মানুষ তবে যাবে কোথায়!
১৬ এপ্রিল ২০১৮ ১৭:৩২
।। কবির য়াহমদ ।।
গত ক’দিনে নানা ঘটন-অঘটনের পরিপ্রেক্ষিতে হবিগঞ্জের আলোচিত বিউটি আক্তারের ধর্ষণ ও খুন রহস্য অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। এরমধ্যে অবশ্য বিউটি আক্তারের ধর্ষণ ও খুন রহস্যের একটা অধ্যায়ের উন্মোচন হয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানা গেছে খুনের সঙ্গে জড়িত তার বাবা-চাচা। আর ধর্ষণে জড়িত বাবুল মিয়া যাকে প্রথম থেকে উভয় ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল। খুনের ঘটনায় বাবার সম্পৃক্ততার খবর ধাক্কা দিয়েছে সামাজিক সত্তাকে, কারণ সকল নিপীড়নের শিকার মানুষজন সর্বশেষ আশ্রয় ভাবে পরিবারকে। আর এখানে আস্থার জায়গার এমন রূপ আচমকা বজ্রপাতের মত ঠেকেছে সুস্থ চিন্তার মানুষদের। তবু আপাত বাস্তবতা হলো কন্যার খুনে পিতাও জড়িত, জড়িত চাচা সহ পরিবার।
বিউটি হত্যায় পিতা সায়েদ আলীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির তথ্য প্রকাশ করেছেন হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরা। তাতে দেখা যাচ্ছে বাবা-চাচার পরিকল্পনায় ভাড়াটে খুনির মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। উদ্দেশ্য দুই- প্রথমত রাজনৈতিক; দ্বিতীয়ত পরিবারের কথিত সম্মান রক্ষা। এই সম্মান রক্ষার বিষয়টির কাছে পরাজিত হয়ে গেছে রক্তের সম্পর্ক, জিঘাংসার চরম প্রকাশ ঘটেছে রাজনৈতিক অভিলাষে।
হত্যার যে দুই উদ্দেশ্য এবং বাবা-চাচার সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে চাচার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা রয়েছে, যার প্ররোচনায় পিতাও কন্যার হন্তারকের ভূমিকায় নামেন। বাবার ক্ষেত্রে সেটা আবার অন্য সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভাবনা যা হত্যাকাণ্ডকে রূপ দিয়েছে ঘৃণিত কর্ম ‘অনার কিলিংয়ে’। এটা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর চিন্তার দীনতার চরম প্রকাশ।
‘অনার কিলিংয়ের’ এই ব্যাপারটি আমাদের দেশে খুব একটা প্রচলিত না হলেও এই উপমহাদেশে বিশেষত পাকিস্তানে বহুল প্রচলিত, আছে ভারতেও। কাউকে যখন পরিবারের সকলের সম্মানহানির দায় দেওয়া হয় তখন পরিবারের পক্ষ থেকে খুন করে ফেলা, খুনের পরিকল্পনা করা ও খুনে অন্যকে জড়িত করে সেটা আদায় করে ফেলা এই অনার কিলিংয়ের মাধ্যম। পাকিস্তানে এমন ঘটনা নিয়মিত হয়ে আসছে; হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জানছি জর্ডান, তুরস্ক, লেবানন, মরক্কো, সিরিয়াতে এটা প্রচলিত। পাকিস্তানে এই অনার কিলিং বিরোধী আইনও হয়েছিল, কিন্তু সে আইনের কার্যকারিতা খুব একটা নেই। ভারতে জাত-বর্ণ না মেনে কোন নারী কাউকে বিয়ে করলে পরিবারের বিরোধিতার মুখেও পড়েন, এবং এ নিয়ে পরিবারের লোকদের মাধ্যমে খুনের শিকার হওয়ার ঘটনাও ঘটে। তবে বাংলাদেশে এমন অনার কিলিংয়ের নজির খুব একটা না থাকলেও বিউটির ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। পরিবারের কথিত সম্মান রক্ষার্থে বাবা-চাচা ও পরিবারের সদস্যরা মিলে খুন করেছেন বিউটিকে। এরপর তার লাশ হাওরে ফেলে রেখে নিজেরা দায় এড়াতে চেয়েছিলেন।
বিউটি হত্যাকাণ্ডে বাবা-চাচা জড়িত থাকার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। এটা মূলত পারিবারিক ও সামাজিক টান থেকেই ব্যক্তি চিন্তায় উদ্ভূত। পরিবারের এক সদস্য অন্যকে খুন করতে পারে, এটা সচরাচর ঘটে না আমাদের সমাজে। তাই বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে বাস্তবতায় ফিরে এসে যখন অপরাপর ঘটনাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করা যায় তখন এটাকেও মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে হয় স্বীকারোক্তির কথা, কারণ এই স্বীকারোক্তি আদায় জোরপূর্বক ছিল না। পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দি ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথম বক্তব্যে যেখানে জোরপূর্বক-ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে আদায়ের একটা অভিযোগ থাকে, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে সে শঙ্কা কম। তাই অনেক মামলায় দেখা যায়, পুলিশের কাছে আসামিরা যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া অন্য স্বীকারোক্তির মধ্যে বিস্তর ফারাক। আর বিচার প্রক্রিয়ায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া জবানবন্দিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ ওখানে ভয়ভীতির বিষয়টি থাকে অনুপস্থিত। এমনকি ওই পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট আগের দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহারেরও সুযোগ দিয়ে থাকেন।
