগের আগেও অন্যের বিষয়ে নাকগলানো চমক কান্তির অভ্যাসের মধ্যে ছিল বৈকি!
৮। মিলু ও দেলু বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে রাজনীতি করতো। পরে মিলু যায় সাংবাদিকতায় আর দেলু রাজনীতি ও ঠিকাদারী ব্যবসায়। মিলুর সাথে দেশের সব সেলিব্রিটিদের উঠাবসা এবং দেলুর সাথে মন্ত্রী/ এম, পিদের বেশ খাতির। কিন্তু ওদের কোন বন্ধু যদি কোন দরকারে কোন মন্ত্রী/এম।পি বা সেলিব্রিটির সাথে দেখা করিয়ে দেয়া বা ফোন নাম্বার দিয়ে সহযোগিতা করার কথা বলে, ওরা তখন ঐ বন্ধুর ফোন ধরা বন্ধ করে দেয়। অনন্যোপায় হয়ে কারো নাম্বার দিয়ে দিলে পরে আবার নাম্বারওয়ালার কাছে ফোন করে বলে দেয় “অমুক নাম্বারের কেউ আপনাকে ফোন করে ডিস্টার্ব করতে পারে, ধরবেননা ফোন!” ওদের ধারণা নাম্বার পাওয়ার মাধ্যমে ঐ বন্ধুটি/বন্ধুরা কোন বড় ধরণের সুবিধা পেয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, সহযোগিতায় যে শান্তি তা উপলদ্ধি না করে বরং অসহযোগিতা করে বা গিরিঙ্গি বাঁধিয়ে কাউকে লটকিয়ে রাখাতে ওরা নষ্ট আনন্দ পায়।
৯। সৈয়দ শাহ সাহেব একটা কলেজের প্রিন্সিপাল। পারিবারিকভাবে ধনী। স্বভাবে চুপচাপ ও দানশীল। একবার কলেজের ধর্ম শিক্ষক করম আলীর স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে অনেক টাকার দরকার হলো। প্রিন্সিপাল সাহেব যেচে ধর্ম শিক্ষককে ডেকে এনে সব টাকা দিলেন। ধর্ম শিক্ষক ধরে নিলেন ধর্ম পড়ানোর কারনেই প্রিন্সিপাল সাহেব তাকে এই সুযোগটা দিয়েছেন। তাই নিজেকে একটু ক্ষমতাবান ভাবতে শুরু করলেন। বিশেষ করে বাংলা শিক্ষক যাকে তিনি নাস্তিক মনে করেন; তাঁকে তো পাত্তাই দেন না অবস্থা! এর তিন মাস পর বাংলা শিক্ষকের এক বাচ্চা অসুস্থ হলো যার চিকিৎসায় ধর্ম শিক্ষকের স্ত্রীর চিকিৎসার চেয়ে দ্বিগুন টাকা লাগলো। প্রিন্সিপাল সাহেব বাংলা শিক্ষককেও চিকিৎসার সব টাকা দিলেন। ধর্ম শিক্ষক রেগে আগুন হয়ে গেলেন। এবার প্রিন্সিপাল সাহেবকেও নাস্তিক ভাবতে শুরু করলেন।
১০। ইঞ্জিনিয়ার শরীফ কাদের স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তার ডেভেলপার কোম্পানী এস, কে বিল্ডার্স এর ব্যাবসা মুখ থুবড়ে পড়ে। তাঁর ছেলে ইঞ্জিনিয়ার সালমান কাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ব্যবসার হাল ধরার জন্য অনুরোধ করা হয় কিন্তু সে আসেনি। তার পাশের বাড়ির নাইমুল হক নামে একটা ছেলে বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দেশের নামীদামী কয়েকটা বিল্ডার্স কোম্পানীতে প্রায় দশ বছর ধরে কাজ করছে। নাইম ভাবলো পাশের বাড়ির আংকেল শরীফ কাদেররের ব্যাবসাটাকে সে চাইলে চাঙ্গা করতে পারে যদি শরীফ কাদের তাকে পার্টনার হিসেবে নিয়ে ব্যবসার অর্ধেক দিতে রাজী থাকে। শরীফ কাদের রাজী হয়ে গেল। নাঈম এস,কে বিল্ডার্স এর দায়িত্ব নিল। দেড় বছরের মাথায় ব্যাবসা চাঙ্গা হয়ে উঠলো। কিন্তু হঠাৎ শরীফ কাদেরের মনে হিংসা ভর করলো; সে নাঈমকে পার্টনার হিসেবে না রেখে এমপ্লয়ী হিসেবে থাকার প্রস্তাব দিল যা নাঈমের চলমান আয়ের তিন ভাগের এক ভাগের সমান। নাঈম রাগে ক্ষোভে অন্য কোম্পানীতে গিয়ে জয়েন করলো। লোভী ও হিংসুক শরীফ কাদেরের ব্যবসা আবার মুখ থুবড়ে আগের জায়গায় গিয়ে পড়লো।
১১। আরমান স্বপ্ন দেখেছিল সে বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে গরীব মানুষের সেবা করবে। চেষ্টানুযায়ী সে ডাক্তার হয়। বিসিএস এ উত্তীর্ণ হওয়ার পর একটা মফস্বলে তাঁর পোস্টিং হয়। কিন্তু ছয়মাস না যেতেই সে তার বন্ধুর পরামর্শে ঘুষ দিয়ে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় একটা ব্যস্ত সরকারী হাসপাতালের ইমার্জেন্সী বিভাগে সে দায়িত্ব পায়। এখানে অনেক রোগী আসে ভর্তি হওয়ার জন্য কিন্তু ঘুষ ফিস না হলে সবার ভর্তি মিলেনা। আরমান প্রথম কয়েকদিন এমনি এমনি যাদের ভর্তি দরকার তাদের দিয়ে দিল। কিন্তু একদিন তার দুই পিয়ন তাকে বুদ্ধি দিলো “স্যার মফস্বল থেকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে ঢাকায় আসলেন , তা কি তুলবেন না? আপনি তো বোকা দেখছি! আরমান হাসলো এবং পরদিন থেকে ঘুষ নিতে শুরু করলো। তিন বছর বাদে আরমান একটা প্রাইভেট হসপিটালে চেম্বার নিয়ে রোগী দেখতে শুরু করলো। ঐ হাসপাতালের ডাক্তারদের একটা সমিতি আছে, তারা সবাই টাকা জমাচ্ছে ঢাকায় বড় একটা হাসপাতাল বানানোর জন্য । আরমান সে সমিতিতে জয়েন করলো। ঐদিকে তার স্ত্রী আবার স্বপ্ন দেখছে একটা ফ্লাট কেনার। আরমান দেখলো সব মিলিয়ে প্রতিদিন তাকে কম পক্ষে ত্রিশ হাজার টাকা ইনকাম করতে হবে। আরমান টাকার পিছনে ছুটলো।, গরীব মানুষকে চিকিৎসা দেয়ার স্বপ্ন চুলোয় গেল।
গল্প আরো আছে! আজ এ পর্যন্তই থাক।
সলিম, আজমল, জামাল, আসগর, সানোয়ার, সাবু, চমক কান্তি, মিলু-দেলু, করম আলী, শরীফ কাদের ও আরমানরা শিক্ষিত হয়েও অশিক্ষত স্বভাবের চর্চায় লিপ্ত আছে; তাই তারা সমাজের আবর্জনা। আমরা এমন শিক্ষিত মানুষবিহীন বিশ্ব দেখার অপেক্ষায় আছি। এই জনমে না হোক, হাজার বছর পরে হলেও সেই সময়টা দেখতে আবার ফিরে আসতে চাই।
লেখক: জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মত-দ্বিমত রাশেদ রাফি শিক্ষিত মানুষের অশিক্ষিত স্বভাব (দ্বিতীয় সংস্করণ)