Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘জনমের শোধ ডাকি গো মা তোরে’

ফারুক ওয়াহিদ
৮ মে ২০২২ ১৬:০৫

মা দিবস স্মরণে: ‘মা’ এক বর্ণের এক বিশাল সর্বজনীন নাম এবং পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মধুরতম শব্দ! ছোট্ট একটি শব্দ এই ‘মা’ নিয়ে কত ছড়া, কত কবিতা, কত গল্প, কত উপন্যাস-উপাখ্যান, কত গান রচিত হয়েছে- তার হিসেব কি কেউ রেখেছেন? এই মায়ের ভালোবাসাকে কি কখনও খন্ডন করা যায়? মায়ের ভালোবাসা বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এই মা-এর তুলনা যে একমাত্র এই মমতাময়ী মা-ই যার কাছে খুঁজে পাওয়া যায় মমতার সুশীতল স্নিগ্ধ ছায়া। মাকে পৃথিবীর যে ভাষাতেই ‘মা’ ডাকা হোক না কেন- সেখানে সমার্থক শব্দটিতে বাংলা বর্ণ ‘ম’ বা ইংরেজি ‘এম’ অক্ষরটা থাকবেই।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব মা দিবসে পৃথিবীর সব মা বিশেষ করে সকল বাঙালি মমতাময়ী মাকে পরম শ্রদ্ধা- ভালোবাসা ও মা দিবসের শুভেচ্ছা। মা হচ্ছেন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদাপূর্ণ সম্মানী ব্যক্তিত্ব- পার্থিব জগতে সন্তানের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক মায়ের সাথে- মায়ের সাথে যে সন্তানের নাড়ির সম্পর্ক। সন্তানের সবসময় মঙ্গলকামী বাঙালি মাকে ‘পাগলিনী মা’ও বলা হয়ে থাকে। আমাদের মহানবীও (সা.) মাতৃত্বের সর্বোচ্চ সম্মানজনক মর্যাদা দান করে গেছেন। বাঙালি স্নেহময়ী মমতাময়ী মায়েরা সবসময় তাদের শিশু সন্তানকে আদর করে আকাশের রূপালি চাঁদের সাথে তুলনা করে থাকেন এবং এসব নিয়ে বাংলায় অনেক ছড়া, কবিতা ও গানও রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বাঙালি সন্তানদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের স্থান মায়ের আঁচল- আর সেই মা যদি তার স্নেহের শীতল-স্নিগ্ধ চাল ধোয়া হাত শাড়ির আঁচলে মুছে সেই আঁচল দিয়ে দীর্ঘ পথক্লান্ত সন্তানের মুখমমণ্ডল মুছে দেন- পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা স্পর্শে মায়ের কোলে সন্তানের কাছে পৃথিবীতে এর চেয়ে সুখ ও শান্তি আর কী হতে পারে! বাঙালি মাকে বলা হয় ‘দুঃখিনী মা’- বাংলার মাকে আমরা সবসময় লক্ষ্য করি, “যতই দুঃখ তুমি দেবে দাও- তবু জানি কোলে শেষে তুমি টেনে নাও”- তাই তিনি যে একজন আবহমান বাংলার স্নেহময়ী দুঃখিনী মা জননী- যার ভালবাসা পবিত্র, চিরন্তন ও শাশ্বত।

একাত্তরে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মায়ের আঁচলের শক্ত বন্ধন থেকে আমার দুঃখিনী মা নিজের হাতে আমাকে বিছিন্ন করে দিয়েছিলেন- আরেক মাকে অর্থাৎ দেশ-মাতাকে উদ্ধারের জন্য এবং কঠিন প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন দেশমাতাকে পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে উদ্ধার না করে মার সাথে যেন আমি দেখা না করি। হ্যাঁ, আমি মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি- কিশোর বয়সেই বই-খাতা-কলম ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অস্ত্র হাতে নিয়ে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে পাকিস্তানি হানাদারদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করিয়ে তাদের কবল থেকে দেশ-মাতাকে উদ্ধার করে চিরদিনের জন্য দুঃখিনী বাংলা মাকে মুক্ত করে তারপর মায়ের আঁচলে ফিরে এসেছি অর্থাৎ আমার মায়ের সাথে দেখা করেছি। ঢাকার আজিমপুরে চিরনিদ্রায় শায়িত আমার জান্নাতবাসিনী মাকে মা দিবসে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে প্রার্থনা করছি, তার আত্মা যেন শান্তি পায়।

