Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উন্নয়নের সুষম বন্টন নিশ্চিত করবে পদ্মা সেতু

মো. আব্দুল্লাহ রানা
২৪ জুন ২০২২ ১৮:১৩

ফেরির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা, ফেরির ভেঁপুর শব্দে দৌড়াদৌড়ি, ঈদযাত্রার ধাক্কাধাকি, ছেড়ে যাওয়া ফেরিতে ঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে ওঠা, লঞ্চ কিংবা স্পিডবোটে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার- আবহমানকালের এই দৃশ্য আর দেখা যাবে না। কেউ কেউ হয়তো স্মৃতিকাতর হতে পারেন, তবে আপামর জনসাধারণ কিন্তু হাঁপ ছেড়ে বাঁচার দিন গুনছে। আর সেটির জন্য অপেক্ষমান সমগ্র জাতি। আধুনিক উন্নত বাংলাদেশের রূপকার শেখ হাসিনার হার না মানা এক চ্যালেঞ্জ, স্বপ্নের পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গকে যুক্ত করবে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্রোতের সঙ্গে। উন্নয়নের সুষম বন্টনে হেসে উঠবে দক্ষিণের মানুষের পোড়খাওয়া চোখ, হাতের কাস্তে আর জেলের জাল।

আগামী ২৫ জুন ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে লেখা হবে এক নতুন গল্প। নানা ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার আর অপবাদকে থোড়াই কেয়ার করে বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদীর ওপর নির্মিত পদ্মা সেতুর দুই মুখ খুলে দেওয়া হবে সাধারণের জন্য। বাঁধভাঙা আনন্দে হেসে উঠবে দক্ষিণের ২১টি জেলার কয়েক কোটি মানুষ। তবে একাত্তরের পরাজিত শক্তি কিন্তু এই হাসি মেনে নিতে পারছে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তারা যেমন বিরোধীতা করেছে, দক্ষিণের অর্থনীতির এই মুক্তির ক্ষণও তাদের কাছে বিষময় মনে হচ্ছে। আর তাইতো তারা শ্রীলঙ্কার উদাহরণ টেনে এইসব মেগা প্রকল্পকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা তাদের থাকলে এই অপপ্রয়াস চালাতো না। তাই বা কেন বলছি, তারা তো বিরোধীতার খাতিরে বিরোধিতা করে, তথ্য জানা না জানায় তাদের কিছু যায় আসে না।

তবু কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই, যাতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত না হয়। বাংলাদেশ একটি জনঘনত্বের দেশ। এখানে যে কোনো বড় অবকাঠামো নির্মান হলে তা সাধারণ মানুষ ব্যবহার করা শুরু করে এবং অল্প সময়ে খরচের টাকা উঠে আসে। বঙ্গবন্ধু সেতু তার বড় উদাহরণ। ২৫ বছরে টোল আদায়ের মাধ্যমে খরচ উঠে আসার পরিকল্পনা থাকলেও ১৮ বছরে তা উঠে এসেছে। এখন সেখানে পুরোটাই মুনাফা হিসেবে টোল আদায় হচ্ছে। পদ্মা সেতু ব্যয়বহুল হলেও দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতে এটি যেভাবে প্রভাব ফেলবে তাতে প্রত্যাশিত সময়ের আগেই সেতু নির্মাণের খরচ উঠে আসবে। শ্রীলঙ্কার মেগা প্রকল্পগুলো কিন্তু ব্যবহারের অভাবে লোকসান গুনছিল, ফলে তারা বিদেশি ঋণ শোধ করতে পারছিল না। সুতরাং পদ্মা সেতুর সাথে শ্রীলঙ্কার তুলনা দেওয়ার কোনো মানেই হয় না।

গত ১৫ বছরে শ্রীলংকার সরকার বিমানবন্দর, রাস্তাঘাট, সমুদ্রবন্দরসহ একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করে এমন কি শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোর কাছেই সমুদ্র থেকে ভুমি উদ্ধার করে প্রথমে একটি শহর তৈরি করা হলে যার নাম দেয়া হয়েছে ফোরসিটি। আর এই ফোরসিটি কাজ শেষে করতে করতে সময় লাগবে প্রায় ২৫ বছর । এবং যার উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে দেড় মিলিয়ন ডলার। বলা হচ্ছে এই ফোর সিটি নাকি টেক্কা দেবে হংকং, দুবাইসহ সিঙ্গাপুরকে পর্যন্ত। বিগত দিনগুলোতে এই ফোরসিটি তৈরি করার জন্য শ্রীলংকার সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে একাধিক ঋণ গ্রহণ করেছেন। এতো ঋণ গ্রহণ করার পরও এখন পর্যন্ত শ্রীলংকার সরকার কোন লাভের মুখ দেখতে পারেননি। এমন কি গত ১ দশকে শুধুমাত্র চীনের কাছ থেকে শ্রীলংকার সরকার এই প্রকল্পের জন্য ঋণ নিয়েছেন প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। যা তাদের মোট ঋণের পরিমানের ১০ শতাংশ। গভীর সমুদ্রবন্দরসহ এরকম আরো অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নেয়, যা বাস্তবতা বিবর্জিত। যা থেকে রিটার্ন পাওয়া সময়সাপেক্ষ। কিন্তু ঋণ পরিশোধ তো করতে হবে সময়মতো। এখানে শ্রীলঙ্কার সাথে আমাদের পার্থক্য। বাংলাদেশের প্রতিটি প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পরদিন থেকেই ব্যপক হারে রিটার্ন আসা শুরু হয়, যাতে ঋণ পরিশোধ করে মুনাফার মুখ দেখা সময়ের ব্যপার মাত্র।

পদ্মা সেতু কি শুধুই যোগাযোগে প্রাণ আনবে? না, গোটা দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেবে এই একটি সেতু। দেশের জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ অবদান যুক্ত হবে এর মাধ্যমে। আর সুবিধাভোগী ২১টি জেলার জিডিপিতে যোগ হবে ১০ শতাংশ।

বাংলাদেশের বর্হিবাণিজ্য প্রায় পুরোটাই চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের উপর নির্ভরশীল। বন্দরটি অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে হিমশিম খায়। এতে লিডটাইমে রফতানি বাধাগ্রস্ত হয়। অথচ আমাদের আরেকটি সমুদ্রবন্দর রয়েছে বাগেরহাটের মংলায়। এটিকে আমরা কাজে লাগাতে পারছিলাম না যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে। চট্টগ্রামের চেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে মংলা বন্দর। এছাড়া খুলনা ও আশপাশের জেলাগুলোতে রফতানিমুখী কল-কারখানা গড়ে উঠবে।

এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে ভোমরা ও বেনাপোল স্থলবন্দর। ঢাকার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব কমে যাবে। যা ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। কলকাতার সঙ্গে রেল যোগাযোগও সহজ হয়ে উঠবে। বর্তমানে ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে কলকাতা যেতে ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়, সময় লাগে ১০ ঘন্টা। পদ্মা সেতু দিয়ে রেলযোগাযোগ চালু হলে দূরত্ব কমে আসবে ২৫০ কিলোমিটারে। সময় লাগবে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা।

পর্যটন খাতেও বিপুল সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা প্রায় অনাদরে পড়ে আছে। সবার দৃষ্টি কক্সবাজারকেন্দ্রিক, যা বহুল ব্যবহারের ফলে বিদেশি পর্যটক টানতে ব্যর্থ হচ্ছে এখন। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে কক্সবাজারের চেয়ে কম সময়ে সুন্দরবন ও কুয়াকাটায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। কক্সবাজার যেতে যেখানে সময় লাগে ৮ থেকে দশ ঘণ্টা সেখানে কুয়াকাটায় পৌঁছানো যাবে মাত্র ৫ ঘণ্টায়, ফলে নিঃসন্দেহে পর্যটকের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। পায়রা বন্দরের সঙ্গে বুলেট ট্রেন চালুর কথা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কুয়াকাটা ও আশপাশে বেশকিছু দ্বীপের সঙ্গে ভালো ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। এসব চর ও দ্বীপকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপের মতো পর্যটনের বিশাল জগৎ তৈরি করা সম্ভব। এ জন্য ইতোমধ্যে অনেক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর ও এর আশপাশে বিনিয়োগ করা শুরু করেছে। পৃথিবীর বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের হাতছানি তো আছেই। ঢাকা থেকে ৪-৫ ঘন্টায় মানুষ চলে যেতে পারবে সুন্দরবনে।

পদ্মাসেতুকে ঘিরে দুই পাড়ে পর্যটন হাব গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। পদ্মা সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুই পারে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার কথাবার্তা হচ্ছে। নদীর দুই তীরে আসলেই আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব। তবে সে জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। ইতোমধ্যে বেশকিছু আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। এই সেতু ঘিরে কী কী হতে পারে, কোথায় শিল্পকারখানা হবে, কোথায় কৃষিজমি হবে- সেসব ভেবেচিন্তে করতে হবে। এই সেতুকে ঘিরে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। অনেক আধুনিক মানের হোটেল মোটেল রিসোর্ট গড়ে উঠবে।

ইতোমধ্যেই পদ্মা সেতুর প্রাণী জাদুঘর করা হয়েছে পদ্মা সেতুর দোগাছি সার্ভিস এরিয়ায়। দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে জাদুঘরটি। ৫ হাজার প্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এ জাদুঘরে। জাদুঘরে কাচের বোতলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। এর মধ্যে রয়েছে বিষধর গোখরাসহ বিভিন্ন ধরনের সাপ, কুনোব্যাঙ, টিয়া, হুতুমপ্যাঁচা, কাক ও বালিহাঁসসহ কয়েক প্রজাতির পাখি। অচিরেই এটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতির জন্য একটি আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দেবে আগামীতে। এর ছোঁয়া লাগবে অর্থনীতির সব খাতে। বিশেষ করে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে পদ্মা সেতুকে ঘিরে। যে কোনো বিনিয়োগে ১২ শতাংশ রেট অব রিটার্ন এলে সেটিকে আদর্শ বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এ সেতু চালু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ করে উঠে আসবে। পদ্মাপারকে কেন্দ্র করে পর্যটনের এক অপার সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে। যার কারণে দুই পারে অনেক আধুনিক হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট গড়ে উঠবে। সবমিলে ২০৪১ সালের যে উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখছি তার পেছনে পদ্মা সেতু এক বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম হবে।’ তবে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে দরকার সঠিক পরিকল্পনা। আমাদের দেশে যেটি দেখা যায়, সঠিক পরিকল্পনার অভাবে অনেক সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটে। পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক পর্যটনের সম্ভাবনাগুলোর যেন মৃত্যু না ঘটে তার জন্য সরকারের পদক্ষেপ বেশি নিতে হবে। উদ্যোক্তারা যাতে নির্বিঘ্নে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বিনিয়োগ করতে পারেন তার ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে সরকারকে।

আবাসন শিল্পেও বড় অবদান রাখছে এই সেতু। পদ্মা সেতুর পরিকল্পনা যখন থেকে হয় তখন থেকেই দুই পারের এক্সপ্রেসওয়েকে ঘিরে বড় বড় আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা শুরু হয়। যা এখন আলোর মুখ দেখছে। ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত লংড্রাইভে যাচ্ছে মানুষ, আর দুইপাশের আধুনিক নগরায়ন দেখে হয়তো ভুলেই যাচ্ছে এটি বাংলাদেশ। সত্যি বুকটা ভরে যায়, উন্নয়নের রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। কী বিপুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি সেদিন বলেছিলেন, পদ্মা সেতু হবে, এবং তা আমাদের নিজেদের টাকাতেই হবে। কতবড় বুকের পাটা থাকলে বিশ্বব্যাংককে এভাবে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়। সেই সময় যারা এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে তারাও এখন বড় গলায় শেখ হাসিনার প্রশংসা করছেন।

পদ্মা সেতু তো হয়েই গেল, এখ ন যে বিপুল সম্ভাবনা দ্বার খুলে গেল তা ফলপ্রসু করতে প্রয়োজন মেগা পরিকল্পনা। সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারী খাতকে। তবে কোনো কিছুই যাতে অপরিকল্পিত না হয় সেদিকে খেয়াল করতে হবে। একদিকে নগরায়ন হবে, শিল্পায়ন হবে অন্যদিকে দেশের কৃষিজমি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। উন্নয়নের কালো ধোঁয়ায় যাতে আমাদের বনাঞ্চল, দ্বীপ, চরাঞ্চলের জীববৈচিত্র নষ্ট না হয়। একটা সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করাই হবে আমাদের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই হবে আমার বিশ্বাস।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

উন্নয়নের সুষম বন্টন নিশ্চিত করবে পদ্মা সেতু মত-দ্বিমত মো. আব্দুল্লাহ রানা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর