Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

কর্নেল ফারুক আহমেদ
২৪ জুন ২০২২ ১৯:১০

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রমত্ত পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত সুপ্রশস্ত পদ্মা সেতু আজ এক বাস্তবতা। ১৯৯৮-৯৯ সালে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণের প্রাক-সমীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছিল। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে সেতুর প্রাথমিক নকশা সম্পন্ন হওয়ার পর দেশবাসীর স্বপ্ন যখন কুঁড়ি হয়ে কেবল মেলতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই দেখা দেয় অর্থায়নের অনিশ্চয়তা। দেশের এ সংকটময় মুহূর্তে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের এক যুগান্তকারী ও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শুরু হয়ে যায় পদ্মা সেতু নির্মাণের বিশাল প্রকল্পমালা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সেতু বিভাগের সার্বিক তত্ত্বাবধানে শুরু হয় পদ্মা সেতু নির্মাণ ও আনুষঙ্গিক কার্যাবলি।

বিজ্ঞাপন

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘জনগণের সেনাবাহিনী’ দেশ ও জনগণের জন্য যে কোনো চ্যালেঞ্জিং কাজে সর্বদাই এগিয়ে এসেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ২০১৩ সালের ২৫ জানুয়ারি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত খ্যাতিমান প্রকৌশলী ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনার সময় পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে মত প্রকাশ করেন। এর আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশলীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অসংখ্য রাস্তা, কক্সবাজারে মেরিন ড্রাইভ, মিরপুর-এয়ারপোর্ট রোডে ফ্লাইওভার, জাতীয় মহাসড়ক, হাতিরঝিল প্রজেক্টসহ অনেক প্রকল্প সুচারুরূপে সম্পাদন করায় পদ্মা সেতু নির্মাণে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা অত্যন্ত যৌক্তিক। ফলে এই সেতু তৈরির প্রথম থেকেই সেতু-সংশ্নিষ্ট সব স্থাপনার নিরাপত্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শক হিসেবে সেতু বিভাগ কর্তৃক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা হয়।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের কাজ মোট ৫টি প্যাকেজের আওতায় পরিকল্পিত- মূল সেতু, নদীশাসন, দক্ষিণ প্রান্তে ১০ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড, উত্তর প্রান্তে ১ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড এবং প্রকল্পে নিয়োজিত পরামর্শক ও প্রকৌশলীদের বাসস্থান (সার্ভিস এরিয়া-২)।

বিজ্ঞাপন

মূল কাজ শুরুর ঠিক আগে পদ্মা সেতুর অ্যালাইনমেন্ট বরাবর নদীর ব্যাপক ভাঙন মোকাবিলায় সেতু বিভাগের অনুরোধে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পদ্মা নদীর পাড় বরাবর মাওয়া-কান্দিপাড়া-যশোলদিয়া এলাকায় ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার নদীশাসন সম্পন্ন করে পদ্মা সেতুর মূল অ্যালাইনমেন্টকে বড় ধরনের ঝুঁঁকি থেকে মুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাত ধরে ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর জাজিরা অ্যাপ্রোচ রোড শুরু করার মাধ্যমে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজ মাঠ পর্যায়ে শুরু হয়।
তিনটি প্যাকেজের (জাজিরা ও মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোড এবং সার্ভিস এরিয়া-২) জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আব্দুল মোনেম লিমিটেড-হাইওয়ে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট এবং পরামর্শক হিসেবে কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিযুক্ত করা হয়। পরে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে মূল সেতু ও নদীশাসন কাজের জন্য যথাক্রমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডকে নিয়োগ করা হয়।

এভাবে সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহদাকার মেগা প্রকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য এটি একটি বড় পেশাদারি স্বীকৃতি। এর পাশাপাশি স্ট্র্যাটেজিক এই সেতুর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড নামে একটি নতুন ব্রিগেড গঠন করে, যার কার্যক্রম ২০১৪ সালের ১২ মার্চ থেকে শুরু হয়। এই লেখনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সম্পাদিত কাজগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

জাজিরা অ্যাপ্রোচ রোড

এই অ্যাপ্রোচ রোডে রয়েছে চার লেনবিশিষ্ট ১০ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল সড়ক, দুই লেনবিশিষ্ট ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ সার্ভিস সড়ক, ৫টি সেতু, ৮টি আন্ডারপাস, ২০টি কালভার্ট, ১টি সার্ভিস এরিয়া, টোল প্লাজা, থানা এবং ফায়ার স্টেশন বিল্ডিং। বর্ণিত কাজ ২০১৩ সালে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ২০১৭ সালে।

মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোড

এই অ্যাপ্রোচ রোড চার লেনবিশিষ্ট ১ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মূল সড়ক, দুই লেনবিশিষ্ট ১ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার সার্ভিস সড়ক, ১টি কালভার্ট, সার্ভিস এরিয়া, টোল প্লাজা, থানা এবং ফায়ার স্টেশন বিল্ডিং।
অ্যাপ্রোচ রোডটি ২০১৪ সালে শুরু হয়ে ২০১৬ সালে শেষ হয়েছে।

সার্ভিস এরিয়া-২

এই এরিয়ার মধ্যে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ৩০টি কটেজ, রিসিপশন বিল্ডিং, সুপারভিশন অফিস, সুইমিং পুল, টেনিস কমপ্লেক্স ও মোটেল মেস তৈরি করা হয়েছে। ২০১৪ সালে শুরু হয়ে ২০১৬ সালে এই প্যাকেজের কাজ শেষ হয়েছে।

জাতীয় মহাসড়ক এন-৮

দেশের সর্বপ্রথম অ্যাক্সেস কন্ট্রোলড এক্সপ্রেসওয়ে এন-৮ পদ্মা সেতুকে উত্তরে ঢাকা এবং দক্ষিণে ফরিদপুরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এন-৮ মহাসড়কটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে নির্মিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই মহাসড়কটির কাজ ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট উদ্বোধন করেন এবং ২০২০ সালের ১২ মার্চ এর কাজ সমাপ্ত হয়। মহাসড়কটি ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ, যার আওতায় রয়েছে ৫টি ফ্লাইওভার, ২টি ইন্টারচেঞ্জ, ৪টি ওভারপাস, ২৯টি সেতু, ৫৪টি কালভার্ট এবং ১৯টি আন্ডারপাস। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এন-৮ সড়ক ব্যবহার করে অতি স্বল্প সময়ে মানুষ ও মালপত্র দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা থেকে রাজধানী ঢাকায় পৌঁছাতে পারবে, যা ওই অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নকে করবে ত্বরান্বিত।

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প

সাশ্রয়ী মূল্যে বিপুল সংখ্যক যাত্রী ও মালপত্র পরিবহনের সুবিধার্থে পদ্মা সেতুর মূল নকশায় নিচের স্তরে ব্রডগেজ রেললাইনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ সরকারের একটি সময়োপযোগী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্টের তত্ত্বাবধানে ও বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের মাধ্যমে এ প্রকল্পটির নির্মাণকাজ চলমান। প্রকল্পটি আর্থিক বিবেচনায় (৩৯,২৪৬ কোটি টাকা) বাংলাদেশ সরকারের সর্ববৃহৎ প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন। এই রেল প্রকল্পটির দৈর্ঘ্য ১৭২ কিলোমিটার এবং এর আওতাধীন ২৩ দশমিক ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ভায়াডাক্ট বা উড়াল রেল সেতু, ৫৯টি বড় দৈর্ঘ্যের সেতু, ১৪২টি কালভার্ট, ১৩৫টি আন্ডারপাস ও ২০টি স্টেশন। এ পর্যন্ত প্রকল্পের ৬০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

পদ্মা সেতু এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদির নিরাপত্তা

দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি, জনসাধারণের জীবনযাপনের মানোন্নয়নের পাশাপাশি কৌশলগত কারণে স্ট্র্যাটেজিক এই সেতুর গুরুত্ব অপরিসীম। এর নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যাদের বলা হয়, ‘প্রটেক্টর অব পদ্মা ব্রিজ’। এই ব্রিগেডটি ২০১৩ সাল থেকেই সেতু, সংশ্নিষ্ট জনবল, নানাবিধ স্থাপনা ও সেতুর নিচে বিস্তীর্ণ নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসছে।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নির্মাণকাজ হচ্ছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প। পুরো বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছে একটি একটি করে পিলার ও স্প্যান উন্মত্ত পদ্মার বুক চিরে তৈরি হচ্ছে। আজ পদ্মা সেতু ও সেতু-সংলগ্ন অন্যান্য অবকাঠামো গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এমন চ্যালেঞ্জিং, অত্যাধুনিক, বিশালাকার ও নান্দনিক স্থাপনার নানাবিধ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পেরে অত্যন্ত গর্বিত এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে নির্মাণ, নিরাপত্তা ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রমে সরাসরি অংশগ্রহণের সুবর্ণ সুযোগ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে করেছে আত্মবিশ্বাসী এবং বাড়িয়েছে তার কর্মদক্ষতা। মহতী এ কাজে সম্পৃক্ত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের আস্থার প্রতীক হিসেবে নিজের অবস্থানকে করেছে সুদৃঢ়।

লেখক: এএফডব্লিউসি, পিএসসি: বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

কর্নেল ফারুক আহমেদ পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

২ দিনে আয় ২৮৯ কোটি টাকা
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:৩২

মৌসুমী হামিদের সংসার যেমন চলছে
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:২৬

সম্পর্কিত খবর