Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আত্মপ্রত্যয়ের অনন্য নিদর্শন

ডা. আওরঙ্গজেব আরু
২৪ জুন ২০২২ ১৬:৫১

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসঙ্ঘের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মানবের অসাধ্য সাধন ও দুরূহ বাধা অতিক্রমের অদম্য শক্তির প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থার কথা আবার ঘোষণা করতে চাই।’ সেই অদম্য লড়াকু মনের উত্তরসূরি বঙ্গবন্ধুকন্যাও তার বাবার মতোই বিশ্বাস করেন জীবনযুদ্ধের মোকাবিলায় জনগণের প্রতিরোধ ক্ষমতা ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞাই শেষ কথা। আত্মনির্ভরশীলতাই আমাদের লক্ষ্য। তিনিও মনে করেন, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমাদের কষ্ট স্বীকার করতে হতে পারে। কিন্তু আমাদের কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। পদ্মা সেতু আমাদের জাতীয় সেই সক্ষমতার প্রতীক। আমাদের নিজস্ব শক্তির সমাহারে তৈরি আত্মপ্রত্যয়ের এক অনন্য নিদর্শন।

বিজ্ঞাপন

পদ্মা সেতু নিয়ে দেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এত বেশি আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, যে কারণে দীর্ঘসময় ধরে পদ্মা সেতু বাঙালির মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। নানান ষড়যন্ত্রের মুখে পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে কেবল সাধারণ মানুষ নয়, স্বয়ং তৎকালীন অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই তখন সংশয় প্রকাশ করছেন। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই যখন সমালোচনায় মুখর; পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক যখন নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে; সমগ্র জাতি যখন সরকারের উদ্যোগ নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে উঠেছে; ঠিক তখন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ইস্পাতদৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘নিজেদের অর্থে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করব’। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতুর মতো জটিল ও ব্যয়বহুল প্রকল্প সম্ভব কি না, তা নিয়েও বিভিন্ন মহল তখন সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। কেউ কেউ বলেছিল, এটি নেহাতই সরকারের একটি রাজনৈতিক বুলি। বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। পদ্মা নদী পৃথিবীর উত্তাল বা খরস্রোতা নদীগুলোর অন্যতম। জলপ্রবাহের দিক থেকে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীর পরই পদ্মা নদীর অবস্থান। পদ্মায় পানির প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে ১.৪০ লাখ ঘনমিটার। এত উত্তাল নদীর ওপর ইতোপূর্বে আর কোনো সেতু নির্মিত হয়নি। সঙ্গত কারণেই এই নদীতে সেতু নির্মাণ অনেক চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ। তবে এত জটিলতার বিপরীতে ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা জনদরদি নেত্রী শেখ হাসিনা। সবকিছু উপেক্ষা করেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী, করেছেন তার স্বপ্ন এবং চ্যালেঞ্জের বাস্তবায়ন।

বিজ্ঞাপন

২০১২ খ্রিষ্টব্দের ২৯ জুন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এ প্রকল্প থেকে সরে যায় এডিপি, জাইকা এবং আইডিবির মতো উন্নয়ন সহযোগীরাও। বিশ্বব্যাংক প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ২০১২ খ্রিষ্টব্দের ৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ অধিবেশনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে কোন কোন খাত থেকে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় মেটানো হবে তা বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। পরদিন প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রীসভার বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংক নিজেরা তদন্ত শুরু করে এবং তাদের তথ্যের ভিত্তিতেই তারা কানাডা পুলিশকে সে দেশের এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে। পাঁচ বছরের বেশি সময়ের বিচার প্রক্রিয়া শেষে কানাডার আদালত ২০১৭ খ্রিষ্টব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি সেই দুর্নীতির মামলা খারিজ করে দেয়। আদালত রায়ে বলেন, এ মামলায় যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেটা অনুমানভিত্তিক এবং গুজব।

২০১৪ খ্রিষ্টব্দের নভেম্বরে শুরু হয় মূল সেতুর কাজ। ২০১৫ খ্রিষ্টব্দের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী মূল সেতুর নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানো হয় ২০১৫ খ্রিষ্টব্দে। প্রমত্তা পদ্মার বুকে যখন ক্রমশ দৃশ্যমান হতে থাকল সেতু, মানুষ তখন উৎসব করে নিজেদের গৌরব দেখতে ভিড় করল। ২০২০ খ্রিষ্টব্দের ডিসেম্বরের ১০ তারিখে বসানো হয় সর্বশেষ স্প্যান। বিশ্বব্যাংক চলে যাওয়ার পর পদ্মা সেতু প্রকল্পও বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্বে বাংলাদেশ চিহ্নিত হতে পারতো দুর্নীতিবাজ হিসেবে। কিন্তু নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু বানানোর সিদ্ধান্তে শেখ হাসিনা গোটা জাতির মাথা উঁচু করেছেন, আমাদের গর্বিত করেছেন। ‘আমরাও পারি’ এই বিশ্বাস সঞ্চারিত হয়েছে গোটা জাতির মধ্যে। বঙ্গবন্ধু ’৭১ খ্রিষ্টব্দের ৭ মার্চ বলেছিলেন, ‘দাবায়া রাখতে পারবা না।’ শেখ হাসিনা সেটা কাজে প্রমাণ করলেন, বাংলাদেশকে দাবায়ে রাখা যায় না।