বিউটির বাবা ও চাচা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে যা বলেছেন সে সূত্র ধরে পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার নবগঠিত ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন গত ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ৪ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্যপদে নির্বাচন করেন কলমচান বিবি ও একই গ্রামের ময়না মিয়ার স্ত্রী আছমা বেগম। নির্বাচনে কলমচান বিবি জয়ী হন। কিন্তু নির্বাচন ঘিরে কলমচান বিবি ও আছমা বেগমের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। আছমার স্বামী ময়না মিয়া নির্বাচনের আগ থেকেই কলমচান বিবিকে নির্বাচন না করার অনুরোধ করে আসছিলেন। কিন্তু তা শোনেননি কলমচান বিবি।
পুলিশ সূত্রে আরও জানা যায়, গত ২১ জানুয়ারি বিউটিকে অপহরণ ও দুই সপ্তাহ আটকে রেখে ধর্ষণ করেন কলমচান বিবির ছেলে বাবুল মিয়া। এ নিয়ে গ্রামে সালিশি বৈঠক হয়। কিন্তু তাতে কোনো সুরাহা হয়নি। পরে ময়না মিয়া বিউটির বাবা সায়েদ আলীকে বোঝান, বিউটি নষ্ট হয়ে গেছে। তাকে বাড়িতে রাখলে সায়েদ আলীর অপর দুই মেয়েকে ভালো জায়গায় বিয়ে দেওয়া যাবে না। কিন্তু বিউটিকে হত্যা করলে বাবুল ও তার মাকে ফাঁসানো যাবে। তখন বিউটিকে হত্যার প্রস্তাবে রাজি হন তার বাবা সায়েদ আলী। পরে গত ১৬ মার্চ ময়না মিয়া, সায়েদ আলী ও অপর এক ব্যক্তি বিউটিকে তার নানা বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন। লাখাই উপজেলার কোনো একটি স্থানে বিউটিকে হত্যা করা হয় এবং তার লাশ ওই দিন রাতে শায়েস্তাগঞ্জের ছাতাগর্ত হাওরে ফেলে রাখা হয়।
এখানে সরকারদলীয় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ময়না মিয়ার রাজনৈতিক অভিলাষ চরম মাত্রার এবং পারিবারিক সম্মানের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসে সম্মান রক্ষার নামে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের আশ্রয় নিতে দেখা যায়। আর ভিক্টিমের বাবা তখনই বিভ্রান্ত হয়ে অনার কিলিংয়ের প্ররোচনায় পা দেয়। এই হত্যায় বাবুল মিয়া কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনা ও সালিশি বৈঠকে কোন সুরাহা না হওয়ার বিষয়টিও ভূমিকা রেখেছে। ধর্ষিতার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ সমাজ এখন নিপীড়নের শিকার কোন নারীকে সহজভাবে মেনে নেওয়ার মত ইতিবাচক হতে পারে নি। আর এ ঘটনা যেখানে ঘটেছে সেটি হবিগঞ্জের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। আমাদের শহুরে শিক্ষিত সমাজের বড় একটা অংশ যেখানে নির্যাতিত নারীকে সহজভাবে মেনে নেওয়ার শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে নি এখনও সেখানে প্রত্যন্ত কোন গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সে শিক্ষা থেকে নিশ্চিতভাবে বেশ দূরে।
দেশে নিয়মিতভাবে নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটে চলেছে। সমাজ পারিপার্শ্বিকতা বেশিরভাগ ঘটনাকেই মেনে নেয় না। অপরাধীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কঠোর না হয়ে অপরাধের শিকার মানুষের প্রতি কঠোর হতে দেখা যায়। তবু ভিক্টিম বাঁচে, বাঁচার চেষ্টা করে যায় সাধ্যমত। এটা সম্ভব হয় পারিবারিক সমর্থন ও সহযোগিতায়। নির্যাতিতকে শেষ পর্যন্ত পরিবার আগলে রাখে। সমাজে ওই পরিবারগুলো টিকে থাকতে চেষ্টা করে, কেউ কেউ আবার নিপীড়নের শিকার হওয়ার নারীকে নিয়েও অন্যত্র চলে যায়; এটা ভালোবাসা ও পারিবারিক সমর্থন-সহযোগিতার ইচ্ছা থেকে উৎসারিত। এটাই পারিবারিক বন্ধনের শক্তি। এ শক্তিবলে পরিবার টিকে আছে নির্যাতিতের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে।
বিউটির ক্ষেত্রে পরিবার তার শেষ আশ্রয়স্থল হয়নি। জঘন্য অনার কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন এ তরুণী। বাবা সায়েদ আলী, চাচা ময়না মিয়ার মাধ্যমে যে হত্যাকাণ্ড ঘটল তার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল ধর্ষক বাবুল মিয়া।
বিউটি হত্যাকাণ্ডে আমাদের পারিবারিক সত্তা ও রক্ত সম্পর্কীয় বন্ধনকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। খুব করে চাইব এই ধরনের ঘটনা আর না ঘটুক। বিউটির পরিবারই হোক সর্বশেষ নজির। অনার কিলিংয়ের মত জঘন্য মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসুক মানুষ। সমাজ-পরিবারের কাছে আমাদের আশ্রয় পাওয়ার দীর্ঘ যে ধারাবাহিকতা সেটা অব্যাহত থাকুক। এর ব্যত্যয় ঘটলে আমরা যাব কোথায়, মানুষ যাবে কোথায়!
লেখক : কবির য়াহমদ, সাংবাদিক
সারাবাংলা/ এসবি