যুবসমাজকে অপরাধ ও সহিংসতার পথ থেকে ফেরাতেই হবে
১২ আগস্ট ২০২২ ১২:০৫
যে কোনও দেশের যুব সমাজ সেই দেশের জন্য সবচেয়ে বড় শক্তি। এদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এ দেশের যুবসমাজ। শুধু তাই নয় দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজকে আলোকিত করতে এই যুব সমাজের ভূমিকা অবিস্মরণীয় ভূমিকা অনস্বীকার্য। যুবসমাজ এদেশের ক্রান্তিকালে সব সময় নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করার মধ্য দিয়ে নিজেরা যেমন হয়েছেন ইতিহাসের উজ্জ্বল স্বাক্ষী, তেমনিভাবে তাদের এই আত্মত্যাগ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হয়ে আছে চির অনুসরণীয়। বৈশ্বিক করোনা মহামারি সংকটের মাঝেও বাংলাদেশের যুবসমাজ নিজের মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করেও সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার অস্তিত্ব রক্ষায় অনেক মানবিক উদ্যোগে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।
বিশ্বব্যাপী সামগ্রিক পরিবর্তন আনতে যুব সমাজের এই অবদানের স্বীকৃতি সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে প্রতি বছর ১২ আগস্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশের জন্যও দিবসটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠিই তরুণ ও যুবক। তারাই উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রকৃত কারিগর। এ প্রেক্ষাপটে প্রতিবছর জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক যুব দিবসের জন্য একটি প্রতিপাদ্য নির্বাচন করে। তারপর এই প্রতিপাদ্যের ভিত্তিতে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ সম্পর্কে যুবকদের মতামতও জানা যায়। তাদেরও পরামর্শ নেওয়া হয়। জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন আনতে যুবকদের সম্পৃক্ত করার বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণাসহ নানা বর্ণিল কর্মসূচি পালন করে থাকে।
প্রতি বছরের ১২ আগস্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস পালিত হয়ে থাকে। ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক যুব দিবস পালনের প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়েছিল। ২০০০ সালের ১২ আগষ্ট দিনটি প্রথম পালিত হয় । বিশ্বের সব দেশের সরকারের মধ্যে তাদের দেশের যুবকদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং তাদের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য সচেতনতা তৈরি করা এই দিবসের লক্ষ্য। বিশ্বের সব দেশকে সচেতন করা হয় যে, যুবকদের প্রতি মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন আছে। তাদের শিক্ষা থেকে স্বনির্ভর হওয়ার পথে তাদের সাহায্য করা সরকারের কর্তব্য। আরো উদ্দেশ্য হলো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঘটনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে যুবদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং মতামত প্রদানের সুযোগগুলো প্রসারিত করা। এই উপলব্ধির কথাগুলো সবাইকে জানাতেই প্রতিবছর আন্তর্জাতিক যুব দিবস পালিত হয়। আন্তর্জাতিক যুব দিবস ২০২২ উপলক্ষ্যে এবারের প্রতিপাদ্য হল- ‘Inter-generational Solidarity: creating a world for all ages’। এটিকে বাংলায় চিন্তা করলে যার অর্থ দাড়ায় ‘আন্তঃপ্রজন্ম সংহতিঃ সকল বয়সের জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলি’। ‘কেউ পিছিয়ে থাকবে না’ এটি নিশ্চিত করার জন্য আমাদের অবশ্যই সফল এবং ন্যায়সঙ্গত আন্তঃপ্রজন্ম সম্পর্ক এবং অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে সহযোগিতা করতে হবে। যদিও বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলায় উদ্বেগের বিষয় হিসেবে আন্তঃপ্রজন্মীয় সংহতি ও ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বয়সবাদকে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। কারণ ভিন্ন ভিন্ন বয়সের ও প্রজন্মের চিন্তা-ভাবনা, মানুষের দর্শন, মানসিকতা বৈচিত্র্যময় হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে সমাজে, রাষ্ট্রে বসবাসরত সকল বয়সী মানুষের মধ্যে সংহতি তৈরি করা এবং যার মাধ্যমে একটি সুন্দর বিশ্ব তৈরির বিষয়টিকেই এ বছরের প্রতিপাদ্যে গুরুত্ব দিয়ে বিষদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সাম্প্রতিককালগুলোতে বাংলাদেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা বাড়ছে। গত তিন বছরে এ প্রবণতা বাড়ার হার সবচেয়ে বেশি। অপরাধের মধ্যে যৌন হয়রানি ও লাঞ্ছনার ঘটনা বেশি। অঞ্চল হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে তরুণদের সহিংস ঘটনা সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে ময়মনসিংহ ও সিলেটে সবচেয়ে কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা, সুস্থ বিনোদনের অভাব, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তরুণদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির (বিপিও) উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) করা একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশের শান্তি পরিস্থিতি ২০২১’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৫ কোটি ৯০ লাখ তরুণ জনগোষ্ঠী আছে। এরা জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ। বর্তমান বিশ্বে তরুণদের সহিংস কর্মকাণ্ড একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশেও একইভাবে কিশোর গ্যাং, হামলা, চুরি, ছিনতাই, যৌন অপরাধী হিসেবে তরুণেরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছেন। বিপিও বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে আশঙ্কাজনকভাবে যুব সহিংসতা বাড়ছে। শুধু ঢাকাতেই প্রায় ৭০টি ‘কিশোর গ্যাং’ সক্রিয় রয়েছে। তারা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক পাচার, এমনকি খুনের মতো অপরাধে জড়িত। সাইবার প্রযুক্তি তরুণদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়াকে আরও সহজ করেছে। বিপিও বলছে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সাক্ষরতার হারের তুলনায় শ্রমশক্তিতে তরুণদের অংশগ্রহণ সন্তোষজনক নয়। বেকারত্বও বাড়ছে। শিক্ষিত ও দক্ষ যুবক যারা অর্থনৈতিকভাবে এবং সম্ভাব্যভাবে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারছেন না, তারা অনেক সময় অপরাধ ও সহিংসতার জীবনের দিকে ঝুঁকছেন। পাশাপাশি অভিভাবকত্ব, মা–বাবার সম্পর্কও সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া বাংলাদেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধিও যুব সহিংসতার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার পেছনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করছে।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর মতো এতো জটিল সময়েও যুবসমাজ মানবিক সহায়তা ও জাতিগত বৈষম্যের মতো ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে এবং সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তাই আমাদেরকে যুব সমাজের মাঝে বিরাজমান সঙ্কট দূর করার ক্ষেত্রে আশাবাদী হতে হবে। যুব সমাজকে এই অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করতে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। প্রয়োজনীয় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশের সম্ভাবনাময় যুবসমাজকে কেউ যেন ভুল পথে ধাবিত করতে না পারে, সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। কারণ আজকের এই যুবসমাজই আগামী দিনে এদেশের কর্ণধার হবেন। রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। সুতরাং এখন থেকে তাদের মাঝে যদি ইতিবাচক মূল্যবোধের চর্চা এবং জীবন সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি করা যায়, তাহলে এটি যেমন ঐ যুবদের ব্যক্তিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তেমনি এ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের চাকাকে গতিশীল রাখতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।
আমরা অনেক সময় মুষ্টিমেয় যুবদের এই অধঃপতনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাই না। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমরা যদি আগামীর সঠিক নেতৃত্ব, টেকসই সামাজিক উন্নয়নের কথা ভাবি, তাহলে যুবদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এটি কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই, নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও যুবসমাজকে অপরাধ ও সহিংসতার পথ থেকে ফেরাতে হবে। যুবদের সুপ্ত প্রতিভা ও সম্ভাবনাকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ তারাই সমাজ ও দেশের আশার আলো। তাদের মাঝে মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, নৈতিকতার শিক্ষাকে সঞ্চারিত করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিক উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও সদিচ্ছা খুব জরুরী। এই কাজে আমাদের হস্তক্ষেপ যত দেরী হবে, তত বাঁধাগ্রস্থ হবে সামাজিক উন্নয়ন। আর মুক্তিযুদ্ধের মতো মুক্তি সংগ্রামে যুব সমাজের অনন্য অংশগ্রহণ ও বিজয়ের ইতিহাস এক্ষেত্রে আমাদের সকলের পাথেয় হোক।
লেখক: জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মত-দ্বিমত যুবসমাজকে অপরাধ ও সহিংসতার পথ থেকে ফেরাতেই হবে সুমিত বণিক