Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বৈশ্বিক সংকট: বাংলাদেশ কোন পথে

জহিরুল ইসলাম
২৯ মে ২০২২ ২০:০০

করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নানাবিধ সঙ্কটের মুখোমুখি বিশ্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এ অবস্থায় নিত্যপণ্যের বাজার সাধারণের নাগালের মধ্যে রাখা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে দেশের বাজারেও এর দাম বাড়ানো হয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে যানবাহনের ভাড়ায়। বেড়েছে পণ্য পরিবহন খরচও। আর পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মানুষের খরচ বেড়েছে, বেশ কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছু কিছু পণ্যের মূল্য বাড়াতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এর সঙ্গে অতিমুনাফালোভীদের কারসাজি তো রয়েছেই। ডলারের সঙ্গে টাকার মান কমানোর ফলেও দাম বাড়ছে আমদানিপণ্যের। এদিকে আমদানিপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় টান পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রায়। সব দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ইতোমধ্যেই। কিন্তু সরকারের এইসব প্রচেষ্টা বাংলাদেশকে সঙ্কটের হাত থেকে কতটা বাঁচাতে পারবে সে প্রশ্ন করছেন অনেকেই।

সাম্প্রতিক করোনা মহামারির কারণে অনেক দেশের অর্থনীতিই ঝুঁকির মুখে পড়তে শুরু করে। কিন্তু সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে এই মহাদুর্যোগের সময়ও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নতুন নতুন রেকর্ড হতে থাকে। তবে অতিসম্প্রতি অনেকটা হঠাৎ করেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রিজার্ভ কমে যায়। এতে শঙ্কা তৈরি হতে থাকে মানুষের মাঝে। সরকার অবশ্য রিজার্ভ কমে যাওয়ার একটা ব্যাখ্যা দেয়। কয়েক মাসের আমদানি ব্যয় শোধ করার কারণে রিজার্ভ সাময়িক নিচে নেমে যায় বলে উল্লেখ করে সরকার। তবে আশার কথা, সরকার শুধু এমন ব্যাখ্যা দিয়েই থেমে যায়নি। সম্ভাব্য সঙ্কট মোকাবিলায় গ্রহণ করা হয় বেশ কিছু পদক্ষেপ।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সরকার জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি খরচে বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু এরপরও দেখা গেছে প্রকল্পের খরচ বা অন্য খরচ দেখিয়ে সরকারি অনেক কর্তাব্যক্তিকেই বিদেশ সফরের পরিকল্পনা করতে। এমনও দেখা গেছে, বিদেশ থেকে ‘শিক্ষা সফর’ শেষ করে দেশে এসেই এলপিআরে গেছেন সরকারি কর্মকর্তা। এসব ‘শিক্ষা’ দেশের যে কোনো কাজে আসবে না তা বলাই বাহুল্য। যেসব কর্মকর্তা প্রকল্পের খরচকে সরকারি খরচ নয় বলে সঙ্কটকালেও নিজেদের বিদেশ সফরের আকাঙ্খা দমন করতে পারছেন না বা যিনি অবসরে যাওয়ার আগেও সরকারি খরচে বিদেশে শিক্ষা সফরে যান তাদের স্বদেশপ্রেমের ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে। তবে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে সরকারের পদক্ষেপের ফলে এই মুহূর্তের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এসব ব্যাপারে সরকারের কঠোর নজরদারির পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ব্যক্তিগত খরচেও যেকোনো নাগরিককে বিদেশ সফরে নিরুৎসাহিত করা উচিত। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে সরকারি আর ব্যক্তিগত বলতে কিছু নেই। কোনো ব্যক্তি নিজ খরচে বিদেশ গেলেও তিনি সরকারের রিজার্ভই ধ্বংস করেন। একইভাবে নিজের টাকায় বিদেশি পণ্য ব্যবহার করলেও সরকারের রিজার্ভ থেকেই সে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছু ভোগ্যপণ্য, কাঁচামাল ও তেলের দাম বেড়ে গেছে। বেড়েছে পণ্য পরিবহন ব্যয়ও। যার ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে আগের তুলনায় অনেক। স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর। আমাদের দেশে আমদানি-রফতানি আয়ের সমতা কোনো কালেই ছিল না। রফতানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় সব সময়ই বেশি। এ দুটোতে যে ব্যবধান তার মধ্যে সমতা রক্ষা করে প্রবাসী আয়। কিন্তু এই ব্যবধান যদি অনেক বেড়ে যায় তাহলে শুধু প্রবাসী আয় দিয়ে আর সমতা রক্ষা করা যাবে না। উদ্বেগটা আসলে এ কারণেই। তবে আশার কথা হলো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে সরকার আরও একটি ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পেঁয়াজ, ফুল, ফল, আসবাবপত্রসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী ১৩৫টি পণ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। চিনি, পেঁয়াজ, গাড়ি, অপরিশোধিত সরিষার তেলসহ আরও কিছু পণ্যের ওপর আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ছিল। এটিও সরকারের অত্যন্ত সুচিন্তিত পদক্ষেপ। কারণ দেশি পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানির প্রয়োজন একেবারেই নেই। অনেক জাতের ফুল এখন দেশেই উৎপন্ন হচ্ছে। ফলের বাজার ভরা দেশীয় নানা জাতের ফলে। দেশে উৎপাদিত চিনি মজুদ রয়েছে প্রচুর। এসব পণ্য ছাড়া আরও যেসব জিনিসের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে সেগুলো কোনোটিই এ মুহূর্তে আমদানি জরুরি না। অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে দাম বাড়বে এসব পণ্যের, মানুষ আগ্রহ হারাবে এগুলো ব্যবহারে এবং বাঁচবে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা।

একসময় প্রবাসীদের বেশিরভাগ অর্থ আসত হুন্ডির মাধ্যমে। এতে একদিকে বঞ্চিত হতো দেশ, অন্যদিকে এর মাধ্যমে হতো অর্থ পাচার। প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠালে দেশে যে পরিমাণ টাকা আসত, হুন্ডির মাধ্যমে পাঠালে দেশে স্বজনরা পেত তার চেয়ে বেশি টাকা। স্বাভাবিকভাবেই হুন্ডির দিকে ঝুঁকে গিয়েছিল অর্থনীতির মারপ্যাঁচ না বোঝা অনেক প্রবাসী কর্মী। একপর্যায়ে হুন্ডি নিরুৎসাহিত করতে রেমিট্যান্সের ওপর প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে সরকার। দুই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া শুরু হলে হুন্ডি অনেকটাই কমে আসতে থাকে। বর্তমানে পরিকল্পনা চলছে প্রণোদনার অঙ্ক বাড়িয়ে দেওয়ার। এতে প্রবাসীরা বৈধ উপায়ে দেশে আরও বেশি অর্থ পাঠাতে আগ্রহী হবে, সন্দেহ নেই। ফল স্বরূপ বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে যেমনি মানুষ শঙ্কিত হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, তেমনি রিজার্ভ আবার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরে আসায় সরকারে এবং মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে। এ ছাড়া কিছুদিন পরে কোরবানির ঈদ চলে এলে রেমিটেন্স আরও বাড়বে বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে এই স্বস্তিতে লাগাম ছেড়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মাত্র এই দুটি দেশ থেকে সরবরাহ কমে যাওয়ায় অনেক পণ্যের মূল্য বাড়তে শুরু করেছে। আগামীতে এই যুদ্ধের প্রভাব আরও কোনো দেশের ওপর পড়তে শুরু করলে তাতে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে সন্দেহ নেই। আমরা জানি যে, বৈশ্বিক এই সঙ্কটের সময়ও আমরা নিরুদ্বিগ্ন থাকতে পারছি দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। প্রবাসী আয় ও পোশাক রফতানি। করোনাকালে পোশাক রফতানির ওপর কিছুটা খারাপ প্রভাব পড়লেও করোনার প্রকোপ কমে আসতেই আমরা এ সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। অন্যদিকে আমাদের ভাগ্য ভালো যে এ পর্যন্ত যুদ্ধে যে দুটি দেশ জড়িয়েছে তাদের কারও ওপরই আমরা প্রবাসী আয়ে সামান্যতম নির্ভরশীল না। আগামীতে আরও কোনো দেশ যুদ্ধে জড়াক তা কেউই চায় না। তারপরও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিটেন্স আসে এমন কোনো দেশ যদি এই যুদ্ধে জড়িয়ে যায় তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সে জন্যও সতর্ক থাকতে হবে আমাদের।

কদিন আগে ভারতের একটি বাংলা পোর্টালে দেখলাম, তাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কার পরিণতি বরণ করে কি না সে নিয়ে তারা মহা দুশ্চিন্তায়! শুধু কি তারা, বাংলাদেশের অনেকেই এ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় আছেন, আবার কেউ কেউ আছেন বেশ উৎফুল্ল। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হোক অথবা উৎফুল্ল হোক, তাদের হিসাব-নিকাশে বেশ গণ্ডগোল আছে। বাংলাদেশকে কোনোভাবেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মেলানোর সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশের রিজার্ভ এক মাসে চার বিলিয়ন ডলার কমে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলারে, যা আবার বাড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ বলতে গেলে খালি। বাংলাদেশ বছরে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করে, যা জিডিপির মাত্র ২২ শতাংশ। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার ঋণের পরিমাণ তাদের জিডিপির প্রায় ১০৪ শতাংশ। অর্থনীতির সূত্র অনুসারে, এর পরিমাণ জিডিপির ৬০ শতাংশ থাকলেই তাকে সহনীয় বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে করোনাকালীন সময়ে শ্রীলঙ্কার রেমিট্যান্স ও পর্যটন খাত স্থবির হয়ে পড়ে। কিন্তু করোনাকালে বাংলাদেশের এ দুটি খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা বিদেশি ঋণে যেসব মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে তা তাদের অর্থনীতির জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি। এ ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থা ভিন্ন। বাংলাদেশ বিদেশি ঋণে এবং নিজস্ব অর্থায়নে যেসব মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে তার সবগুলোই দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অতএব এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

তবে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে না এ কথা যেমন জোর দিয়ে বলা যায়, তেমনি বৈশ্বিক সঙ্কট যে বাংলাদেশকে একেবারেই স্পর্শ করবে না এমনটা কিন্তু জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আঁচ সাধারণ মানুষ ইতোমধ্যেই বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করা শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে এ দিকটায়ও নজর দিতে হবে। নইলে শুধু রিজার্ভ অক্ষুন্ন বা বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের কোনো লাভই হবে না।

লেখক: সাংবাদিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

জহিরুল ইসলাম বৈশ্বিক সঙ্কট: বাংলাদেশ কোন পথে মত-দ্বিমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর