রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র: বিতর্ক ও সম্ভাবনা
১৪ মে ২০২২ ২২:৫৯
পদ্মাসেতুর পর আমাদের আরেকটি স্বপ্নের প্রকল্প ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র’ বাস্তবায়নের পথে। কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়েও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের আলোকে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
যেভাবে সূচনা
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালে। কিন্তু ১৯৬৯ সালে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। অতঃপর ১৯৮৭ সালে জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের দু’টি কোম্পানি কর্তৃক এর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। তবে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
১৯৯৭ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প পুনঃবাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়া। হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদন যখন অকল্পনীয় বিষয় ছিল, তখন তিনি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছিলেন। ড. ওয়াজেদ মিয়ার তত্ত্বাবধানে ‘বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশান প্ল্যান-২০০০’ অনুমোদিত হয়। ২০০১ এর পর আবার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়! ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছিল।
সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনার উদ্যোগে ২০১০ সালের ১ মে বাংলাদেশ সরকার ও রাশিয়া ফেডারেশন সরকারের স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশনের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাস্তবায়নের সূচনা হয়। ৩০ নভেম্বর ২০১৭ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১নং ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাই উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ক্লাবের সদস্য হয়।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যয়
পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যয় অনেক বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। তবে সিন্যাপস এনার্জির ২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী ১১০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আনুমানিক ব্যয় ৯ বিলিয়ন ডলার। প্রখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের ২০১২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১০০০ মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের খরচ ৭ বিলিয়ন ডলার।
২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুই ইউনিটের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যয় হচ্ছে ১২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ব্যয় গ্রহণযোগ্য। মোট ব্যয়ের নব্বই শতাংশ রুশ ফেডারেশন ঋণ হিসাবে দিবে। বাকি ১০ শতাংশ বাংলাদেশ অর্থায়ন করবে। ২০২৩ সালে ১২০০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। ২০২৪ সাল নাগাদ দু’টি রি-অ্যাক্টর থেকে আমাদের জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ যোগ হবে। বাস্তবায়ন হবে আরেকটি স্বপ্নের।
যে কারণে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র
একটি দেশের অর্থনীতির সঙ্গে বিদ্যুৎ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন। ফলে গ্রাহকের সাশ্রয় হবে, পণ্য উৎপাদন খরচ কমবে। রপ্তানি বাজারে দেশের রপ্তানিকারকরা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী জলবায়ু ইস্যুতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরিবেশ দূষণের মাত্রা অনেক কম।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থার্ড জেনারেশন ভিভিইআর (জেনারেশন থ্রি-প্লাস) মডেলে নির্মিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের অন্যান্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় রূপপুর হতে যাচ্ছে উচ্চতর ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে নির্মিত একটি প্রকল্প। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অন্তত ৬০ বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। আমাদের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার অন্তত দশ ভাগ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পূরণ করতে সক্ষম হবে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যখন শ্বেতহস্তী
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও অনেকেই একে শ্বেতহস্তী বলছেন। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে ধারণা আছে এমন যেকেউ জানেন যে, ২৪০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্তের কারণে রূপপুরকে শ্বেতহস্তী বলার সুযোগ নেই। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে তুলনামূলকভাবে ব্যয় বেশি হয়। তাই কম উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিপরীতে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ অনেক ক্ষেত্রে সীমিত হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে এক ইউনিটের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে নি। দুই ইউনিটের বা ১১০০ মেগাওয়াটের অধিক সক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রত্যাশিত মূল্যে ও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যায়।
নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে আন্তর্জাতিক সকল নীতিমালা ও বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নির্মাণ কাজ চলছে।
ইতোমধ্যে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হৃৎপিণ্ডখ্যাত রিএ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া মানবসম্পদ উন্নয়ন, রি-অ্যাক্টরের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পরিবেশের ভারসাম্য সংরক্ষণ ইত্যাদি কাজ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নির্বাচিত পারমাণবিক চুল্লিতে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রাশিয়ার আনবিক শক্তি কর্পোরেশন রোসাটম বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ করবে এবং ইউরেনিয়াম জ্বালানি ব্যবহারের পর বর্জ্য ফেরত নিয়ে যাবে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আয়-ব্যয় ও ঋণ পরিশোধ
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণ ১১ বিলিয়ন ডলার প্রায়। রাশিয়ার দেওয়া ঋণের সুদাসল পরিশোধে গ্রেস পিরিয়ড দেওয়া হয়েছে। তাই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে ২০২৭ সালের মার্চ থেকে। প্রতি বছর দু’টি কিস্তিতে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ৪ শতাংশ সুদ হারে প্রতি বছর ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট ৫ টাকা করে ধরা হলে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও এক বছরে নিট আয় হবে ৭৭০ মিলিয়ন ডলার। সুতরাং ভর্তুকি ছাড়া ঋণ পরিশোধ করেও লাভ করার সুযোগ থাকবে।
বাংলাদেশের একক প্রকল্প হিসেবে সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকানা থাকবে বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশনের হাতে। কেন্দ্রটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ’। মহামারির মধ্যেও এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ২৬ হাজার শ্রমিক দিনরাত কাজ করেছেন। পাবনার রূপপুর এখন যেন মিনি রাশিয়া। সুউচ্চ বসতবাড়ি, অফিস ও নানা ভৌত অবকাঠামো এলাকার অবস্থা বদলে দিয়েছে।
দেশি-বিদেশি কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। পর্যটকদের জন্য রূপপুর দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে উঠেছে। সব সমালোচনা ও অপপ্রচার ছাপিয়ে এই প্রকল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর বাংলাদেশের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এমও