Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অস্থির সময়ের বাজেট

এম কে তৌফিক
১২ জুন ২০২২ ১৩:৫২

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হলো ৯ই জুন। কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে উঠবার কালে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সুখবর তেমন নেই, আছে কেবল আশংকা আর উদ্বেগ। চাপে আছে দেশের অর্থনীতিও। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষার উদ্দেশ্যের কথা জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণা করলেন। সব চাওয়া পূরণ করা সম্ভবপর নয় বলেই ‘বাজেট’। বৈশ্বিক মহামন্দার আশংকার কালের অস্থির সময়ের এই বাজেটে তাই যেমন প্রাপ্তি আছে, তেমনি আছে অপ্রাপ্তি। তার কিছু নিচে আলোচনা করছি।

বিজ্ঞাপন

সামাজিক সুরক্ষা

সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ গত অর্থবছরের তুলনায় পাঁচ শতাংশ অর্থাৎ ৫ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা বেড়েছে। নতুন বাজেটে এ খাতের আকার এখন এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। প্রধান উপখাতসমূহের সবক’টিতেই বরাদ্দ বেড়েছে। বাজেট বরাদ্দের আকার অনুযায়ী প্রধান ৫টি উপখাত হচ্ছে যথাক্রমে সামাজিক কল্যাণ, অবসর ও পারিবারিক ভাতা, কর্মসৃজন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন। নতুন বাজেটে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অবসর ও পারিবারিক ভাতা উপখাত এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন উপখাত। সবচেয়ে কম বেড়েছে খাদ্য নিরাপত্তা উপখাত ও সামাজিক কল্যাণ উপখাত। সরকারী হিসাবে করোনাকালে নগদ অর্থসাহায্যপ্রাপ্ত পরিবারসহ যে এক কোটি পরিবার টিসিবি-র ফ্যামিলি কার্ড পেয়েছিলেন, সে কর্মসূচীকেও সামাজিক সুরক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিদ্যমান ১১৫টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে আরো অন্তর্ভুক্ত আছে পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ, করোনাকালে মওকুফকৃত ব্যাঙ্কসুদ ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সুদ ভর্তুকি এবং প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের বৃত্তির মত কর্মসূচী যেগুলোতে মোট বরাদ্দ ৪৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। ফলে, প্রকৃত সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ যা দেখানো হচ্ছে তার চেয়ে কম।

সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতিকে বিবেচনায় নিলে ব্যক্তিপর্যায়ে এই বরাদ্দ গ্রহীতার কাছে আগের চেয়ে বেশি অপ্রতুল মনে হবে। এছাড়াও, মোট বাজেটের হিস্যা বিবেচনায় সামজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ কমেছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১৭.৮২ শতাংশ ও জিডিপির ৩.১১ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে তা কমে হয়েছে যথাক্রমে ১৬.৭৫ শতাংশ ও ২.৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ, সামগ্রিক বিচারে সামাজিক সুরক্ষার যেখানে গুরুত্ব বাড়বার কথা, সেখানে মোট বাজেটে এই খাতটি আগের তুলনায় গুরুত্ব হারিয়েছে। এছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতার সর্বগ্রাসী ভূমিকা তো রয়েই গেছে। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে আমরা ভুল মানুষকে সুবিধা দিচ্ছি। সুতরাং বরাদ্দ বৃদ্ধির এই ৬০০০ কোটি টাকার একটা বড় অংশ যাবে যাদের প্রয়োজন নেই, তাদের কাছে।

বিজ্ঞাপন

পাচারকৃত টাকা ফেরানোর সুযোগ

বিদেশে পাচারকৃত টাকা কর প্রদান করে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেয়া হয়েছে এই বাজেটে। এ সম্পর্কিত দুটো প্রশ্নের উত্তর জানলেই এর যৌক্তিকতা জানা যাবে। প্রশ্ন ১– এর ফলে কি বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে? উত্তর: সে সম্ভাবনা নগণ্য। অভিজ্ঞতা বলে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে দেশে কখনোই আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। পাচারকৃত টাকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাভবান হতে হলে বিপুল পরিমাণ টাকা দেশে ফেরৎ আসতে হবে। কিন্তু স্থায়ী উদ্দেশ্যে যে টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে তা এরকম প্রণোদনায় ফেরার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া দেশের অর্থনীতিতে অস্বস্তিকর চাপ সৃষ্টি হলে বা নির্বাচনের আগের বছরে বাইরে থেকে কর দিয়ে দেশে টাকা আনার কথা কম মানুষই ভাববেন। প্রশ্ন ২– এই সুবিধা কি ভবিষ্যতে টাকা পাচারের আগ্রহকে কমাবে? উত্তর: না, বরঞ্চ উৎসাহিত করবে। এটা তো খুব সহজ যুক্তি যে, বর্তমানে অপরাধীদের পুরস্কৃত করলে, ভবিষ্যতে আরো বেশি মানুষ একই রকম অপরাধে উৎসাহিত হবে। বিদেশে পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার সুযোগের এ প্রস্তাবে অনেকেই এখন বৈধভাবে বিদেশে বিনিয়োগের (পাচার!) সুযোগ চাইতে পারেন। ন্যায্যতার কোনো মানদন্ডেই এ প্রস্তাব উতরায় না। বৈধ আয়ে কর ২৫ শতাংশ, আর অবৈধ আয়ে ৭ শতাংশ! তদুপরি, কর এড়িয়ে বিদেশে কারা অর্থ পাচার করছেন সেটা জানবার কোনো আগ্রহ নীতিনির্ধারকদের নেই (এ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির ১০০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নেই)!

বাজেট ঘাটতি, ভর্তুকি ও রাজস্ব আদায়

নতুন বাজেটে ঘাটতি ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এই ঘাটতির ৪৩.৪ শতাংশ মেটানো হচ্ছে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়ে। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার নিজে এত বেশি ঋণ নিলে, বেসরকারী খাতের ঋণের উৎস সঙ্কুচিত হয়ে যায়। এ দিকে বেসরকারী খাত থেকে প্রায় ২৪.৯ শতাংশ বিনিয়োগ ধরা হয়েছে। তার জন্য বেসরকারী খাতে যথাসময়ে পর্যাপ্ত ঋণপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। নতুন বাজেটে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা যা গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। অর্থমন্ত্রী আশঙ্কা করছেন যে, এটা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়ে ৯৫ হাজার কোটি থেকে ৯৯ হাজার কোটি টাকার মত হবে। এই বিপুল ভর্তুকি সরকারের আয় বাড়ানোর উপর বড় চাপ সৃষ্টি করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন একটা বড় চ্যালেঞ্জ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আদায় হয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী আশাবাদী যে পুরোটাই আদায় করা হবে এবং সংশোধিত বাজেটে তাই আয়ের লক্ষ্য কমানো হয় নি। মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যক্তিকরের সীমা বাড়ানোর দরকার থাকলেও, কর আদায় বাড়াতে অর্থমন্ত্রী মূলত লক্ষ্য বানিয়েছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে। এ বাজেট তুলনামূলকভাবে ব্যাবসায়ীবান্ধব যারা সাধারণত উচ্চবিত্ত শ্রেণীতে পড়েন। নিম্নবিত্তের জন্য বাজেটে সরাসরি কিছু নেই। অনেকে ভাবতে পারেন, ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে পারলে কর্মসৃজন হবে, যাতে উপকৃত হবে নিম্নবিত্তের মানুষ। তবে এটা খুব শক্ত যুক্তি নয়।

