কুইন্সল্যান্ডে ২-৩ দিন পর বাড়িতে পৌঁছে কুরবানীর মাংস
১০ জুলাই ২০২২ ১৪:৪৫
মুশফিকুর রহিম তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে নতুন। মাত্র নিউজিল্যান্ড সফর করে দেশে ফিরেছেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক সূত্রে তার উত্তরার বাড়িতে তার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নিউজিল্যান্ড কেমন দেশ? তার উত্তর ছিল, শুনশান। চারদিকে কোন শব্দ নেই, নিরব, অনেকটা নিস্তব্ধ, অনেক বাতাস, ভয়ভয় করে। গত ৫ জুলাই নিউজিল্যান্ডের পাশের দেশ অস্ট্রেলিয়ার ব্রিজবেনে নেমে মুশফিকের কথাই বারবার মনে হচ্ছিল। কারণ এ শহরে চারদিকে কোনো শব্দ নেই। না আছে গাড়ির হর্ন, না আছে কল-কারখানার শব্দ, না আছে লোক সমাগম, না আছে মিছিল-মিটিং, না কোন জটলা বা কোলাহল। উল্লেখ্য মুশফিকের দেখা নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন থেকে ব্রিজবেনের দূরত্ব দুই হাজার কিলোমিটারের একটু বেশি।
ব্রিজবেন এয়ারপোর্ট থেকে আমি, আমার স্ত্রী ও দুই সন্তানের গন্তব্য ছিল শহরের ১২, আর্ল স্ট্রিট, গ্রিনস্লপ নামক একটা জায়গা। এক মহাপ্রাণ উদার বাঙালি পরিবার আমাদের ঠাঁই দিয়েছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে অস্ট্রেলিয়াতে বাড়ি ভাড়া পাওয়া খুব একটা সহজ নয়। এখানে কোথাও আগে উঠে তারপর বাড়িভাড়া করতে হয়। বাড়ি ভাড়া করার আগে বাড়িওয়ালার কাছে একটা সাক্ষাৎকার দিতে হয়। তারপর পাওয়া যায় কাঙ্খিত বাড়ি। ব্রিজবেনে ঐ বাঙালি পরিবারটির বাড়িটি ছিল ট্রাইপ্লেক্স, ছিমছাম সুন্দর বাড়ি। বাড়ির ভেতরে অনেক কাঠের কাঠামো। পেছনে ঘাসের মাঠ। একটা অনেক বড় মরা ক্যামফার লওরেল গাছ। খুব সুন্দর, ছবির মতো বাড়ি। এই বাড়ির কর্তা এশতেহাদুর রহমান ও তার স্ত্রী বনি টুসি দু’জনই কুইন্সল্যান্ড রাজ্য সরকারের চাকুরি করেন। তিনটি সন্তান নিয়ে তাদের এক অসাধারণ পরিবার।
আমি নিজেকে একজন ভেতো, অলস ও আড্ডাবাজ বাঙালি হিসেবেই মনে করি। তাই আমার স্ত্রীর যখন ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডে স্কলারশিপ হলো তখন থেকেই আমার মন বিষণ্ণ। আমি অনেক চেষ্টা করেছি অস্ট্রেলিয়া আসা পেছাতে। কিন্তু এ বিষয়ে আমার স্ত্রী ছিলেন নাছোড়বান্দা। সব কাজ সময় মতো করা তার রক্তে। তাই সময় মতোই এই দেশে আগমন।
আমরা যেদিন অস্ট্রেলিয়াতে পৌঁছায় সেদিন এখানে ছিল মাত্র ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। অনেক ঠাণ্ডা। আমাদের সাথে ৪টি বড় লাগেজ, সাথে আরও কিছু ব্যাগ। এয়ারপোর্টের বাইরে এসেই একজন সাহায্যকারীকে জানালাম, আমরা একটা বড় গাড়ি খুঁজছি। কি আশ্চর্য, একটু পরেই আমাদের সামনে চলে এলো একটা বড় গাড়ি। যেগুলোকে বলে ম্যাক্সি ট্যাক্সি। সুদর্শন পাঞ্জাবি কার চালককে জিজ্ঞাসা করলাম তার দেশের কথা। নরেন্দ্র মোদির প্রতি তার বিরক্তি তিনি লুকালেন না। বলিউডি পাঞ্জাবি সিনেমা ও অক্ষয় কুমারের কথা তুললাম। অক্ষয়কে তো তিনি এক প্রকার ধুয়ে দিলেন। মোদির পুতুল বললেন। সম্রাট পৃথিবীরাজ সিনেমার কার্যকর সমালোচনাও করলেন। খুব মনে ধরলো উদার মনস্ক এই যুবককে।
গাড়ি চলতে শুরু করলো ব্রিজবেনের পথে। ব্রিজবেন মূলত ঢাকার মতোই নদীভিত্তিক শহর। নদীর নাম ব্রিজবেন। এই নদীকে ঘিরেই শহর। এই নদীর উৎপত্তি মাউন্ট স্ট্যানলিতে, কোরাল সাগরে মেশার আগে এই নদিটি ৩৪৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে। জন জোসেফ ওক্সলে নামের একজন ব্রিটিশ নাগরিক অস্ট্রেলিয়ার ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে এই নদীটি প্রথম পুরোপুরি ভ্রমণ বা আবিষ্কার করেন। পরের দিকে নিউ সাউথ ওয়েলস্ এর ব্রিটিশ গভর্নর স্যার থমাস ব্রিজবেনের নাম অনুসারে এই নদীর নামকরণ করা হয় ব্রিজবেন নদী। যাই হোক, এই নদীর মধ্যে দিয়ে জানজট মুক্ত সড়ক দিয়ে আমরা আর্ল স্ট্রিট, গ্রিনস্লপ পৌঁছায়। পর দিন আবার ব্রিজবেন নদী ধরে শহরের মধ্যে চলার সুযোগ হয়েছিল। এবার ব্যক্তিগত কার গাড়িতে করে সময় দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইন ইউ সোহাগ স্যার। তিনিও বর্ণনা করেছেন এই শহরের সাথে নদীর সম্পর্কের কথা। সোহাগ স্যার জানান, গত বছর নাকি এই নদীর পানি উপচে বন্যাও হয়েছিল ব্রিজবেনে।
অসাধারণ ঐ বাঙালি পরিবারের অতিথি হয়ে আমাদের অস্ট্রেলিয়ার জীবন শুরু হয়। দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ঐ বাড়িতে আমরা যথাযথভাবে বিশ্রামের সুযোগ পাই। সাথে বাঙালি খাবার। আমরা সত্যিই ভাগ্যবান, এমন একটা পরিবারের সান্নিধ্য আমরা পেয়েছিলাম। এরপর টুকিটাকি কেনাকাটা করতে আমরা যাই একটা শপিং মলে। উলওরথ মেগা শপিং মল। শপিং মলে ঢোকার পরেই চোখে পড়ে একটা বিস্ময়। একটা তাক, যাতে অনেক ফল রাখা। সাথে লেখা, এই ফলগুলো শিশুদের জন্য ফ্রি। কি অসাধারণ চিন্তা, কি দুর্দান্ত আমন্ত্রণ। বিষয়টা আমার খুব ভাল লাগলো। তারপর প্রয়োজনীয় কেনা-কাটা শেষে বাড়ি ফেরা।
ধর্মে আমি মুসলমান কিন্তু ধর্ম খুব একটা চর্চা করা হয় না। মানে সব সময় নামাজ পড়া হয় না। যার জন্য আমার পরিবারে তিরস্কারের শেষ নেই। তবে বিশেষ সময়ে আমার সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে খুব ভাল লাগে। অন্তরে শান্তি আসে। মনে প্রশান্তি পাই। ১১ ডিগ্রি তাপমাত্রার, শব্দহীন এই শহরে আমার সৃষ্টিকর্তাকে ডাকার ইচ্ছা প্রবল হলো। নামাজ পড়তে গেলাম বাড়ির পাশের অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক কলেজ মসজিদে। ইসলাম ধর্মীয় একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত মসজিদ। এই মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে জানতে ইচ্ছে করলো, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে কিভাবে কুরবানীর ইদ উদযাপিত হয় সে বিষয়ে। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানলাম কয়েকটি অবাক করা তথ্য। প্রথম কথা, রাস্তায় পশু কুরবানী, অসম্ভব। ঢাকা বা বাংলাদেশের অন্য শহরে যা অতি পরিচিত দৃশ্য। বাড়িতেও সাধারণত কুরবানী হয় না। কুরবানী হয় দুইভাবে। এক. বুচার বা কসাইয়ের দোকানের মাধ্যমে। ব্রিজবেনের মুসলিমরা কসাইয়ের দোকানে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে আসেন। সেই টাকা দিকে পশু কিনে, জবাই দেওয়া হয়। তবে মাংস বাড়িতে আসতে সময় লাগে ২-৩ দিন। দুই. মসজিদের মাধ্যমে। আপনি মসজিদে নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা দিয়ে আসতে পারেন। তা দিয়ে মসজিদ কমিটি পশু কিনে জবাই দেবে। ২-৩ দিন পর মাংস বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে। এটাই একটু অদ্ভূত লাগলো। কুরবানীর মাংস খেতে ২-৩ দিনের অপেক্ষা! হায়! বলে কি!
যতই অস্বাস্থ্যকর হোক না কেন, যতই পরিবেশবান্ধব না হোক না কেন, উঠানে কুরবানী জবাই করা আর যত দ্রুত সম্ভব মাংস খাওয়ার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ আছে। আরও আনন্দ বাড়ি-বাড়ি মাংস বিতরণে। স্বজনদের কাছ থেকে সালামি গ্রহণে। যা অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোন বিদেশ বিভূঁইয়ে নেই। আজ এই ইদের দিনে বাংলাদেশের সবাইকে ইদ মোবারক। ভাল থাকুক আমার দেশ, ভাল থাকুক আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষ। আর ভাল খেলুক বাংলাদেশ, ক্রিকেট দল। ইদ মোবারক।
লেখক: শিক্ষক
সারাবাংলা/আরএফ/এএসজি
কুইন্সল্যান্ডে ২-৩ দিন পর বাড়িতে পৌঁছে কুরবানীর মাংস মত-দ্বিমত রাহাত মিনহাজ