ছয় দফার জনমত গঠনে শেখ মণির দুঃসাহসিক ভূমিকা
৭ জুন ২০২২ ১৩:২৭
ছয় দফা— বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রামের চিন্তার ফসল। নিপীড়িত, অধিকার বঞ্চিত বাঙালির আত্মঅধিকার ও আত্ননিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছয় দফা প্রস্তুত করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট দ্বি—জাতির ভিত্তিতে জন্ম নেয় পাকিস্তান নামের একটি রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রের দুইটি প্রদেশে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই নানাবিধ বৈষম্য। শুধু ভৌগোলিক নয়, দূরত্ব ছিল চিন্তা—চেতনা, সংস্কৃতি, ভাষার ব্যবহার থেকে সবখানে। পাকিস্তান জন্মলাভের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত বাঙালিদের ওপর চালায় তারা ঔপনিবেশিক শোষণ ও শাসন। পাকিস্তানের এই বিমাতাসুলভ বৈষম্যমূলক আচরণ এবং বাঙালির ওপর প্রথম আঘাত আসে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে উপেক্ষা করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উর্দুকে পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার মধ্য দিয়ে।
বাঙালিদের ওপর পাকিস্তান সরকারের এই শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে ক্ষোভের দাবানল জ্বলে উঠে ক্রমাগত। ১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলসমূহের এক কনভেনশনে অংশগ্রহণ করে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । বাংলার জনগণকে বৈষম্যের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে ৫ই ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি।
যা ছিল ছয় দফায়:
১. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি: দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে, যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারী ধরনের। আইন পরিষদের (Legislatures) ক্ষমতা হবে সার্বভৌম এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে।
২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা: কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দু’টি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে— যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ—রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
৩. মুদ্রা বা অর্থ—সমন্ধীয় ক্ষমতা: মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দু’টির যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারে—
(ক) সমগ্র দেশের জন্যে দু’টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
অথবা (খ) বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবল মাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব—পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।
৪. রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা: ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ—রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
৫. বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:
(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
(খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে।
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে।
(ঘ) অঙ্গ—রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন রকম বাধা—নিষেধ থাকবে না।
(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব—স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
৬. আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা: আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ—রাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
কিন্তু উক্ত কনভেনশনের সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা দাবি নিয়ে আলোচনা করার অসম্মতি জানান। শুধু তাই নয় বরং পরেরদিন ৬ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন অনেক জাতীয় পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে আখ্যায়িত করে সংবাদ পরিবেশন করে । এই ঘটনায় বিস্মিত ও মর্মাহত হন বঙ্গবন্ধু। তিনি উক্ত কনভেনশন বয়কট করেন এবং ১১ ই ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে ফিরে এসে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন এবং ২০ শে ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করেন । ঐ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধুর পেশকৃত ৬ দফা সর্বসম্মতি ক্রমে অনুমোদিত হয় এবং দলীয় কর্মসূচি হিসাবে ৬ দফাকে গ্রহণ করা হয়।
১৯৬৬ সালের মার্চ মাসের ১৮ ,১৯ ও ২০ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে ৬ দফা দাবি সম্মিলিত ‘ছয় দফা’ প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্য বিশিষ্ট ‘উপ—কমিটি’ গঠন করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, তারই নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা মুদ্রিত ও প্রকাশ করার।
বাংলাদেশের ছাত্র ও যুব রাজনীতির অহংকার শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন এ আন্দোলনের একনিষ্ঠ ও সফল সংগঠক। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা কর্মসূচিকে জনপ্রিয় ও সফল করতে তিনি রেখেছেন যুগান্তকারী ভূমিকা। তার সেই সাহসী ভূমিকা এ প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠার ৪৯ বছরে প্রকাশিত ‘বিপ্লব ও মানবিকতা’ গ্রন্থে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, ষাটের দশকে ৬৪— ৬৫ সালে ডাকসুর জিএস অগ্নিকন্যাখ্যাত মতিয়া চৌধুরীর সাক্ষাৎকার, বিশিষ্ট শিক্ষা ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ড. মুহাম্মদ মনিরুল হকসহ বিশিষ্টজনদের লেখনীতে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ঐতিহাসিক ছয় দফার স্বপক্ষে জনমত গঠনে শেখ মণির অসামান্য অবদানের কথা।
শেখ মণি যদি নিজে সাংবাদিক ও লেখক না হতেন তাহলে ছয় দফা কর্মসূচির অনেক তথ্য আমাদের অজানাই থেকে যেতো। ‘ছেষট্টির সাত জুন—প্রস্তুতি পর্ব’ নিবন্ধ পাঠে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু জেলে থাকায় এবং মওলানা ভাসানীর ন্যাপসহ আরও কিছু সংগঠনের আপত্তি থাকায় ছয় দফার পক্ষে জনসমর্থন আদায় এবং হরতাল সফল করা ছিল অত্যন্ত কঠিন। ৭ জুন ১৯৭২ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে শেখ মণি লিখেছেন, ‘…জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু জানতে চেয়েছেন হরতালের প্রস্তুতি কত দূর? কী হলো? সেটি সম্পর্কে। গভীর রাতে পেছনের দেওয়াল টপকিয়ে ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গেলাম। মামিকে বিস্তারিতভাবে সবকিছু জানিয়ে বললাম রাতের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য। হরতাল হবেই।’ মানিক মামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি বললেন, ‘ইত্তেফাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও তিনি পিছপা হবেন না। শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য তিনি সবকিছু করবেন।’
৭ জুনের হরতালকে সফল করতে ঢাকা—নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকদের সংগঠিত করতে সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন শেখ ফজলুল হক মণি। ওই হরতালে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ কমপক্ষে ১১ জন বাঙালি শহীদ হয়েছেন। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ৭ জুনের হরতাল সফল না হলে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম পিছিয়ে যেতো।
ছয় দফা আন্দোলনে অগ্রণী দুঃসাহসিক ভূমিকার কারণেই শেখ মণির বিরুদ্ধে হুলিয়া জারিসহ আটটি মামলা করা হয়েছিল। ফলে ১৯৬৮ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হলেও মুক্তি দেওয়া হয়নি শেখ মণিকে। ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ছয় দফা প্রস্তাব জনগণের সামনে পেশ করার পর থেকে সরকার আমার ওপর অত্যাচার চালাইয়া যাচ্ছে। …আমার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি ও আরও অনেকে ১৯৬৬ সাল থেকে জেলে আছে এবং সবার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে।’ ইতিহাসের পাতায় ঐতিহাসিক ৭ জুন স্বাধীনতা—সংগ্রামে বাঙালির প্রথম রক্তদানকারী হিসেবে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ শহীদদের নাম যেভাবে অমর হয়ে থাকবে, তেমনি এই হরতাল সফল করতে ও ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়ে দুঃসাহসিক অবদানের জন্য শেখ ফজলুল হক মণির নামও সংগ্রামী চিত্তে স্মরণ করবে বাঙালি জাতি।
লেখক: সহ-সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ছয় দফার জনমত গঠনে শেখ মণির দুঃসাহসিক ভূমিকা মত-দ্বিমত মানিক লাল ঘোষ