বিনিয়োগ ও রপ্তানি

কর্মসংস্থানের কথা মাথায় রেখে ব্যবসায়ীদের নানারকম সুবিধা দেয়া হয়ছে। কিছু শর্ত বেঁধে দিয়ে করপোরেট করের হার ২.৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। এতে নতুন বিনিয়োগ যেমন বাড়তে পারে, তেমনি রপ্তানী খাতও সুবিধা পাবে। ব্যবসায়ীরা বরাবরই ৭.৫ শতাংশ এআইটি (অগ্রীম আয়কর) এবং ৫ শতাংশ এটি-কে সমন্বয়ের দাবী জানাচ্ছিলেন। কারণ, এই দুই করের কারণে ব্যাকওয়ার্ড ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ সম্ভাব্যতা কমছে। তবে সেদিক দিয়ে কোনো সুখবর বাজেটে নেই। সেবা রপ্তানী খাতকে করমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এতে উপকৃত হবে বাংলাদেশের দ্রুত বিকাশমান সমুদ্রগামী জাহাজশিল্প, যাদের বৈদেশিক আয় গত বছর ১৪৫% বেড়েছে। সব লেনদেন আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে করে কর সুবিধা নেয়ার উদ্যোগ ব্যবসায়ীদের পছন্দ না হলেও, এটি একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। পোশাক শিল্পে উৎসে কর ০.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ অর্থাৎ দ্বিগুণ করা হয়েছে। অন্যদিকে, রপ্তানীর জন্য সাব-কন্ট্রাক্টে ভ্যাট অব্যাহতি এবং বিদ্যমান নগদ সহায়তা চলমান রাখাসহ ১০ ধরনের সুবিধা প্রদান করা হয়েছে এই খাতকে। উৎসে কর বৃদ্ধিতে পোশাকশিল্প সংশ্লিষ্টদের যতটা আতঙ্কিত হতে দেখা গেছে, প্রকৃত চিত্র হয়তো বা সবমিলিয়ে অতটা নিরাশাজনক নয়। তবে, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি সেরকম হলে, নতুন কোনো প্রণোদনা আসতেও পারে। এ খাতের প্রতি সরকার সবসময়ই যথেষ্ট যত্নবান।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের জন্য নতুন বাজেটে বরাদ্দ ১,৯১৬ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১৯৬ কোটি টাকা বেশি। আইসিটি স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের করের হার কমছে, আয়কর রিটার্ন বাদে অন্যান্য রিপোর্টিং থেকেও তারা পাচ্ছেন অব্যাহতি। দেশীয় কম্পিউটার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানদের সুবিধা দিতে গিয়ে ল্যাপটপ ও কম্পিউটার আমদানীতে বসছে ১৫ শতাংশ মূসক। নিশ্চিতভাবেই এটা অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে। এছাড়াও অপটিক্যাল ফাইবার কেবল আমদানীর উপর শুল্কারোপ নতুন ইন্টারনেট সংযোগের ব্যয় বাড়াবে।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “মূল কৌশল হবে বিদ্যমান চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরবরাহ বৃদ্ধি করা। সে লক্ষ্যে আমদানিনির্ভর ও কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বন্ধ রাখা বা হ্রাস করা হবে।” ‘চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে’ জিডিপি-র ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কীভাবে অর্জিত হবে বা ‘আমদানিনির্ভর ও কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বন্ধ রাখা বা হ্রাস করা’-র মাধ্যমে কীভাবে কী পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে তার প্রত্যয়যোগ্য ব্যাখ্যা অনুপস্থিত। প্রবাসী আয়ে ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। নিম্ন অধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পে বাস্তবায়নের গতি হ্রাস পেলে তা কর্মসংস্থান ও প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধিতে কী প্রভাব ফেলবে কিনা সেটাও দেখবার বিষয়। কর আদায় স্বয়ংক্রিয়করণের কথা এসেছে। তবে, কর আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সেবার গুণগত মানবৃদ্ধির মাধ্যমে কর বৃদ্ধির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ব্যতীত করজাল বৃদ্ধি পাবে না। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতাবৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদী একটি রূপরেখা মাথায় রেখে সে লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন ছিল। দুর্নীতির পাশাপাশি অদক্ষতাও যে আমাদের একটি প্রধানতম সমস্যা তার স্বীকৃতির দরকার আছে। নতুবা পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রয়োগ ও ব্যবস্থাপনার চিত্র আশানুরূপ উজ্জ্বল হবে না।

লেখক: শিক্ষক ও পলিসি-বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অস্থির সময়ের বাজেট এম কে তৌফিক মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর