আমার বাবার কথা
২৩ মে ২০২২ ২১:৪০
আজ আমার বাবা মরহুম হাবিবুর রহমান তালুকদারের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৬ সালে ২৩ মে ভোর রাতে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় সবাইকে ছেড়ে চলে যান।
আমার বাবাকে নিয়ে আমি অনেক গর্ব বোধ করি। আমার বিশ্বাস আমার সব ভাইবোনরাও। আব্বার সন্তান হিসেবে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়, তার মত হতে পারিনি বলে। যখন বেঁচে ছিলেন, তখনকার চেয়ে মৃত্যুর পর এই উপলব্ধিটা প্রবল হয়েছে।
আব্বা কোন বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি বা কর্মকর্তা ছিলেন না। বংশপরিচয় আর কর্মজীবনে শিক্ষকতা। এখন শহর হলেও, তার কর্মজীবন কেটেছে গ্রামীণ পরিবেশে।
শুধু এইটুকু দিয়ে আমার গর্বের জায়গাটি তুলে ধরা সম্ভব নয়। এর বাইরে আরও কিছু আছে।
আব্বার জন্ম ও বেড়ে উঠা শহর কোলকাতায়। আমার দাদা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। তখনকার ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত সরিষাবাড়ির যমুনাপাড়ের মানুষ আমার দাদা লেখাপড়া শিখে বৃটিশের পুলিশ কর্মকর্তা হওয়া খুব সহজ বিষয় ছিলো না। সাফল্য আর সম্মাননাময় চাকরি, অবসরের পর গ্রামে ফিরে ব্যবসা শুরু করা, ভূ-সম্পত্তির মালিক হওয়া, কলকাতাকেন্দ্রিক ক্ষয়িষ্ণু জমিদারের স্থানীয় প্রতিভূদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এলাকার মানুষদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা, গ্রামের বিশেষ করে চর এলাকার মানুষদের সুখ-দুঃখের সাথী হওয়া, বৃটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে শরিক হওয়া- সব মিলিয়ে আমার দাদা মরহুম জসিমউদদীন তালুকদার ছিলেন একজন কিংবদন্তী।
আব্বা সম্ভবতঃ ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়েছিলেন কোলকাতায়। দাদার অবসরের পর পরিবারটি চলে এলো নিজ গ্রামে।
দাদারা তিন সহোদর ভাই, তাদের চাচাতো ভাইরা, সবাই সম্পন্ন। এলাকায় এত স্কুল কলেজ ছিলো না তখন। সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য ভালো স্কুল কলেজে পড়ানোর সামর্থ্য তাঁদের ছিলো। ছোট দাদা রিয়াজ উদ্দিন তালুকদার, বড় দাদার ছেলে গোলাপ তালুকদার পড়তেন ময়মনসিংহের নামী মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে। আব্বা পড়েছেন আরেকটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান নান্দিনা (জামালপুর শহরের কাছে) মহারানী হেমন্তকুমারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। দাদার চেষ্টা ছিলো, সামর্থ্য ছিলো, ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু আব্বার লেখাপড়া এগুলো না। কারণ সেই ছোটবেলায়, কোলকাতায় কাটানো শৈশবেই তার মাথায় ঢুকে গেছে সাহিত্য আর শিল্পকলার নেশা। ভয়ংকর নেশা। সেই নেশায় হারিয়ে গেল লেখাপড়া, সংসারের দায়িত্ব, বিষয় সম্পত্তির দিশা, সবকিছু। কবিতা লিখতেন, গান লিখতেন। সুর করতেন। ভরাট গলায় গাইতেন। নজরুলের ভক্ত ছিলেন। তার ইসলামি গান থেকে শ্যামা সংগীত, আধুনিক, কীর্তন গাইতেন। রামপ্রসাদী গাইতেন। আধুনিক বাংলা গান আব্বার কন্ঠে ভীষণ মানিয়ে যেতো। মানবেন্দ্র, সতীনাথ, হেমন্ত, মান্না দে। পুরো এলাকা মাতিয়ে রাখতেন। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আব্বার কন্ঠে শুনেছি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার আবৃত্তি। এলাকার কোন অনুষ্ঠান জমতো না এটা ছাড়া।
আর ছিলো নাটক। এলাকায় নাটকের চর্চা চালু করা ও তা টেনে নেয়া, সেই সময়ে কত কঠিন ছিলো, তা এখন অনেকে বুঝতেই পারবে না। দাদারা সবাই ছিলেন ধর্মপরায়ণ। হাজী। তখন হাজী মিলতো দশগ্রামে হয়তো দুই-একজন। রক্ষণশীল পরিবেশে নাটকের চর্চা ছিলো আব্বার এক কঠিন সংগ্রাম। আব্বার পাশে ছিলেন মরহুম তাজউদ্দিন আহমেদ। তাজ চাচা ছিলেন আব্বার বন্ধুর চেয়েও বেশি। আমরা ছোটবেলায় দেখতাম, এলাকার নাটক যৌথভাবে পরিচালনা করতেন আব্বা আর তাজ চাচা। নায়কের চরিত্রে আব্বা। সিরাজউদ্দৌলা নাটকে সিরাজের চরিত্রে একশ’ বারের বেশি অভিনয় করেছেন। একটু বড় হয়েই আমি হয়ে গেলাম প্রম্পটার। রিহার্সেলে আর শো’র দিন স্টেজে উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে প্রম্পট করতে করতে পুরো সিরাজউদ্দৌলা নাটক আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো। একটা বাক্যও ভুল হতো না।
তো এই নাটক, গান, কবিতার নেশায় আব্বার লেখাপড়া গেল। আনন্দমোহন কলেজে পরিচয় হলো আনোয়ার হোসেনের সাথে, যিনি পরবর্তীতে সিরাজউদ্দৌলা ছায়াছবিতে সিরাজের চরিত্রে অভিনয় করে এখন কিংবদন্তী। অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের সাথে অনেক পরে আমার পরিচয় হলো, তখন আব্বার সাথে তার এক সময়ের ঘনিষ্টতার কথা মনে ছিলো। যক্ষায় আক্রান্ত এই অভিনেতার চিকিৎসায় সাধ্যমত চেষ্টা করেছি, একাধিকবার উনার বাসায় গিয়েছি।
কলেজে আব্বার সখ্যতা হয়েছিলো আরেক বিখ্যাত অভিনেতা আশীষ কুমার লোহ’র সাথেও।
সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী অল্প বয়সেই আমার দাদা ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। শেরপুরের ছনকান্দা মিয়াবাড়ির আবুল হোসেন সাহেবের বড় মেয়ে মোছাম্মত আবেদা খাতুন ওরফে পিয়ারা বেগম এলেন তালুকদারবাড়ি ওরফে দারোগাবাড়ির ছোট বউ হয়ে। বিশাল একটি পরিবারে নানাবিধ জটিলতায় তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছিলো। সংসার ও বিষয়সম্পত্তির প্রতি অমনোযোগী স্বামী লেখাপড়ার চেয়ে গান আর নাটক নিয়েই বেশি ব্যস্ত। কয়েকটি সন্তান নিয়ে কঠিন এক জীবন।
আব্বার লেখাপড়ায় ছেদ পড়লো। এর মধ্যে আকস্মিকভাবে মৃত্যু হলো আমার দাদার। আমার জন্মের আগের বছর। ছয় সন্তানের সংসারের দায়িত্ব ঘাড়ে পড়লো। দাদার রেখে যাওয়া আড়াইশ’ বিঘা জমি, যার কোন কিছুর খবর কখনও নেন নি। সম্পত্তি থাকলে এই পরিস্থিতিতে যা হয়। ভাগাভাগি, বাটোয়ারা মামলা, নানা ঝামেলা। সংস্কৃতিপ্রেমী আমার বাবা দাদাদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হাই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলেন। বাংলা পড়াতেন মূলতঃ। সাহিত্যের প্রতি অপরিসীম অনুরাগ যেন জায়গা খুঁজে পেল প্রিয়ছাত্রদের (প্রথমদিকে ছাত্রীও ছিলো) শিক্ষাদানের মাঝে। বাকীটুকু ইতিহাস।
অধ্যবসায় কাকে বলে দেখিয়ে গেছেন আব্বা। ছেদ পড়লেও হার মানেন নি। এত ঝক্কিঝামেলা সামাল দিয়ে এইচএসসি পাশ করেছেন। বিএ পাশ করেছেন যে বছর, উনার ভাতিজি অর্থাৎ আমার আপন চাচাতো বোনও পাশ করেছেন। আব্বার মধ্যে কোন দ্বিধা ছিলো না এ নিয়ে।
হাজার হাজার ছাত্রের অকৃত্রিম ভালোবাসা, সন্তান হিসেবে আমাকে গর্বিত করে। আব্বার অনেক ছাত্রের সাথে আমার যোগাযোগ ও কিছু কার্যক্রম আছে। তারা আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমার ধারণা, তারা আমাকে নয়, আব্বাকে ভালোবেসে আমাকে সাপোর্ট করেন।
প্রাচুর্যের দিকে আব্বার কোন আকর্ষণ ছিলো না। সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। আমাদের লেখাপড়া শেখানোর দিকেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। ইংরেজি শেখাতেন নিয়ম করে। মনে আছে, এ হোম টিউটর ইন ইংলিশ বইটা সব ভাইবোনকে বাধ্যতামূলক পড়তে হতো।
এর চেয়ে বড় কথা, পাঠ্যবইয়ের বাইরে জ্ঞানের জগতটা আমাদের সামনে খুলে দিয়েছিলেন। সমৃদ্ধ একটা লাইব্রেরি ছিলো ঘরেই। আব্বা তিল তিল করে সাজিয়েছেন নিজের জন্য, আমাদের জন্য। ছাত্রদের জন্য স্কুলের লাইব্রেরিও তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। প্রচুর বই পড়েছি ছোটবেলায়। এখন জীবনের নানা বাঁকে অনুভব করি এর প্রভাব।
হারমোনিয়াম তবলা নিয়ে বসে যেতেন আমাদের গান শেখাতে। রেওয়াজ করতে বলতেন। এখানে ফাঁকি দিতাম সবাই, দুজন বাদে। চাচাতো ভাই, আতিউর রহমান তালুকদার ভেলু। আর আমার দ্বিতীয় ভাই বাবুল তালুকদার। এই দুজনে এলাকার নামকরা গায়ক ছিলেন দীর্ঘকাল। আমি স্কুল- কলেজের অনুষ্ঠানে গাওয়া পর্যন্তই। আর হয় নি।
আব্বার দেখাদেখি আবৃত্তি করতাম আমরা। ঘরোয়া আয়োজনে তার এখন সীমিত চর্চা। আমার বোন স্কুলের অনুষ্ঠানে নাচ করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলো। আব্বার মৌন সমর্থন ছিলো।
গ্রামের পরিবেশে নাটকে এক সাথে অভিনয় করেছি আব্বা, আমরা চার ভাই, একবোন। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে! ভাবতে পারেন! কট্টর মানুষদের কত বাঁকা কথা শুনতে হয়েছে। আব্বা পাত্তা দিতেন না।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন একটা নাটক লিখতে শুরু করেছিলেন। আমি তখন ক্লাশ টু’তে পড়ি। লেখার সময় আমার কথা মাথায় রেখে একটা সাহসী শিশুর চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন, পাকিস্তানি বাহিনী যাকে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হলো। হাই স্কুলে আব্বার পরিচালনায় নাটকটি মঞ্চস্থ হলো। ১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন দেশে তখন টগবগে আবেগ। দারুন সফল হলো নিশী হলো ভোর নাটকটি। দর্শক অনুরোধে পর পর দুই রাত শো হলো। নাটকে আব্বা আমার বাবার ভূমিকায়। আমার ভাই বাবুল তালুকদার আমার বড় ভাইয়ের চরিত্রে।
পরের বছর আমার ভাইসহ আব্বার অনেক ছাত্র এসএসসি পাশ করে সরিষাবাড়ি কলেজে ভর্তি হলেন। তারা কলেজে আব্বার লেখা এই নাটক মঞ্চায়নের সিদ্ধান্ত নিলেন। আমার বাবার চরিত্রে এবার বড় ভাই বাবুল তালুকদার। আমার পিচ্চির চরিত্র কে করবে? আব্বা রাজী হলেন না আমাকে দিতে। তখন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ওয়াজেদ ভাই। জিএস শামসুদ্দিন ভাই (পরে ডাক্তার)। শামসুদ্দিন ভাই আমাকে গোপনে সাইকেলে উঠিয়ে কলেজে নিয়ে রিহার্সাল করালেন। তখন প্রিন্সিপাল ছিলেন নাট্যকার আব্দুল্লাহ আল মামুনের ভাই আব্দুল্লাহ আল হারুন। আব্বা অবশ্য ছাত্রদের এই অননুমোদিত কর্মকান্ডে বাধা দেন নাই।
আব্বার পরিচালনায় অনেক নাটকে আমি অভিনয় করেছি। অনেক পরে আমার পরিচালনায় আব্বা ও তাজ চাচা অভিনয় করেছেন ওরা কদম আলি, সুবচন নির্বাসনে নাটকে। সহজভাবেই নিয়েছিলেন বিষয়টি। অথচ নাটকের প্রাতিষ্ঠানিক কোন প্রশিক্ষণ ছিলো না আমার। যেটুকু সম্বল, তা উনাদের কাছ থেকেই পাওয়া।
অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষাটাও পেয়েছি আব্বার কাছ থেকে। জন্মের পর থেকেই দেখেছি, বাবু বিশ্বেশ্বর রায় মরণ কাকাকে। আব্বার বিশ্বস্ত সহযোগী। তবলা বাজাতেন। আব্বার আরেক বন্ধু জিতেন কাকা। ফটো স্টুডিও ছিলো কাকার। আব্বার খুব নেশা ছিলো ফটোগ্রাফীর। ছবি তুলতেন। নিজেই ডেভেলপ ও প্রিন্ট করে রোদে শুকাতেন। মরণ কাকা, জিতেন কাকাসহ অনেককেই পরিবারের অংশ মনে করতাম। হিন্দু- মুসলিম বিভেদজ্ঞান তাই আমাদের মাঝে নেই। মেডিকেল কলেজের পুরো ছয় বছর তাই আমার রুমমেট ছিলো প্রবীর। নড়াইলের লোহাগাড়ার বিখ্যাত শ্যাম ডাক্তার। এখনও আমার সবচাইতে আপন চার বন্ধুর একজন এই প্রবীর।
আব্বার অনেক শখের বিষয় ছিলো। আমাদের ছেলেবেলাকে সমৃদ্ধ করেছে আব্বার গ্রামোফোন মেশিন, রেকর্ডের বিশাল সংগ্রহ।
পরে রেডিও এলো। এ নিয়ে মেতে থাকতেন। পার্টস কিনে জোড়া লাগিয়ে রেডিও বানাতেন। আব্বার একটা গোল টেবিল ছিলো মাথার কাছে। অনেক যন্ত্রপাতির সাথে একটা তাতাল থাকতো সেখানে।
আব্বাকে নিয়ে গর্ব করার বিষয় আরও আছে। মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর মাঝে মাঝেই লম্বা ছুটি হতো। এরশাদ ভেকেশন। একবার সেটেলমেন্টের লোকজন এসে আস্তানা গাড়লো কাচারি ঘরে। নতুন নকশা ও রেকর্ড হবে। জমিজমার বিষয় মাথায় সহজে ঢুকতো না। কিন্তু হাতে লম্বা ছুটি। কাগজপত্র ঘাঁটাঘাটি শুরু করলাম। আল্লাহ মেধা তো কিছু দিয়েছেন। কিছু ক্লু পেয়ে গেলাম। লেগে থাকলে লাভবান হবো, কিন্তু কিছু শরিকের সাথে ভুলবুঝাবুঝি হতে পারে। আব্বা ডেকে বললেন, জমিজমার পিছনে মেধার অপচয় না করতে। এখনও কানে বাজে আব্বার কথাগুলো। আমি কষ্ট করে তোদের লেখাপড়া করাতে চেষ্টা করছি। তোরা মানুষ হ’। জমিজমার পিছনে ছুটবি না।
কত স্মৃতি এসে ভর করছে। নয় ভাইবোনের বিশাল পরিবার। গানবাজনা পাগল আব্বা কিন্তু সবার খোঁজ নিতেন। স্নেহের ধারা থেকে কেউ বঞ্চিত হতো না।
আমাদের বাড়ির অন্য ছেলেরা বাড়ির পাশের প্রাইমারি স্কুলের মাঠে খেলাধুলা আর আড্ডায় মেতে থাকতো। ছোটবেলায় আমার ভালো লাগতো বাজারে যেতে। আব্বা সাইকেলে উঠিয়ে আমাকে বাজারে নিয়ে যেতেন। এক ফাঁকে আজিজ মিয়ার স্টলে বসিয়ে সিংগারা, মিষ্টি খাওয়াতেন। এমনিতে আমাদের বাড়ির ছেলেদের চায়ের স্টলে বসা বারণ ছিলো।
আব্বার প্রতি শ্রদ্ধায় মাতা নত হয় যে কারণে সেটা বলি এবার। এমনিতে আব্বা স্বভাবে ছিলেন বোহেমিয়ান। সংসার কাজে অনেকটা অমনোযোগী। গান আর নাটকের নেশা। এর ধকলটা গেছে আমার মায়ের উপর দিয়ে। অল্প বয়সে বিশাল পরিবারের নানা জটিলতার চক্রে দিশেহারা আমার অসম্ভব রূপবতী মায়াবতী মা নয় সন্তান আর বোহেমিয়ান স্বামীর বড় সংসার সামাল দিতে এক সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। চিকিৎসার ত্রুটি হয় নি। সে সময়ের দেশসেরা সাইকিয়েট্রিস্ট দেখানো হয়েছে। অধ্যাপক নাজিম উদ্দিন, অধ্যাপক হেদায়েতুল্লাহ, অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। পুরোপুরি সুস্থ আর হলেন না। বছরের অর্ধেক সময় এবনর্মাল থাকতেন। মাঝে মাঝে ভায়োলেন্ট। বাকী সময় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। এই সময়টা আমাদের প্রতিদিনই মনে হতো ঈদের দিন। অন্য সময়টা আব্বাকে ঝড় সামলাতে হতো। আমার বোহেমিয়ান স্বভাবের আব্বার সম্পূর্ণ নতুন রূপ আমরা দেখলাম। কি অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে আব্বা আমার মায়ের দেখাশোনা করতেন। বোনদের বিয়ে হয়ে গেল। লেখাপড়ার জন্য আমরা গ্রাম ছাড়লাম। সাতাশটি বছর আমার মায়ের সেবা করেছেন। মা মারা যাওয়ার পর প্রায় ঊনিশ বছর তিনি বেঁচেছিলেন। ছেলেমেয়েদের বাসায় এলে বেশিদিন থাকতে চাইতেন না। গ্রামে যেতে অস্থির হয়ে উঠতেন। দাদা-দাদী আর আমার মায়ের কবর যে সেখানে।
আমরা কি পারবো আব্বার মতো হতে? অসম্ভব। বাবা- মা যে ভালোবাসা স্নেহ-মমতা দিয়ে বড় করেছেন, যে ত্যাগ আমাদের জন্য করেছেন, আমি তার যোগ্য মর্যাদা দিতে পেরেছি? পারি নি। তাই বড় অনুতাপ হয়। আবার যদি সুযোগ পাওয়া যেত!
মহান আল্লাহর কাছে শুধু প্রার্থনা, আমার বাবা-মাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। তাদের সব গুনাহ তুমি মাফ করে দিও। তাদের ঠাঁই দিও তোমার করুণাধারার ছায়ায়।
রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বিয়ানি সাগিরা।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
অধ্যাপক ডা. মোঃ হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন আমার বাবার কথা মত-দ্বিমত