যে দেশে সত্তরের দশকেও শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল দেশ হিসেবে অবস্থান ছিল তলাবিহীন ঝুড়ির মতো, সেই দেশ এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু এবং এর সংযোগসড়ক নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করছে, এটা অনেক বড় অর্জন। বিশ্ব বাংলাদেশকে যে চোখে দেখত, এখন সেই চোখে দেখার দিন ফুরিয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক সক্ষমতার দেশ। প্রতিটি অঙ্গনে অপ্রতিরোধ্য গতিতে উন্নতি ও অগ্রগতি সাধন করে চলেছে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীসময়ে অর্থাৎ ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৪৮ শতাংশ মানুষ ছিল হতদরিদ্র। আর বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ ; যা ২০১৫ খ্রিষ্টব্দেও ছিল ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২০৬৪ মার্কিন ডলার। যা নিকট ভবিষ্যতে আমাদের সুনিশ্চিতভাবেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করবে। পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সেতুটি নির্মাণের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে, বাড়বে দেশের জিডিপি, ঢাকা থেকে খুলনা, মংলা, বরিশাল, কুয়াকাটা অর্থনৈতিক করিডোর খুলে যাবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা হবে এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের সুবিধা হবে। দক্ষিণ অঞ্চলের একুশ জেলার অর্থনীতি ও সমাজে আসবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। এ সেতু চালু হওয়ার পর সড়ক ও রেল- এই দুই পথেই দক্ষিণ বাংলার মানুষ অল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন। দিনের পর দিন আর পণ্যবাহী ট্রাকগুলো ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় বসে থাকবে না। আর ঝড়বৃষ্টিতে ফেরি বন্ধ থাকার কারণে মানুষের যাতায়াতও থমকে থাকবে না। সেতুটির কারণেই প্রথমবারের মতো পুরো দেশ একটি সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোতে চলে আসবে। দক্ষিণ বাংলার গ্রামেও পরিবর্তনের হাওয়া লাগবে। এ অঞ্চলের কৃষক, মৎস্যজীবী, তাঁতি, ছোটো ও মাঝারি ব্যবসায়ী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভোক্তার সমাবেশ যে রাজধানী ঢাকা, তার সঙ্গে অনায়াসে সংযুক্ত হতে পারবেন। অর্থনীতিবিদরা মডেলিং করে হিসেব করছেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি অন্তত ২.৫ শতাংশ বাড়বে। সামগ্রিকভাবে তখন দেশের জিডিপি বাড়বে অন্তত আরো ১.২৩ শতাংশ। ট্রান্স এশিয়ান রেল ও সড়ক এ সেতুর মাধ্যমেই যুক্ত হবে। রেলের প্রভাবে জাতীয় জিডিপিতে আর এক শতাংশ যোগ হবে প্রতিবছর।

পদ্মা সেতু শুধু একটি অবকাঠামো নয়, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাঙালির গর্বের আরেকটা নতুন সংযোজন। আমাদের অন্যতম অহঙ্কার ও গৌরবের প্রতীক। সব ষড়যন্ত্র, প্রতিরোধ আর বিরোধিতা পেরিয়ে পদ্মা সেতু আজ পৃথিবীর মানচিত্রে দৃশ্যমান। এখন জাতির অপেক্ষা পদ্মা সেতু চালু হওয়ার; অপেক্ষা জাতির গৌরব উদ্যাপনের মুহূর্তটির জন্য। বাংলা মায়ের সন্তান হিসেবে আমাকে অহঙ্কার করার মতো সম্মান এনে দেওয়ার জন্য আমাদের আত্মপ্রত্যয়ী রাষ্ট্রনায়ক জননেত্রী শেখ হাসিনাকে জানাই আন্তরিক অভিবাদন ও অশেষ কৃতজ্ঞতা। জয়তু শেখ হাসিনা।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট। কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, কেন্দ্রীয় কমিটি

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

আত্মপ্রত্যয়ের অনন্য নিদর্শন ডা. আওরঙ্গজেব আরু মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর