‘বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়দের মারতে আর্মি আসতে পারে’
১৪ আগস্ট ২০২২ ২১:০২
“টুঙ্গিপাড়াসহ পুরো এলাকা ও শহরের প্রধান রাস্তা ও চৌরঙ্গী জনমানব শূন্য। রাস্তায় সাইকেল বা রিকশা কিছুই নেই। লঞ্চঘাটে কোনো যাত্রী নেই। নেই প্রাত্যহিক কোনও হাঁক-ডাক। লঞ্চগুলো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। এ যেন এক স্তব্ধ জনপদ। নারী-পুরুষশূন্য পুরো এলাকা। খালে, বিলে, ডোবায় যে যেখানে পেরেছে প্রাণভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। স্থানীয় পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন সবার মধ্যেই এক অজানা উৎকণ্ঠা। বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে সেনা সদস্যরা যখন টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছায়, তখন চারিধারে শোক আর ভয়মিশ্রিত শুনসান নীরবতা। মানুষ তো দূরের কথা, একটি পশুপাখির ডাকও শোনা যায়নি।”
সারাবাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ওপরের কথাগুলো বলেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাফন-কাফনে অংশ নেওয়া গোপালগঞ্জ মহকুমার তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম। সম্প্রতি রাজধানীর মগবাজারে নিজ ফ্ল্যাটে সারাবাংলাকে একান্ত সাক্ষাৎকার দেন পুলিশের সাবেক এই অতিরিক্ত আইজিপি।
“১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বিকেলে বৈঠক হয়েছিলো পুলিশ বিভাগের (এসডিও) সেকেন্ড অফিসার লুৎফর রহমান চৌধুরীর বাসায়। কয়েকদিন থেকে এসডিও সাহেব এলাকায় ছিলেন না। তিনি সরকারি কাজে ঢাকায় ছিলেন। ঐদিন আমাদের আলোচনার প্রধান বিষয় ছিলো গভর্নরদের ট্রেনিং নিয়ে। আলোচনা হয়েছিল, সকল মহকুমা জেলা হয়ে যাবে। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড নতুন রূপ ও গতি পাবে ইত্যাদি। রাত সাড়ে নয়টা থেকে দশটার দিকে আমরা প্রতিদিনের মতো যার যার বাসায় চলে যাই।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার ভোর ছয়টা-সাড়ে ছয়টায় গোপালগঞ্জ থানার ওসির টেলিফোন পাই। টেলিফোনে ওসি বলেন, রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। রেডিও অন করেন। দ্রুত রেডিও অন করতেই ইথারে ভেসে আসে, “আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। পরিবারের সকলকে হত্যা করা হয়েছে। মন্ত্রীদের হত্যা করা হয়েছে। দেশে ‘মার্শাল ল’ জারি হয়েছে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের সামরিক আইনে বিচার করা হবে ইত্যাদি।”
এ খবরে সকলে হতভম্ব, কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং স্তব্ধ। সার্কেল ইন্সপেক্টর এবং সদর থানার ওসি টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তাদেরকে পুলিশ লাইনে আসতে বলি এবং আমি দ্রুত পোশাক পরে বাসা হতে কাছারিপাড়া ইমার্জেন্সি পুলিশ লাইনে রওয়ানা দেই। রাস্তাঘাট ফাঁকা। রিক্সা, সাইকেল নেই। লোকজন প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। শহরের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা থমথমে। রাজনীতিবিদ, চাকরিজীবী, ছাত্র-শ্রমিক, ধনী-গরীব, কামার-কুমার, জেলে সকলেই নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। পুলিশ লাইনে গিয়ে উপস্থিত বিভিন্ন পদের ৫০/৫৫ জন পুলিশ অফিসারকে কোত (অস্ত্রাগার) হতে অস্ত্রগুলি নিয়ে দ্রুত পোশাকে পরে প্রস্তুত হতে বলি। কারণ, যদি কোনো বিপদ আসে তা যেন সাথে সাথে মোকাবিলা করা যায়। পুলিশ লাইনে যাবার পর আমার বার বার মনে হচ্ছিল, বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় এবং অনুসারীদের গ্রেফতার বা মেরে ফেলার জন্য যশোর বা খুলনা থেকে আর্মিরা এখানে আসতে পারে। তাই পুলিশ লাইন হতে ওয়্যারলেসে থানা এবং ক্যাম্পকে মেসেজ দেই, সকলে যেন নিজেদের অস্ত্রগুলি নিয়ে ‘ষ্ট্যান্ড টু’ (অপারেশনাবস্থায়) থাকে এবং নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা গ্রহণ করে।
আমার অফিস ও বাসাটি ছিলো শহরের খুবই ঘনবসতিপূর্ণ সাহাপাড়া এলাকার মাঝখানে। শহরের কেন্দ্র চৌরঙ্গী লঞ্চঘাট হতে বামদিকে কাপড়ের বাজারের সরু রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসা করতে হয়। ঐ রাস্তাটি একটা রিকশা চলাচলের মতো চওড়া ছিলো। তাই আমি হেঁটে আসা-যাওয়া করতাম। লাইনে যাবার সময় লক্ষ্য করি, স্থানীয় লোকজন ঘরের আঙ্গিনায়, দোকানের সামনে জড়ো হয়ে রেডিওর খবর শুনছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। অনেক দূর পর্যন্ত রেডিওর ঘোষণা শোনা যাচ্ছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। শহরের প্রধান রাস্তা ও চৌরঙ্গী জনমানব শূন্য। সাইকেল বা রিকশা কিছুই চলাচল করছে না। ঘাটে কোনো যাত্রী নেই। যাত্রীর জন্য কোন হাঁকডাকও নেই। লঞ্চগুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। এ যেন এক স্তব্ধ জনপদ।
ওই সময় গোপালগঞ্জ শহরটি মধুমতি নদী, কাটা খাল, ভেন্নাবাড়ি খাল ও জলাশয় বেষ্টিত। কাটা খালের পাড় দিয়ে চৌরঙ্গী হতে বেত গ্রাম পর্যন্ত একটি মাত্র রাস্তা। যার দৈর্ঘ্য হবে দেড় দুই কিলোমিটার, শুধুমাত্র রিকশা চলাচলের উপযোগী।
পুলিশ লাইনে গিয়ে দেখি, ইতোমধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট লুৎফর রহমান চৌধুরী, ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল কাদের, প্রবেশনাল ম্যাজিস্ট্রেট হাসানুজ্জামান, পুলিশ পরিদর্শক শেখ আব্দুর রহমান, শেখ ইছাক ফকির, সদর থানার ওসি আবুল কালাম, জনতা ব্যাংক অফিসার হাবিবুর রহমান এবং আরও কিছু সিভিল অফিসার ও কলেজ শিক্ষক পুলিশ লাইনে এসে হাজির হয়েছেন। সকলেই আতংকিত এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। সকলের সাথে আলোচনা করে ঠিক হয়, লাইনের পুলিশদের ৫ ভাগে ভাগ করে ৪ ভাগকে লাইনের ৪ কোনায় বাংকার খনন করে প্রস্তুত রাখা হবে। যদি কোনও বিপদ আসে তা যেন সাথে সাথে মোকাবিলা করা যায়।
এদিকে সকাল হয়ে গেছে। দেখলাম শহর ও আশপাশের লোকজন বাসাবাড়ি ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যাচ্ছে। পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে শহরের লোকজন আরও ভীত হয়ে পড়ে। এরপর যে যেদিকে পারে দুর্গম এলাকায় বা নৌকা করে পরিবার নিয়ে জীবন বাঁচাতে হাওরে-বাওড়ে চলে যায়। অবস্থা জানতে আমি টিএসআইকে (শহর দারোগা) শহরের অবস্থা জেনে আসার নির্দেশ দেই। শহরের কাছারিপাড়া, থানাপাড়া, ব্যাংকপাড়া ইত্যাদি এলাকা ঘুরে এসে তিনি জানান, লোকজন বাড়িঘর, গরু-বাছুর, হাঁস-মুরগী ফেলে জীবন নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। অনেকে চলেও গেছেন ইতোমধ্যে। থানার ওসি ও টিএসআইয়ের তত্ত্বাবধানে থানার সাইকেলধারী সেপাই দিয়ে শহর এলাকায় সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। ফোর্সের সাথে দুপুর ও রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। রাত ১১টার দিকে থানার ও লাইনের সকলকে সার্বক্ষণিক সতর্ক থাকার কথা বলে বাসায় ফিরে যাই।
এই মর্মান্তিক ঘটনার পর হতে সারাদিনই আমি টেলিফোন ও পুলিশ বেতারের মাধ্যমে ঢাকা ও ফরিদপুরের অবস্থা জানার চেষ্টা করছিলাম। মর্মান্তিক ওই ঘটনার আগেই ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ফয়েজুর রাজ্জাক ও পুলিশ সুপার এজহারুল হক নবনির্বাচিত জেলা গভর্নরদের ট্রেনিং কর্মসূচীতে সহযোগী ষ্টাফ হিসেবে অংশ নিতে ঢাকা চলে গিয়েছিলেন। ঘটনার পর বহুবার তাদের সাথে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই।
এদিকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচিত কর্মকর্তা এবং শহরের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি টেলিফোনে জানতে চাইছেন বাড়িতে থাকা নিরাপদ কি না? আর্মি আসার কোনো খবর আছে কি না ইত্যাদি। উত্তরে বলেছি, আর্মি আসার কোনো খবর পাইনি। আসলে লঞ্চে বা হেলিকপ্টারে আসবে। দূর থেকে দেখা যাবে। তখন যা ভাল মনে করেন করবেন। এখন যার যার বাসায় থাকেন যাতে বাড়িঘরের মালামাল চুরি-ডাকাতি বা লুটপাট হতে না পারে। আমাকেও অনেকে পরামর্শ দিলেন, পালিয়ে যেতে। তারা বলেছেন, আপনি বঙ্গবন্ধুর লোক। আর্মি আসলে আপনাকে গুলি করবে। সেইসময়ে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলাম। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর মামা খানসাহেব শেখ মোশাররফ হোসেন ও তার স্ত্রীর পরামর্শ আমাকে খুবই আতংকিত করেছিলো। তবুও আমি সকলকে আশ্বস্ত করে বলেছি, পুলিশের দিক হতে কোনও ভয় নেই। আপনাদের সম্পদ ও বাড়িঘরের নিরাপত্তায় পুলিশ তৎপর আছে। অসুবিধা মনে করলে জানাবেন। আর্মি আসার খবর পেলে তা-ও জানাবেন। আর আমরা জানতে পারলে সকলকে জানানোর চেষ্টা করব। ভবিষ্যতে আরও কি ভয়াবহ ঘটনা অপেক্ষা করছে, তার চিন্তা এবং নিজেকে কীভাবে নিরাপদ রাখব তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সময় দ্রুত চলে গেছে।
গোপালগঞ্জের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ বঙ্গবন্ধুর নিকটআত্মীয়দের অনেকের কাছেই আমি আস্থাবান ছিলাম। এদের অনেকেই টেলিফোনে বা কারও মাধ্যমে আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, খুলনা ইত্যাদি বড় শহরে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কোনও খবর পুলিশ বেতারের মাধ্যমে পাওয়া গেছে কি না? রক্ষীবাহিনীর ভূমিকা কী ইত্যাদি। সন্ধ্যার দিকে পুলিশের ওয়্যারলেস অপারেটর এসে খবর দিল মানিকগঞ্জের মহকুমা পুলিশ অফিসার আমাদের ব্যাচমেট সুকুমার দত্তকে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হলো,সম্ভবত ভয়ে অথবা প্রতিবাদে অন্যত্র চলে গেছে। আমি আরও নার্ভাস ফিল করছিলাম। কিন্তু কাউকেও বোঝার সুযোগ দিচ্ছি না।”
চলবে…
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
‘বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়দের মারতে আর্মি আসতে পারে’ ১ম পর্ব আজমল হক হেলাল মত-দ্বিমত সাক্ষাৎকার