মাসিক স্বাস্থ্য অব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিতে নারীজীবন
২৮ মে ২০২২ ১৫:০১
এক
কাকলি ও সুকোমল (ছদ্মনাম) বিয়ে হয়েছে ছয় বছর হতে চললো। ইতোমধ্যে তাদের সুখের সংসারে একটি মেয়ে সন্তান আছে। এক সন্তান, স্বামী নিয়ে ভালোই আছে কাকলি ও সুকোমল দম্পতি। পরিবারের চাপে সম্প্রতি আরো একজন নতুন অতিথিকে পৃথিবীতে আনার পরিকল্পনা চলতে থাকে। তাদের পরিবারে নতুন অতিথিকে পৃথিবীতে আনার প্রক্রিয়ায় স্বামী-স্ত্রীর উভয়েরই ইচ্ছা আছে। কিন্তু কাকলি দম্পতির নতুন অতিথি পৃথিবীতে আসার ক্ষেত্রে যে সমস্যাটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটি হচ্ছে কাকলীর অনিয়মিত মাসিক প্রক্রিয়া। অনিয়মিত মাসিক সমস্যার কারণেই নতুন করে গর্ভধারণের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয় সম্প্রতি তার প্রায় চার মাস ধরে মাসিক হচ্ছে না, তিনি মনে মনে ভাবছেন, মনে হয় তিনি আবার মা হতে যাচ্ছেন। বিষয়টি বোঝার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন কাকলী। সেক্ষেত্রে গাইনী ও প্রসূতি রোগের চিকিৎসক তাকে প্রয়োজনীয় সকল ধরনের ল্যাবরেটরী ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে জানালেন, তার মাসিক সংক্রান্ত জটিলতার পাশাপাশি হরমোনের ও তার ওভারিতে সিস্ট (এক ধরণের পূঁজ কোষ) আছে, যেটি তার নতুন করে মা হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। সেজন্য তাকে প্রথমেই মাসিক প্রক্রিয়াটিকে স্বাভাবিক ও নিয়মিতকরণের জন্য চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
দুই
আরিফ ও অজন্তা, দুজনেই দাম্পত্য জীবনে খুব সুখী মানুষ। দুজনেই সাবলম্বী। কিন্তু সম্প্রতি তারা ভাবছে, তাদের দাম্পত্য জীবনে একটি সন্তান দরকার। সিদ্ধান্তটি চিন্তা করার পর থেকে তারা দু’বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু কোন ধরনের ফলাফল আসছে না। তার প্রায় ছয় মাসের বেশি সময় ধরে মাসিক বন্ধ। সেখানে আবার কখনো কখনো সময়ের ব্যবধান আরো বেড়ে যায়। এ অবস্থায় এ দম্পতি গাইনি প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। তিনি তাকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরিক্ষার পরামর্শ দেন। তিনি জানান মাসিক ব্যবস্থাটি অনিয়মিত এবং তার পলিসিস্টিক অভারিয়ান সিনড্রোমের (এক ধরণের হরমোনজনিত ব্যাধি) সমস্যার পাশাপাশি শরীরের থায়রয়েডের (এক ধরণের গ্রন্থি যেটা গলার নিচের দিকে থাকে) পরিমানে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। বর্তমানে এ সমস্যাটি সমাধানের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে অজন্তা। এক বছর ধরে দামী ঔষধ আর পরীক্ষা-নিরিক্ষা করাতে গিয়ে এই দম্পতির প্রায় সঞ্চিত অর্থের চার ভাগের তিন ভাগ খরচ হয়ে গেছে। এক বছর পরও গর্ভধারণ করতে না পারার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। এক পর্যায়ে তারা কিছুটা হতাশ হয়েই চিকিৎসা বন্ধ করে দেন। এখন বিধাতার করুণার প্রতি ভরসা রেখেই দিন কাটাচ্ছেন।
বর্তমানে মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে জটিলতাগুলো শুধুমাত্র কিশোরীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। একটি কিশোরীর জীবনে মাসিক শুরু হওয়ার পর থেকে কিছু জটিলতা তৈরি হয়, তাছাড়া মাসিককে ঘিরে থাকা প্রচলিত সামাজিক, পারিপার্শ্বিক, ধর্মীয় রীতিনীতি, ভুল বিশ্বাসের কারণে মাসিক স্বাস্থ্যকে ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে তারা নানা ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হন, সেগুলো একজন কিশোরীর স্বাভাবিক জীবন যাপনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সেই সাথে মাসিক স্বাস্থ্যের জটিলতা গর্ভধারণের ক্ষেত্রে নানা ধরণের সমস্যা তৈরি করে। এগুলো একজন নারীর জীবনে নতুন নতুন সংকট তৈরি করছে যার প্রভাব শুধু নারীর জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। এটি তার দাম্পত্য জীবনে জটিল অবস্থা তৈরি করছে। ফলে পারিবারিক সুখ-শান্তির জায়গাগুলোতে ভর করে এক বুক হতাশা! মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এই সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান যোগ্য নয়। বরং এর জন্য প্রয়োজন কৈশোর বয়স থেকে প্রজনন ও মাসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেয়া। প্রয়োজনীয় যত্ন ও পরিচর্যাটা শুরু করা খুব জরুরী সেই ছোটকাল থেকে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান টারমিনোলজি এ্যাকশন অফ দ্যা গ্লোবাল মেন্সট্রুয়াল কালেক্টিভ এর ‘মেন্সট্রুয়াল হেলথ: এ ডেফিনেশন ফর পলিসি, প্র্যাক্টিস, এন্ড রিসার্চ’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে উল্লেখিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘মাসিক স্বাস্থ্য বলতে শুধুমাত্র মাসিক সংক্রান্ত কোন রোগব্যাধি না হওয়া বা শারীরিক সুস্থতাকেই বোঝায় না, বরং মাসিকচক্র এবং এর সার্বিক প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক কল্যাণকর অবস্থাকে বোঝায়।’ তাদের প্রত্যাশা মাসিকস্বাস্থ্যকে সংজ্ঞায়িত করার ফলে এটি মাসিকস্বাস্থ্য সম্পর্কিত এডভোকেসি, কর্মসূচি বাস্তবায়ন, পলিসি তৈরি ও গবেষণা কার্যক্রমে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
আমাদের দেশে এখনো যেহেতু মাসিক বা পিরিয়ডকে একটি লজ্জার ব্যাপার হিসেবে ধরা হয়, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ বয়সী মেয়েদের জন্য পিরিয়ডের প্রথম অভিজ্ঞতা বেশ ভয়াবহ ও বিব্রতকর হয়ে থাকে। পিরিয়ডের সময় অনেকেই ভয় ও লজ্জায় কাউকে কিছু জানায় না। এটি পরবর্তী সময়ে কিশোরীর মানসিক ও শারীরিক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৪ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। মাসিক সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে, সঠিক তথ্য এবং পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতি বছর ২৮ মে ‘বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবস’ পালন করা হয়। বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২২ এর প্রতিপাদ্য হলো ‘২০৩০ সালের মধ্যে মাসিক বা ঋতুস্রাবকে জীবনের একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করা’।
তাই সকলের উচিত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে পরিবার, সমাজ, স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে আরো বেশি বেশি করে আলেচনা করা ও সহায়ক সেবার সুযোগ তৈরি করা। এ সময় পরিবার ও সমাজের পুরুষ সদস্যদের উচিত নারীদের সহযোগিতা করা, যেন তারা সঠিকভাবে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যাবস্থাপনা করার ব্যাপারে সংকোচবোধের বদলে উৎসাহিত হয়। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ। তাই মাসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যার অনুকুল পরিবেশ, স্বাস্থ্যসম্মত এবং নিরাপদভাবে মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য এখনই সময় চিন্তার ইতিবাচক পরিবর্তন এবং যথাযথ বিনিয়োগ করার।
লেখক: জনস্বাস্থ্য কর্মী ও প্রশিক্ষক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মত-দ্বিমত মাসিক স্বাস্থ্য অব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিতে নারীজীবন সুমিত বণিক