বিশ্ব মা দিবসে বাংলার সেই সব মা-বোনদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি- যারা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা নির্যাতিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লক্ষ লক্ষ মায়ের এতো বড় আত্মত্যাগ পৃথিবীর আর কোনো জাতির মায়েদের দিতে হয়নি। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও বাংলার অগনিত সেইসব দুঃখিনী ময়েদের সম্ভ্রম-সম্মান রক্ষা করতে পারিনি- সে জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। সেই সাথে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলার সেই সব মায়েদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি- যারা বাংলাদেশি শরণার্থী তথা আগরতলায় আশ্রয় নেওয়া কোলের ক্ষুধার্ত দুধের শিশুদের ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখে তাদের মাতৃহৃদয় কেঁপে উঠেছিল এবং নিজেদের বুকের দুধ পান করিয়ে শিশুদের প্রাণ জুড়িয়ে জীবন রক্ষা করেছিলেন। যেটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা- আগরতলার সেইসব মায়েদের অর্থাৎ দুধ-মাতাদের ঋণ বাংলাদেশ কীভাবে শোধ করবে জানি না। বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের কি কোনো মা-বোন ছিল না? -তারা কেমন মায়ের সন্তান! আর পাকিস্তানি মায়েরাই বা কেমন! তাদের হৃদয় বা মাতৃহৃদয় বলতে কি কিছুই ছিল না? তারা পাকিস্তানের মাটিতে কেমন সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন? বাংলাদেশে তাদের ছেলেরা বা স্বামীরা বা ভাইয়েরা বা বাবারা (হানাদার পাকিস্তানি আর্মি) লক্ষ লক্ষ বাঙালি মায়েদের নির্যাতিত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে গেলো -এর জন্যে এতো বছরেও মা হয়েও কোনো পাকিস্তানি মা অনুতপ্ত বা নিন্দা জানানো দূরের কথা বরং পাকিস্তানি মায়েরা পাকিস্তানি সৈন্যদের এই তথাকথিত ‘বীরত্বপূর্ণ’ কাজের জন্য গর্ববোধ করছে- এ কেমন পাকিস্তানি মা! পাকিস্তানে মা দিবস পালন হয় কি না জানি না- যে দেশে মায়েদের সম্মান দিতে জানে না- তাদের দেশে আবার কিসের মা দিবস! তাদের ‘মা দিবস’ পালন করার কোনো অধিকার নেই।

বাঙালি সন্তানের মা ভক্তি শাশ্বত ও চিরন্তন। বাঙালি পন্ডিত, লেখক ও শিক্ষাবিদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর মায়ের প্রতি ভালোবাসা ও মাতৃভক্তির গল্প সবারই জানা- যিনি মায়ের চিঠি পেয়ে একবার তার মা’র কথা রক্ষা করতে গিয়ে অন্ধকার ঝড়ো রাত্রিতে বিক্ষুব্ধ খরস্রোতা দমোদর নদী সাঁতার কেটে পার হয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছিলেন। মা’য়ের প্রতি ভক্তি ও ভালাবাসার আর কি উদাহরণ হতে পারে। বিশ্ব মা দিবসে বিশ্বের সম্মানিত মায়েদের বিশেষ করে বাঙালি মায়েদের অত্যন্ত গর্ব ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং এই মুহূর্তে পান্না লাল ভট্টাচার্যের গাওয়া বিখ্যাত আবেগময় গানটির কথা মনে পড়ে যায়- যা বিশ্ব মা দিবসের শ্রেষ্ঠ উপহার! -“জনমের শোধ ডাকি গো মা তোরে/ কোলে তুলে নিতে আয় মা।”

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

‘জনমের শোধ ডাকি গো মা তোরে’ ফারুক ওয়াহিদ মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর