ভূমিহীনদের কীভাবে গুনবে ডিজিটাল জনশুমারি?
৪ জুন ২০২২ ১৫:৪২
করোনা মহামারী যখন শুরু হলো তখন আমরা করোনা-উত্তর পৃথিবীর নানা সংকট নিয়ে আলাপ তুলেছিলাম। উৎপাদন, জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, মনস্তত্ত্ব, প্রযুক্তি, ক্ষমতা ও শ্রেণি কিংবা প্রতিদিনের দিনপঞ্জি হঠাৎ বদলে যাওয়া। কিন্তু আমরা প্রস্তুত ছিলাম না যে মহামারী-উত্তর পৃথিবীকে বেসামাল করবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কিংবা অস্থির বাজার। এমনি এক করোনা-উত্তর পৃথিবীকে বাংলাদেশ শোনাতে চাইছে দুই আশাজাগানিয়া গান। এ জুনেই বাংলাদেশে ঘটতে যাচ্ছে দুই স্মরণীয় ঘটনা। স্বপ্ন-ঘামের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি দেশের প্রথম ‘ডিজিটাল জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ সংগঠিত হবে ১৫-২১ জুন।
নানাদিক থেকেই এই জনশুমারি গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জনশুমারি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, দীর্ঘদিন চলেছিল ‘আদমশুমারি’। অনেক আগে থেকেই নিজের সব লেখায় জনশুমারি ব্যবহার করে এসেছি বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি আপ্লুত। বিশেষ ধন্যবাদ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে। নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার দায়িত্ব এই ডিজিটাল জনশুমারিকে সহযোগিতা করা এবং একে সফল করে তোলা। রাষ্ট্রীয় এই জনগুরুত্বপূর্ণ কাজটি সফল করে তোলার ক্ষেত্রে হয়তো সামাল দিতে হবে নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জ। চলতি আলাপখানি অতি নগণ্য এক সংকটের কথা তুলে ধরছে।
রাজশাহীর তানোরের পাঁচন্দর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে ২০২২ সালের ১৮ মে বুলডোজার দিয়ে একটি পাড়া নির্মমভাবে ভেঙেচুরে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার ভিডিও ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ঘরের টিন, বেড়া ভেঙেচুরে দেওয়া হচ্ছে। দুমড়ে-মুচড়ে উপড়ানো হচ্ছে গাছ। শিশু-নারী-পুরুষরা ছোটাছুটি করছেন। বুকভাসানো কান্না আর আতঙ্কে ঝিম হয়েছিল কৃষ্ণপুর। দেশসেরা সাংবাদিকদের অনেকেই রাজশাহী থাকেন। কিন্তু এ ঘটনায় কেন যেন নিশ্চুপ ছিল গণমাধ্যম, তাও আবার এমন এক মাসে যখন বিশ্বব্যাপী পালিত হয়েছে ‘বিশ্বমুক্ত গণমাধ্যম দিবস’। ঘর হারানো ভাসমান ত্রিশটি ভূমিহীন পরিবার কার্যত খোলা আকাশের তলে ছিলেন। দেশজুড়ে নিম্নবর্গের ভূমিহীনতার বিষয়টি জটিল এবং ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে প্রবলভাবেই জড়িত। চলতি আলাপ ঘর হারানো এই ভূমিহীন মানুষদের জন্য নতুন ঘর কিংবা খাসজমি বরাদ্দের দাবি জানাচ্ছে না। কিন্তু এই উদ্বাস্তু ভূমিহীনদের কীভাবে গুনবে দেশের প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি? রাষ্ট্রের প্রথম ডিজিটাল গৃহগণনায় ঘর হারানো এমন মানুষদের তথ্য কীভাবে নেবে সরকার?
নিরন্ন, অসহায় এই গরিব মানুষরা স্থানীয় সরকার কী প্রশাসনের কাছে দৌড়ে গেছেন। কিন্তু কেউ এখনো তাদের একটু জায়গা বরাদ্দ দিতে পারেননি। যখন পদ্মা সেতুর গর্বে উৎসবে মাতবে দেশ, শুরু হবে দেশের প্রথম ডিজিটাল জনশুমারি, তখন উদ্বাস্তু কিছু মানুষ আজন্ম দুঃখ নিয়ে সবকিছু থেকে পিছিয়ে থাকবে। আমরা কেউ এই পরিস্থিতি চাই না। দেশে কেউ পিছিয়ে বা আড়ালে থাকবে না, এই তো সরকারের উন্নয়নচিন্তা। তাহলে কারা, কেন, কীভাবে এই উন্নয়নচিন্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে? এর উত্তর রাজনৈতিকভাবে মানবিক মন নিয়ে আমাদের খোঁজা জরুরি। আমরা বিশ্বাস করি তানোর কী রাজশাহীর স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন চাইলেই কাজটি নিমিষে করতে পারেন। অন্তত ১৫ জুনের আগে ঘরহারা এই পরিবারগুলোর মাথার ওপর ছাউনি ও পায়ের তলায় মাটি নিশ্চিত করতে পারেন।
কী ঘটেছে কৃষ্ণপুরে?
কোনো এলাকার বসতি স্থাপনের ইতিহাস, রাজনীতি, প্রতিবেশব্যবস্থা, উৎপাদন সম্পর্ক বুঝতে সেখানকার স্থান নাম খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বরেন্দ্র এলাকায় বেশ কিছু গ্রামের নাম আছে ‘হঠাৎ পাড়া’। হঠাৎ পাড়াগুলোর সঙ্গে তেভাগা আন্দোলন, দেশভাগ, দারুসা দাঙ্গা, মুক্তিযুদ্ধ, অর্পিত সম্পত্তি এবং খাসজমি বণ্টন এ রকম নানা কিছু জড়িয়ে আছে। চলতি আলাপে উল্লিখিত তানোরের পাঁচন্দর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর দক্ষিণপাড়া এমনি এক হঠাৎ পাড়া, কারও কাছে বেলপুকুর নামেও পরিচিত। ২০১৩ সালে এই কৃষ্ণপুর দক্ষিণ হঠাৎপাড়ায় ভূমিহীন ১৬টি বাঙালি ও ১৪টি আদিবাসী কর্মকার পরিবার বসতি স্থাপন করে। কারণ তারা মানুষের কাছ থেকে শুনেছিল এই জায়গা খাসজমি। ভূমিহীন পরিবারগুলো নয়া বসতি স্থাপনের পর থেকে ওই জায়গা দখল নিতে কৃষ্ণপুরের মো. দেলোয়ার হোসেন আদালতে মামলা করেন। করোনা মহামারীর কারণে ভূমিহীন পরিবারের কেউ আদালতে যেতে পারেননি। আদালতের রায় নিয়ে ১৮ মে ২০২২ তারিখে মো. দেলোয়ার হোসেন ৩০ পরিবারের ঘরবাড়ি ভেঙে তাদের উচ্ছেদ করেন। কিন্তু এই ভূমিহীন পরিবারগুলো তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর এ জায়গার সুরাহার জন্য ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে লিখিতভাবে অবহিত করেছিলেন।
উদ্বাস্তু কর্মকার পরিবারগুলোর ভেতর যামিনী রানী কর্মকার বয়সে প্রবীণ। পাকলু রানী ও বাবুলাল কর্মকারের মেয়ে যামিনীর জন্ম কৃষ্ণপুরেই। বিয়ে হয়েছে রবি কর্মকারের ছেলে সতীশ কর্মকারের সঙ্গে। সতীশের পুত্র শ্যামল কর্মকার। বয়স্ক মা ভারতী রানী, স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ঘটনার দিন অনেকের সঙ্গে উদ্বাস্তু হয়েছেন এই গরিব কৃষিশ্রমিক। উদ্বাস্তু কর্মকার আদিবাসীদের প্রায় সবাই কৃষ্ণপুর গ্রামেই জন্ম নিয়েছেন। কারও কারও কিছু জমি ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর আর জমি ফেরত পাননি। এ ছাড়া অধিকাংশ পরিবারই কার্যত ভূমিহীন।
তানোরের মুণডুশালা তহসিল অফিসের সূত্র উল্লেখ করে দৈনিক উপচার জানিয়েছে, ৯৮ নম্বর কৃষ্ণপুর মৌজার ১২৯ আরএস খতিয়ানে ১২৩৪ আরএস দাগে ধানি জমি রয়েছে ১ একর ৬৪ শতাংশ। আরএস রেকর্ডীয় মালিক মহানন্দ সরকারের পুত্র কুঞ্জ মোহন সরকার সাং ভারত পক্ষে বাংলাদেশ সরকার। ২০১৪ সালে জমিটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত হয়। কিন্তু জায়গাটি দখল পাওয়ার জন্য আদালতে মামলা করেন মো. দেলোয়ার হোসেন এবং মামলায় তিনি রায় পান। ভূমিহীন পরিবারগুলো আদালতে আপিল করেন, যা বিচারাধীন (সূত্র : ২১ মে ২০২২)। যদিও আদালতের একটি রায়ের কপি দেখিয়েই মো. দেলোয়ার হোসেন ভূমিহীনদের বসতবাড়ি ভেঙে তাদের উচ্ছেদ করেন। দৈনিক উপচার ১৯ মে ২০২২ মুণডুমালা তহসিল অফিসে খোঁজ নিয়ে জেনেছে উল্লিখিত জমিটি অর্পিত সম্পত্তি, এর জমির কোনো খাজনা-রসিদ কিংবা নামজারি নেই। কীভাবে এ জমি বেচাকেনা হলো এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মুণডুমালা তহসিল অফিস। উচ্ছেদের ঘটনাটি বেশ আতঙ্ক এবং মনস্তাত্ত্বিক আঘাত তৈরি করেছে শিশু, নারী ও প্রবীণজনের মনে। উচ্ছেদের পর ঘরভাঙা মানুষের পাশাপাশি হাঁস-মুরগিগুলো এদিক-ওদিক ছুটছিল। উদ্বাস্তু মানুষেরা সারা রাত খোলা আকাশের নিচে কাটিয়ে সকালে তানোর উপজেলা চত্বরে গিয়েছিলেন। তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাদের সরকারি খাসজমি বন্দোবস্ত করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। অনেক ঝক্কিঝামেলার পর স্থানীয় এক পরিত্যক্ত মাদ্রাসা ঘর আর পাশের এক কর্মকারপাড়ায় কোনোমতে আশ্রয় নেয় অনেকে। ৩১/৫/২০২২ তারিখে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীনরা। এখানেও খাসজমি বন্দোবস্ত করে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে বাড়ছে সংকট। অস্থায়ী আশ্রয়ে কর্মসংস্থান, খাদ্য, পয়ঃনিষ্কাশন, পানীয় জল, পড়াশোনা, বিশ্রামের জায়গা সবকিছুরই অভাব।
জাতীয় তথ্য বাতায়ন কী বলে?
জাতীয় তথ্য বাতায়ন জানাচ্ছে, তানোর উপজেলার আয়তন ৭২,৯৯৪ একর। মোট ২১০টি গ্রামের ২১২টি মৌজার ভেতর ৬টি মৌজা জনবসতিহীন। উপজেলায় মোট খাসজমির পরিমাণ ২৮৪০.১৪৮৫ একর। বন্দোবস্তযোগ্য খাসজমির পরিমাণ ২৬.২৮৩৩ একর এবং বন্দোবস্তকৃত খাসজমির পরিমাণ ৯০৬.২৬৬৭ একর। সরকারি হিসাবে তানোরে মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ ভূমিহীন। কৃষ্ণপুর দক্ষিণ হঠাৎপাড়া তানোরের পাঁচন্দর ইউনিয়নে অবস্থিত। জাতীয় তথ্য বাতায়ন মতে, এই ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যা ২৪,৪৫২ জন। এর ভেতর ৫৫% মানুষ গরিব ও ভূমিহীন, ২৪% নিম্নমধ্যবিত্ত, ১৬% মধ্যবিত্ত এবং ৫% ধনী। পাঁচন্দর ইউনিয়ন পরিষদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ আছে, ‘আমাদের ইউপিতে হতদরিদ্রদের তালিকা আছে, বিস্তারিত তথ্য ইউপি চেয়ারম্যান মহোদয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে পরে এই পেজে তুলে ধরা হবে।’
পাঁচন্দর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মু. মিনারুল ইসলামের সঙ্গে ফোনে আলাপ হলে তিনি বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়ে জানালেন, কৃষ্ণপুর দক্ষিণ হঠাৎপাড়া থেকে সম্প্রতি উদ্বাস্তু হওয়া কর্মকার পরিবারগুলোর নাম তাদের ইউনিয়ন পরিষদের ‘হতদরিদ্র তালিকায়’ আছে। পাঁচন্দর ইউনিয়নে ১১,৯৫০ একর আবাদি জমি, ২০০ একর অনাবাদি জমি এবং ১০০টি খাস পুকুরের তথ্য উল্লেখ আছে। ইউনিয়ন পরিষদের ‘ভিজিডি কর্মসূচির জন্য উপকারভোগী মহিলা নির্বাচনের চূড়ান্ত তালিকা ২০১৯-২০’ বিশ্লেষণে দেখা যায়, শ্রীমতি মিনা রানী এই কাজ পেয়েছিলেন। মিনা রানী তার স্বামী নিপেন কর্মকারসহ পুরো পরিবার ঘটনার দিন উদ্বাস্তু হয়েছেন।
নতুন ঘরেই শুরু হোক নতুন জনশুমারি
জাতীয় তথ্য বাতায়ন বলছে, তানোরে খাসজমি আছে এবং বন্দোবস্ত দেওয়ার মতো খাসজমি আছে। সরকারের খাসজমি বন্দোবস্ত নীতিমালা অনুযায়ী চলতি আলাপে উল্লিখিত গরিব উদ্বাস্তু ভূমিহীন মানুষেরা এই জমি পাওয়ার অধিকার রাখেন। তানোর প্রশাসন এবং রাজশাহী জেলা প্রশাসক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ভূমি বন্দোবস্ত করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। খাসজমি, প্রশাসনের সদিচ্ছা এবং রাষ্ট্রীয় নীতি সবকিছুই এই ভূমিহীন উদ্বাস্তু মানুষদের পক্ষে। আশা করব দ্রুত তাদের একটি ঠিকানা নিশ্চিত হবে। ১৫ জুনের আগেই কাজটি শেষ হলে দেশের প্রথম ডিজিটাল জনশুমারিতে এই মানুষেরা নিজের ঘরের বারান্দায় বসে আনন্দ নিয়ে নাগরিক তথ্য পূরণে সহায়তা করতে পারবেন। ‘গৃহহীন নয়’, নতুন ঘরের ঠিকানা লিখিত হবে দেশের প্রথম ডিজিটাল গৃহগণনায়। আর এটি চাইলেই সম্ভব। কৃষ্ণপুরের খুব কাছেই, মুণডুমালা-তেলোপাড়ায় রাষ্ট্রীয় এক আশ্রয়ণ প্রকল্প আছে। সরকারিভাবে এখানে ৭ পরিবার মুন্ডা ও ৩ পরিবার সাঁওতাল আদিবাসীদের গৃহায়ণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি যে জমি থেকে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ হতে হলো এবং উচ্ছেদের ঘটনা সবকিছুই নিরপেক্ষ তদন্ত ও ন্যায়বিচারের আওতায় আনা জরুরি।
লেখক: প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ গবেষক ও লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
পাভেল পার্থ ভূমিহীনদের কীভাবে গুনবে ডিজিটাল জনশুমারি? মত-দ্বিমত