বিএনপির নিয়তি না কর্মফল
২৪ জুন ২০২২ ১৬:০৮
পদ্মা সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যাচ্ছে না বিএনপি- এটা পুরোনো খবর। কেন যাচ্ছে না, সেটাও পরিষ্কার করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার ভাষায় ‘যারা মানুষ হত্যা করে, যারা এ দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, জনপ্রিয় নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে পদ্মায় ডুবিয়ে মারতে চায়, যারা এদেশের সবচেয়ে প্রতিথযশা ব্যক্তি গোটা পৃথিবীতে নন্দিত ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে চুবিয়ে মারতে চায়, তাদের আমন্ত্রণে বিএনপির কোনো নেতা বা কোনো কর্মী কখনোই যেতে পারে না।’
দারুণ যুক্তি! যে সেতু থেকে দলীয় প্রধানকে ‘টুস’ করে ফেলে দেওয়ার কথা বলা হয়, সেই সেতু উদ্বোধনে দলের দায়িত্বশীল সাত নেতা কীভাবে যাবেন? দলটির সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক আছে- এমন ব্যক্তিরাই বা কীভাবে নিজের ফেসবুকে পদ্মা সেতুর ছবি দেবেন, লিখবেন ইতিবাচক মন্তব্য? বরং পদ্মা সেতুর উদ্বোধন বাদ দিয়ে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র কেনা ও বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের যে ‘সুপরামর্শ’ তারা অনবরত দিয়ে যাচ্ছেন, সেটিই তাদের জন্য ভালো।
অবশ্য এ রকম সহজ সমীকরণে রাজনীতি হয় না। যদি হতো, তাহলে রাজনীতির রাঙা লাঠি ঘুরিয়েই আমজনতাকে নিজের কব্জায় নেওয়া যেত, বিশেষ কোনো জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে হুইসেল বাজালেই ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া যেত। কাঙিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে গলদঘর্ম হতে হতো না কোনো রাজনৈতিক দলকে। অবশ্য সব সম্ভবের এ দেশ কোনো যুক্তি, বিজ্ঞান বা দর্শন দিয়ে চলে না। চলে বিশেষ ধরনের এক ‘এন্টি সেন্টিমেন্ট’ দিয়ে।
ধরে নিচ্ছি ‘টুস’ করে ফেলে দেওয়ার হুমকির কারণেই বাঙালির ‘অভূতপূর্ব’ অর্জন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শরিক হতে পারছে না বিএনপি। তাহলে এবার একটু দেখে নেওয়া যাক গত ২৫ বছরে বাঙালির সেরা অর্জনগুলোতে কতটা সম্পৃক্ত হতে পেরেছে বিএনপি।
১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিল। গোটা জাতি বাংলা নববর্ষ উদযাপনে প্রস্তুতি নিচ্ছে। চারিদিকে সাজ সাজ রব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রস্তুতি নিচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সূতিকাগার ‘ছায়ানট’ প্রস্তুতি নিচ্ছে রমনার বটমূলে বর্ষবরণের জন্য। অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে আয়োজনের রোশনাই একটু বেশিই।
হবেই বা না কেন? ২১ বছর পর মাত্র ১০ মাস আগে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ক্ষমতায় এসেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ। সঙ্গত কারণেই সব কিছুতে মানুষের প্রত্যাশা একটু বেশি। কী শিল্প, কী সাহিত্য, কী সংস্কৃতি, কী রাজনীতি, কী অর্থনীতি, কী ক্রীড়া- সব কিছুতেই মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে বহুগুণ।
দশ মাস বয়সী আওয়ামী লীগ সরকার যখন বাঙালির অন্যতম প্রধন উৎসব বর্ষবরণকে নির্বিঘ্ন করতে সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে ঠিক সেই সময় মালয়েশিয়ার কিলাথ ক্লাব মাঠ থেকে ইথারে ভেসে এলো, ‘এক বলে এক রান’! চৈত্র্যের শেষ সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বেতারের সামনে বসে থাকা লাখো-কোটি বাঙালি তখন রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায়। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা…।
স্বাধীনতার ২৬ বছর পর বাঙালির সব চেয়ে বড় আনন্দক্ষণ ছিল আইসিসি ট্রফি বিজয়ের ওই দিনটি। সেদিন গোটা জাতি আনন্দে ফেটে পড়েছিল। সেই আনন্দে যে বিএনপির কর্মী সমর্থকেরা শরিক হননি, তা নয়।
কিন্তু আইসিসি ট্রফি বিজয়ী দল দেশে ফেরার পর সেদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজাসংলগ্ন মানিক মিয়া এভিনিউতে আকরাম খানদের যে বীরোচিত সংবর্ধনা দেন, সেখানে দেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা হাজির হলেও তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির কাউকে দেখা যায়নি। স্বাধীনতার পর বাঙালির সবচেয়ে বড় আনন্দ আয়োজনে শরিক হতে পারেন নি তারা।
অথচ এই বিজয় ১০ মাস আগে এলে বিএনপিই পেতো এর কৃতিত্ব। কিন্তু নিয়তি সেটা হতে দেয়নি। আবার চাইলেই তারা পারত বাঙালির ওই বড় অর্জনে শরিক হতে। কিন্তু ‘বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা’- এই নীতি মেনে যথারীতির দূরে থেকেছে দলটি।
দুই বছরের মাথায় ১৯৯৯ সালের ৩১ মে ক্রিকেটে আরেকটি বড় জয় ছিনিয়ে আনে বাংলাদেশ। এবার প্রতিপক্ষ ‘চিরশত্রু’ পাকিস্তান। সে কারণে বাঙালির উচ্ছ্বাসটাও ছিল বেশি। প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েই ক্রিকেটের পরাশক্তি পাকিস্তানকে হারানোয় উল্লাসে ফেটে পড়ে বাংলাদেশ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেই ফেলেন, ‘একাত্তরের পর বাংলাদেশের কাছে আরেকবার পরাজিত হলো পাকিস্তান।’
কাকতালীয়ভাবে হলেও স্বাধীনতার পর বাঙালির দ্বিতীয় বড় অর্জনে যথারীতি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আর বিরোধী দলে বিএনপি। সেবারও ক্রিকেটাররা বীরের বেশে দেশে ফেরার পর মহা আয়োজনে তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আর এসব আয়োজন দূর থেকে নীরব দর্শকের মতো চেয়ে চেয়ে দেখে বিএনপি।
২৬ জুন, ২০০০। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সেরা প্রাপ্তির দিন। যে দিনটিতে বাংলাদেশের সামনে সবস্তরে ক্রিকেট খেলার দুয়ার খুলে যায়। টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে যায় বাংলাদেশ। এ প্রাপ্তির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের তৎকালীন সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী যে ভূমিকা পালন করেন, তা রীতি মতো রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে বিসিবি সভাপতি নির্বাচিত হবার পর প্রথম বোর্ড মিটিংয়ে সাবের হোসেন চৌধুরী টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ব্যাপারে তার স্বপ্নের কথা কথা বলেন। শেয়ার করেন নিজের কিছু পরিকল্পনা। সেদিন কেউ বিশ্বাস করেনি এটা সম্ভব। সাবেক এক ক্রিকেটার নাকি সাবের হোসেন চৌধুরীকে বলেছিলেন, ‘সাবের, তুমি তো মজা করে বলছো কথাটা তাই না? এটাতো বাস্তবে সম্ভব না। আইসিসি কেন আমাদের এখন টেস্ট স্ট্যাটাস দেবে?’
এই কেন দেবে এটাই ছিলো একটা অফ-ফিল্ড রাজনীতির বিষয়। সেই সময় টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার জন্য কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। এখন যেমন আছে যে, টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার আগে সেই দেশের ঘরোয়া চারদিনের ম্যাচের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পেতে হবে।
বাংলাদেশ কি বলবে? বলার জন্য তো আগে কিছু করা লাগে! তখন কোচ হিসেবে আনা হয় গর্ডন গ্রিনিজকে। টার্গেট করা হয় ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি। পরের অংশটা সবাই জানেন। বাংলাদেশ কেনিয়াকে পরাজিত করে আইসিসি ট্রফি জেতে এবং ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায়। একই সাথে হাতে আসে বিশ্বকাপে খেলার টিকেট। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালের ২৬ জুন বাংলাদেশ পায় টেস্ট স্ট্যাটাস। সেদিনের কথা যাদের মনে আছে তারা নিশ্চয় জানেন সেটা ছিল আমাদের ক্রিকেটের জন্য এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় উৎসব। সারা বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল রং মাখামাখি আর মিছিলের দেশ।
আইসিসির বাঙালি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়ার বদান্যতা আর বিসিবির সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর অক্লান্ত পরিশ্রমে আসা টেস্ট স্ট্যাটাসের সময়ও বিএনপি ছিল নীরব দর্শক। দলটির কর্মী সমর্থকেরা সেদিন উল্লাসে মাতলেও দলীয়ভাবে দিনটিকে উদযাপনের কোনো সুযোগ ছিল না বিএনপির এবং এই অর্জনের নেপথ্যে কোনো ভূমিকা পালনের খবরও আমাদের জানা নেই।
গত ২৫ বছরে বাঙালি জাতির এ রকম অসংখ্য অর্জনে বিএনপিকে নির্লিপ্তই দেখেছে এদেশের মানুষ। তবে সবচেয়ে বড় দৃষ্টিকটু কাজটি তারা করেছে ২০১৩ সালে। একাত্তরের ঘাতকদের বিচার চেয়ে গোটা দেশ যখন শাহবাগে হাজির, ক্ষোভে-রোষে যখন ফুঁসে উঠেছে পুরো দেশ, তখনও দলটির অবস্থান ছিল বাঙালির আবেগের বিরুদ্ধে। বাঙালির চির শত্রু জামায়াতের পক্ষেই ছিল তাদের অবস্থান।
গণজাগরণ মঞ্চে আসতে না পারায় দলটির অঙ্গ সংগঠনের তরুণ একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের মনোবেদনার কথা লিখলেও বিএনপি নেত্রী আনুষ্ঠানিক স্টেটমেন্ট এবং ভাষণ-বক্তৃতায় গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তাদের ‘নাস্তিক’, ‘নষ্ট ছেলে’, ‘চরিত্রহীন’ আখ্যা দিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন।
এরপর ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে এক এক করে একাত্তরের ঘাতকদের রায় কার্যকর শুরু হলে দেশের বেশিরভাগ মানুষ বিষয়টি স্বাগত জানালেও বিএনপি করেছে বিরোধিতা। সবাই যখন বিষয়টিকে জাতির পাপ মোচন হিসেবে দেখেছে, তখন বিএনপি দেখেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘দমন’ হিসেবে।
গত পঁচিশ বছর এভাবে বাঙালির সব অর্জনে বিএনপি হয় ভেটো দিয়েছে, না হয় নীরব থেকেছে। ক্ষেত্রবিশেষে করেছে তুমুল বিরোধিতা। কোনো অর্জনেই বাঙালির আবেগের কাছকাছি থাকতে পারে নি দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। এরই ধারাবিহকতায় স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে মেতে ওঠা বাঙালির আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারছে না তারা। এটা তাদের নিয়তি, না কর্মফল- তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি