বাইডেন বাইট: সৌদির বাড়োয়ারি
১৭ জুলাই ২০২২ ১৮:৩৬
কী ঘটাতে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন? কেবলই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট উৎরাতেই তার মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি সফর? নাকি আগে-পিছে, ডানে-বামে আরো কিছু লুকিয়ে আছে তার হাই প্রোফাইল ফোর ডে জার্নির আড়ালে?
গুরুতর এসব প্রশ্নের খানিকটা জবাব বাইডেন দিয়েছেন তার মধ্যপ্রাচ্য সফরের চতুর্থ তথা শেষদিনে জেদ্দায় গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল,জিসিসি’র সম্মেলনে। রাখঢাক না রেখেই বলে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে এমন কোন শূণ্যতা তৈরি করবে না যেখানে রাশিয়া, চীন, ইরান সেই জায়গা দখল করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যাবে না-এমন ঘোষণার সঙ্গে যোগ করলের, ইরান কখনো পরমাণু অস্ত্র পাবে না মর্মে প্রতিশ্রুতি। সম্মেলনটিতে জিসিসি’র শরীক ৬ দেশ সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, কুয়েত, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি অংশ নেন জর্ডান, মিসর ও ইরাকের নেতারাও। এরআগে, জেদ্দায় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। যদিও, সফরের আগে প্রচার ছিল সৌদি যুবরাজের সাথে তার কথা না বলার ঘোষণা। কিন্তু বাস্তবে জেদ্দায় গিয়ে কেবল দেখা নয়, ক্লোজডোর বৈঠকও করেছেন। বলেছেন এক্সক্লুসিভ কথাবার্তা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী চলমান জ্বালানি সংকটের মাঝে বাইডেনের সৌদিসহ মধ্যপ্রাচ্য সফর সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমে হট নিউজ। টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড ঘটনা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ, কূটনীতিক, বিশেষজ্ঞসহ নানা মহলে এ চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ। সৌদি সফরের জো বাইডেন ইসরাইল ও ফিলিস্তিন সফর করেন। আলোচনায় ঘুরেফিরেই এসেছে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যা প্রসঙ্গ। সাংবাদিকদের বাইডেন জানান, খাশোগি হত্যার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এ বিষয়ে সৌদি যুবরাজের কাছে নিজেদের মতামত স্পষ্ট করেছে ওয়াশিংটন।
আরব নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠক ও আলোচনায় জ্বালানী তেলের কথার ফাঁকে সৌদির সঙ্গে সম্পর্ক পুনুরুদ্ধারের বার্তা দিয়েছেন নানা কথামালায়। অথচ এর আগে মানবাধিকার ইস্যুতে সৌদি আরবকে একঘরে করার হুমকি দিয়েছিল বাইডেন প্রশাসন। মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সবচে’ বেশি তেল সরবরাহকারী দেশ সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে তৎপরতা। চীন, রাশিয়া, জাপান, কানাডা এমন কি ইউক্রেনসহ বিশ্বের সব মেরু ও গোলার্ধের জন্যই তা নতুন করে ভাবনার বিষয়। অনেকের জন্য অসহ্য বেদনার। কামড়ে ধরা বা বাইটের মতো বিষাক্ত কারো কারো কাছে। বাইডেনের এ মিডেল ইস্ট কূটনীতির বেনিফিসিয়ারি হবে কারা? ক্ষতিগ্রস্তই বা হবে কারা?- এদিকেও চোখ সবার। এ নিয়ে এন্তার বিশ্লেষণ।
বাইডেনের এই সফর নিয়ে বিতর্ক তার দেশেও। এমন কি তার দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভেতরের একটি অংশও নাখোশ। প্রেসিডেন্ট তার নীতি-নৈতিকতা খেলাপ করলেন বলেও অভিযোগও কারো কারো। সৌদি আরব আগাগোড়া মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রধান একটি মিত্র দেশ। অনেক দিন ধরেই আমেরিকার নতুন যে কোন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা নিয়ে প্রথম যেসব দেশে যান তার একটি সৌদি আরব। নানান ঘটনা প্রবাহে এখন বিতর্ক এবং বিশ্বজোড়া অনেকের চোখ ছানাবড়া। এর মূল কারণ প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে-পরে বাইডেনের কথা, অঙ্গীকারের সাথে সফরটির সামঞ্জস্যহীনতা। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের ভূমিকা নিয়ে বহু মার্কিনীর মতো বাইডেনও ক্ষুব্ধ ছিরেন। তারওপর সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডে তিনি যুবরাজ সালমান এবং সৌদি রাজপরিবারের ওপর ছিলেন যারপরনাই নাখোশ। নির্বাচনী প্রচারণায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেলে একঘরে করে ছাড়বেন এই সৌদি শাসকদের। এখন ওই শত্রুর সঙ্গেই মিতালি?
দশকের পর দশক ধরে জ্বালানি তেলের স্বার্থে মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে সৌদি রাজপরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাইডেন ক্ষমতায় এসে বলতে শুরু করেন বাইরের যে কোনো দেশের সাথে তার সরকারের সম্পর্কের ভিত্তি হবে মানবাধিকার। এরপর নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গিয়েও তিনি সৌদি যুবরাজ সালমানের সাথে দেখা করতে বা কথা বলতে অস্বীকার করেন। সৌদি যুবরাজ তার সাথে কথা বলতে কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সৌদি আরবের কাছে নূতন অস্ত্র বিক্রিও স্থগিত করেন। এরপর একটু একটু করে বোল বদল। এক পর্যায়ে গত মাসে জানান- সৌদি যাবেন তবে, যুবরাজ সালমানের সাথে তার কোনো কথা হবে না। কিন্তু সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় দুজনের মধ্যে কেবল কথা নয় বৈঠকও হবে। শেষমেষ হয়েছেও তাই।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, বাস্তবতার কাছে মাথা নত করছেন ৭৯ বছরের এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আর এর পেছনে প্রধানত কাজ করছে ইউক্রেন যুদ্ধ। কিছুদিন আগে, ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় বাইডেন এক নিবন্ধে লিখেছেন, সৌদি আরবকে “ব্ল্যাংক চেক” দেওয়ার নীতি তিনি বদলে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ইউরোপে যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের এবং সৌদি আরবের গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করছেন। …রাশিয়ার আগ্রাসনের পাল্টা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে। চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় আমাদের শক্ত অবস্থান প্রয়োজন….এ কারণে সেসব দেশের সাথে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে যারা আমাদের চেষ্টায় সাহায্য করতে পারে। সৌদি আরব তেমন একটি দেশ…।
এ ধরনের যুক্তি ও মন্তব্যের মধ্য দিয়ে নতুন এক বাইডেনকে দেখছে বিশ্ববাসী। বাইডেন প্রশাসনের একাংশের মধ্যে কিছুদিন ধরে যুবরাজ সালমান এবং সৌদি আরব নিয়ে প্রেসিডেন্টের অবস্থানের পরিণতি নিয়ে অস্বস্তির মাঝেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। ছযুক্তরাষ্ট্রের তেলের বাজারে অস্থিরতা। এ রকম সময়ে সৌদির সঙ্গে খাতির পাতানোকে ওয়াশিংটনে গবেষণা সংস্থা মিডল-ইস্ট ইন্সটিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রায়ান কাটুলিসের মতে, এটি ছেলেমানুষি কাটিয়ে বাইডেনের অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা। এর বিপরীতে বলা হচ্ছে, আপসকামীতা। তিনি আবার প্রমাণ করছেন আমেরিকার ক্ষমতার রাজনীতির মূলে রয়েছে সম্পদ এবং তেল। মানবাধিকারকে বিদেশ নীতির মূলে রাখার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন তা মিথ্যা প্রমাণ করে ছেড়েছেন।
সৌদিদেরও হিসাব আছে মার্কিনিদের নিয়ে। গত দেড় বছর ধরে হোয়াইট হাউজের কাছ থেকে অবজ্ঞায় যথারীতি নাখোশ ক্ষমতাধর সৌদি যুবরাজ। সে কারণেই ইউক্রেন যুদ্ধের পর পুতিনকে একঘরে করার আমেরিকার চেষ্টায় তেমন সাড়া দেয়নি সৌদি আরব। খুব হিসাব কষে তেলের উৎপাদন কিছুটা বাড়িয়েছে। তবে, প্রচার করেছে বিশাল আয়োজনে। সেইসঙ্গে সৌদি যুবরাজের একটি অ্যারেঞ্জ সাক্ষাৎকার। সেখানে বাইডেনের সাথে তার ঠাণ্ডা সম্পর্ক নিয়ে এক প্রশ্নে বলেছেন, এতে আমার কিছুই আসে যায়না। সৌদি আরবকে অবজ্ঞা করলে আমেরিকার জন্য তা হবে দুর্ভাগ্য এবং চীনের জন্য সৌভাগ্য।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের খুবই ঘনিষ্ঠ যুবরাজ সালমানকে হাত করা জরুরি হয়ে পড়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের। খাসোগি হত্যায় তিন বছর আগে চরম ভাবমূর্তি সংকটে পড়া যুবরাজ তার কূটনীতির ডালপালা ছড়ান আরো নানা দিকে। যার জেরে সৌদি রাজপুত্র হিসেবে পাঁচ বছর পূর্তির সময়ে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ বিশ্বনেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটছে তার। সেই তালিকায় চলে এলেন তার চরমবিরোধী তথা একঘরে করার হুমকিদাতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনও। আবার বড় মাঠের খেলায় পটু পুতিনও ততো দূরে নন। রাশিয়া কখনো মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে যায়নি, চীনও সেখানে সক্রিয় হচ্ছে। অর্থনৈতিক এবং কূটনীতিক সবদিক থেকেই চীন সেখানে যুক্ত হচ্ছে। চীনের জিবুতিতে প্রথমবারের মতো বিদেশে তৈরি করা সামরিক ঘাঁটিটি মার্কিন ঘাঁটির খুব কাছেই। এ অবস্থায় মার্কিন-সৌদি খেলাটা অনেকাংশেই রকমারি বা বাড়োয়ারির মতো।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি