জ্ঞান ও উন্নয়নে গবেষণায় উদাসীনতা কেন
৩০ মে ২০২২ ১১:৩০
সমাজকে গভীরভাবে জানার একমাত্র পন্থা গবেষণা। উদ্ভূত কোনো সমস্যা অনুধাবন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যম গবেষণা। তেমনি বিদ্যমান অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন তথা উন্নয়নের প্রশ্নে এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। গবেষণা ছাড়া কোনো জাতি তার নিজ সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে পারে না; উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর প্রাক্কালে তা পরিলক্ষিত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ অপেক্ষা বেশ কয়েক মাস পর এ মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটলেও বাংলাদেশ গবেষণা বা পূর্বপরিকল্পনার অভাবে কিংবা বলা যায় মহামারীর ব্যাপকতা অনুধাবনে ব্যর্থতার দরুন শুরু থেকেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে লকডাউন, টিকা ব্যবস্থাপনা ও পরিবহন/চলাচল নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে। বড় বড় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করা হয় না এখানে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফল তাই কাঙ্ক্ষিত হয় না। তার পরও আমাদের বোধোদয় হয় না।
অথচ গবেষণা ছাড়া উন্নত দেশগুলো না নিজেদের ইতিহাস জানে, না বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে। বাংলাদেশে ইতিহাস, গবেষণা বা জ্ঞান অন্বেষণ প্রসঙ্গে ডাচ ইতিহাসবিদ-বাংলাদেশ গবেষক উইলেম ভ্যান শেন্ডেলের মূল্যায়ন যথার্থ। তিনি ‘ফ্রান্সিস বুকানন ইন সাউথইস্ট বেঙ্গল ১৭৯৮’ গ্রন্থে (১৯৯২) যথাযথভাবে উল্লেখ করেছেন, সমসাময়িক বাংলাদেশকে ঘিরে থাকা অনেক সমস্যার মধ্যে উন্নয়ন ও দারিদ্র্য সম্ভবত সবচেয়ে বেশি জরুরি। তবে অনুন্নয়নের আরেকটি দিক, যা প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়, তা হলো ‘জ্ঞানের অনুন্নয়ন’ (আন্ডার ডেভেলপমেন্ট অব নলেজ)। ‘ঐতিহাসিক জ্ঞানের (হিস্টোরিক্যাল নলেজ) ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে স্পষ্ট।’ ফলে অনুন্নয়ন মোকাবেলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতিগুলো গৃহীত হয় সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত বোঝাবুঝির ওপর ভিত্তি করে। গবেষণা বা প্রকৃত অন্তর্দৃষ্টির স্থলে প্রাধান্য পায় অনুমান। ভ্যান সেন্ডেলের মতে, এটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গবেষণার অনুন্নয়নের ফল। দুঃখজনক হলেও উন্নয়ন পরিকল্পনাবিদরাও মনে করেন, ‘ঐতিহাসিক গবেষণা বিলাসিতা থেকে একটু বেশি।’ অথচ উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, দেশকে জানতে হলে, দেশের ইতিহাস ও সমস্যাদি বুঝতে হলে এবং সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করার পূর্বশর্ত হিসেবে ঐতিহাসিক জ্ঞান ও গবেষণা অনস্বীকার্য।
একথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, যেখানে শিক্ষার অন্যান্য স্তরে জ্ঞান বিতরণই মুখ্য কাজ সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি জ্ঞান সৃজন। আর গবেষণাই হলো জ্ঞান সৃজনের প্রধান উপায়। তাছাড়া যে কোনো দেশের সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি তথা সামগ্রিক জনজীবনের চাকা সচল রাখতে হলে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। এ কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই নিতে হয়। এর পাশাপাশি এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ শুধু একটা উন্নয়নশীল দেশ নয়, এর অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল অর্থনীতিগুলোর একটি। স্বল্প সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন করে ২০৪১ সালের মধ্যে একটা উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া তার লক্ষ্য। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে যে উন্নত জ্ঞান, প্রযুক্তি- সর্বোপরি জনবল প্রয়োজন তার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় প্রচুর নিজস্ব গবেষণা দরকার। বলাবাহুল্য, বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই জ্ঞান-প্রযুক্তি ও জনবল সৃষ্টি করতে না পারলে বাংলাদেশকে অন্য অনেক দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ‘ফাঁদে’ আটকে থাকতে হবে। তাই, বিবিএসের ওই সমীক্ষাকে একটা জেগে ওঠার আহ্বান হিসেবে নিয়ে এখনই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের তৎপর হতে হবে। তাদের একদিকে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর জনদাবির প্রতি দ্রুত সাড়া দিতে হবে, আরেকদিকে এ অর্থের সঠিক ব্যবহারের বিষয়টিও নিবিড়ভাবে তদারকি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা বিশেষভাবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কথা বলব দেশের সব পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো-মন্দ দেখভাল করা যাদের দায়িত্ব।
তথ্য বিন্যস্তকরণ ও নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য উপকরণ ও উৎসগুলোর মধ্যে পদ্ধতিগত অনুসন্ধান ও অধ্যয়নই গবেষণার মুল কাজ। গবেষণার মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান সমস্যাদির প্রকৃতি ও গভীরতা জানা যায় এবং একই সঙ্গে সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য পন্থা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। সামাজিক সমস্যাদি বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ক মেরামত করে, যা স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য তথা মানুষে মানুষে সম্পর্ক বিধানে গবেষণা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। গবেষণার মাধ্যমে অতীত সর্বদা বর্তমান থাকে, ফলে কোনো জাতিকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয় না। উন্নত দেশগুলোয় তাই অতীত নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক বা তথ্যবিভ্রাট নেই; যতটা বাংলাদেশের মতো অ-উন্নত দেশে দেখা যায়। তাছাড়া গবেষণার মাধ্যমে খাদ্যের উপকারিতা ও সংকট, মানুষের আচরণ, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদি দিক সম্পর্কে জানা যায়। গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞান, চিন্তা ও আবিষ্কার ঘটে। এতে বর্তমান বিশ্বে চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। করোনা পরিস্থিতিতে গবেষণার উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা আরো প্রকটভাবে উপলব্ধ হয়েছে। গবেষণার ফলে ভাইরাসের নানা প্রকরণ ও গতি-প্রকৃতি যেমন জানা গেছে, তেমনি ওষুধসহ টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। যদি গবেষণালব্ধ উপায়ে টিকা আবিষ্কার করা সম্ভব না হতো, এ মহামারীর পরিণতি লেখা বা পড়ার জন্য মানুষ জীবিত থাকত কিনা বলা মুশকিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশসহ সর্বত্র এখন গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকবার গবেষণার ওপর মনোযোগ দেয়ার জন্য শিক্ষক, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানিয়েছেন।
সামাজিক গবেষণা ছাড়াও গবেষণার অন্যতম ক্ষেত্র হলো প্রাণী হিসেবে মানুষ ও প্রকৃতির সহসম্পর্ক স্থাপন, অনুধাবন ও প্রয়োজনে মেরামতকরণ। জৈবিক প্রাণী হিসেবে মানুষের কী করণীয়, কী খাওয়া উচিত, কী করা উচিত কিংবা কোনো রোগব্যাধি হলে উপশম কী এবং নিরাময় ও প্রতিরোধের উপায়ান্তর ইত্যাদির জন্য গবেষণার ওপর নির্ভর করতে হয়। যে দেশ যত বেশি গবেষণানির্ভর, সে দেশ তত বেশি অগ্রসরমাণ। যে দেশে যত বেশি গবেষণার জন্য আর্থিক প্রণোদনাসহ অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়, সে দেশ তত বেশি সমৃদ্ধ। যেমন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ইত্যাদি দেশে পুনঃপুন গবেষণা ছাড়া অপেক্ষাকৃত ছোট বিষয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় না। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে যেসব দেশে বার্ষিক ৫০ মিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় করা হয়, সে রকম ৯০টি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান থাকলেও বাংলাদেশ বরাবরের মতোই অনুপস্থিত। বাংলাদেশে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় না। শিক্ষার বাজেট জিডিপির ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, যেখানে ইউনেস্কোর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে অন্তত জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখা উচিত। সুতরাং গবেষণার প্রণোদনা সহজেই অনুমেয়।
বাংলাদেশের গবেষণার অন্যতম সমস্যা সঠিক বণ্টন না হওয়া এবং যোগ্য ব্যক্তিকে গবেষণার সুযোগ না দেয়া। আর্থিক বরাদ্দ যা-ই থাকুক না কেন, তার যথাযথ ব্যবহারই মূল চ্যালেঞ্জ। বরাদ্দকৃত অর্থ সত্যিকার অর্থে গবেষণা খাতে যথাযথভাবে ব্যয় হয় না; এমনকি অব্যয়িত থেকে যায়। করোনা পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে গবেষণার জন্য (সমন্বিত স্বাস্থ্যবিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল) ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। বছর শেষে জানা যায়, গবেষণার জন্য একটি টাকাও ব্যয় করা হয়নি। যে সময়ে কিনা গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি অনুভূত, সে সময়েও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও গবেষণার আবশ্যকতা উপলব্ধি করতে না পারার কারণে গবেষণা সম্পন্ন হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন গবেষণা সংস্থায় সীমিত আর্থিক প্রণোদনা ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা থাকলেও আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক কারণে সঠিকভাবে তা পরিচালিত হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রম সম্পর্কে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২০ সালে পরিচালিত এবং সম্প্রতি প্রকাশিত এক সমীক্ষার বরাত দিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে হতাশাব্যঞ্জক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজেদেরই দেওয়া তথ্য থেকে বিবিএস জানতে পেরেছে, দেশের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে এক টাকাও খরচ করেনি। শুধু তাই নয়, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় জমি কেনা ও ভবন নির্মাণের মতো সম্পর্কহীন খরচও গবেষণা খাতে দেখিয়েছে। দেশে গবেষণা খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল বলে বহু বছর ধরেই আলোচনা আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি এ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর যেমন চাপ বাড়ছে, তেমনি সরকারও গবেষণায় বর্ধিত হারে অনুদান প্রদানে এগিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন বেসরকারি উদ্যোক্তার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। আর এমন এক সময়ে প্রকাশিত হলো গবেষণা কাজে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন উদাসীনতার চিত্র। যদি অল্প বরাদ্দই খরচ করা না যায়, তাহলে গবেষণা খাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অধিক বরাদ্দ দিতে সমাজে কেন উৎসাহ সৃষ্টি হবে? তাই বিবিএস উদ্ঘাটিত এই তথ্য অতীব উদ্বেগজনক।
গবেষণার প্রতি এমন উদাসীনতা প্রদর্শনকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম বিবিএস প্রকাশ না করলেও তাদের সমীক্ষা থেকে এটা জানা গেছে যে, ওই ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আর ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থাৎ গবেষণার প্রতি অবহেলা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি দেখা যায়। এ ধারণাটা আরও বদ্ধমূল হয় যখন বিবিএসের ওই সমীক্ষায় বলা হয় যে, জমি কেনা বা ভবন নির্মাণের মতো উচ্চ ব্যয় গবেষণা খাতে দেখানোর প্রবণতা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই বেশি। আমরা জানি, দেশের কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা কাজে ইতোমধ্যে শুধু জাতীয় নয় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বেশ সুনাম অর্জন করেছে। তা সত্ত্বেও বিবিএসের সমীক্ষায় বর্ণিত গবেষণা কাজে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশি অমনোযোগী হওয়ার বিষয়টা এখানে তুলে ধরা হলো; কারণ এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে এ খাতের যাত্রা থেকেই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার চেয়ে ব্যবসার প্রতি বেশি মনোযোগী বলে যে সাধারণ সমালোচনা আছে তা-ই আরও শক্তিশালী হবে। এমন অবস্থা উচ্চশিক্ষা বিস্তারে প্রচুর সম্ভাবনাময় এ খাতটির জন্য তো বটেই, দেশের সামগ্রিক উচ্চশিক্ষা খাতের জন্যও শুভকর হবে না। তবে যাদের ভালো ভালো গবেষণা ও প্রকাশনা রয়েছে, তাদের মূল্যায়ন করার রীতি প্রচলিত নেই; যা গবেষণাকর্মকে উৎসাহিত করতে পারত।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক প্রণোদনা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন বা জাপানের মতো বরাদ্দ দেয়া সম্ভব না হলেও যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়, সেটিও যদি সঠিক পথে এবং উপযুক্ত গবেষকদের দ্বারা সম্পন্ন করা হতো তাহলে গবেষণায় বাংলাদেশ এতটা পিছিয়ে পড়ত না। তাই আর্থিক প্রণোদনা অপেক্ষা সঠিক ব্যক্তির কাছে গবেষণার ভার যাচ্ছে কিনা, সেটাই আমার কাছে বড় সমস্যা বলে মনে হয়। এ দিকটির ওপর অধিক মনোযোগ অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো অধ্যাপক-গবেষক রয়েছেন, যারা আর্থিক প্রণোদনা, মূল্যায়ন এবং নিরাপত্তা বা স্বাধীনতার অভাবে গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
বর্তমান প্রজন্মকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান ও ধারণার জন্ম হবে, সমাজে বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য গবেষণালব্ধ সমাধান আসবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে টিকে থাকার কৌশল গবেষণা ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে নির্ণীত হবে। কী বা কেমন পরিস্থিতি দেশ ও বিশ্ববাসীকে সামনে মোকাবেলা করতে হবে তাও উদ্ঘাটিত হবে গবেষণার মাধ্যমে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হলে বিশ্ববাজারে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়বে বাংলাদেশের মতো গবেষণাবিমুখ দেশের। পৃথিবী আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিবর্তনশীল। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে অর্জিত শিক্ষা কয়েক বছর পরপর অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পুরনো দক্ষতা বর্তমানের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় সমাজের সব খাতের সুষম ও সমন্বিত বিকাশের জন্য পুনঃপুন গবেষণা অপরিহার্য।
বাংলাদেশে পরিকল্পনা বা গবেষণার স্বরূপ বোঝা যায় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও পরিণতি দেখে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক, চট্টগ্রাম শহরের মাঝখানে একটি বিশালাকৃতির ফ্লাইওভার তৈরির কাজ চলেছে প্রায় বছরখানেক। এতে নগরবাসীর কী কষ্ট তা ভাবার কারো ফুরসত নেই, সেটা মানতে নগরবাসী বাধ্য, যেহেতু বাংলাদেশের জন্য তা খুবই ‘মামুলি’ ব্যাপার। কিন্তু কিছুদিন পর কাজ চলাকালীন দেখা গেল ফ্লাইওভারের পরিকল্পনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। নাগরিকদের কী এল গেল, দেশের অর্থের কী সংস্থান হলো, সেটা নিয়ে না-হয় আবার পরিকল্পনা করা যাবে! দুবার জোড়াতালির পর দেখা গেল পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না রাখায় সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরবাসী দোতলা নদী দেখার সুযোগ পায়। এখন যানজট বা জলজটের জন্য কেবল ভাঙা রাস্তাকে এককভাবে দোষারোপ করা হয় না; এখন সড়ক ছাড়াও রাস্তা থেকে বেশ উঁচুতে অবস্থিত ফ্লাইওভারেও যানজট ও জলজট ঘটতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসাসহ সমাজের নানা বিষয়, বিশেষ করে ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, খাদ্য ও পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর গবেষণার জন্য গুরুত্বারোপ করেছেন এবং আর্থিক প্রণোদনা বৃদ্ধি করে তা সহজতর করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন। জাতিকে গবেষণামুখী করার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি গবেষকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণার ফলের জন্য যদি গবেষককে ভুগতে হয়, মন্ত্রণালয় কিংবা আদালতে যদি হাজিরা দিতে হয়, তাহলে গবেষকরা নিরুৎসাহিত হবেন। গবেষণার গুণগত মান রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট গবেষককেও নির্মোহ, নির্দলীয় ও সৎ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
যেমনটা শুরুতে ভ্যান শেন্ডেলের বক্তব্য থেকে উল্লেখ করা হয়েছিল, গবেষণা কেবল বর্তমানের জন্য নয় কিংবা বর্তমান সময়ে মানবশরীর, স্বাস্থ্য ও মানবসমাজের জন্য পরিচালিত হয় না। বর্তমানকে ভালোভাবে জানতে হলে এবং ভবিষ্যতে ভালোভাবে বুঝতে হলে অতীত নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করতে হয়। ভবিষ্যতের সমাজ নিয়েও গবেষণা করতে হয়। যে দেশে অতীত ও বর্তমান নিয়ে যত বেশি গবেষণা, সে দেশের ভবিষ্যৎ তত বেশি পরিষ্কার। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অ-পশ্চিমা দেশগুলোয় যেখানে গবেষণাকর্ম নানাভাবে নিরুৎসাহিত বা বাধাগ্রস্ত, সেসব দেশের পক্ষে গবেষণানির্ভর পশ্চিমা ও উন্নত বিশ্বের পরিস্থিতি বা বাস্তবতা অনুভব করতে করতে কেবল দুই থেকে পাঁচ দশক পার হয়ে যায়। ফলে গবেষণানির্ভর উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে হাঁটা তো দূরের কথা, অনেক সময় তাদের অনুকরণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এমন বাস্তবতায় সমাজ বিকাশের চিরায়ত তত্ত্ব যেন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।
বিদ্যমান বাস্তবতায় গবেষণায় বেশি মনোনিবেশ করতে হবে। নিজেকে জানার জন্য, দেশকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য; গবেষণা ছাড়া যা কোনো দিন সম্ভব নয়। গবেষণা জ্ঞান তৈরি, সমস্যা অনুধাবন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ব্যবসার প্রসার, মানুষের চাহিদা ও আচরণ বোঝার জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। গবেষণার মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা ও সঠিক-ভ্রান্ত ইতিহাস জানা যায়। এমনকি খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, প্রেম, ভালোবাসা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়াদি সম্পর্কেও সঠিক ধারণা পাওয়ার প্রধানতম উপায় গবেষণা। তাই গবেষণায় উদাসীনতা মানে নিজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যেক অবহেলা করা। অনেক অবহেলা হয়েছে, আর নয়। এখন গবেষণানির্ভর সমাজ নির্মাণ সময়ের প্রয়োজন।
লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
জ্ঞান ও উন্নয়নে গবেষণায় উদাসীনতা কেন ড. আলা উদ্দিন মত-দ্বিমত