Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধু হত্যা; নেপথ্য কুশীলবদের চিনতে আর কত অপেক্ষা?

মানিক লাল ঘোষ
১৫ আগস্ট ২০২২ ১৫:৩৩

বাঙালির রাখাল রাজা, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হারানোর ৪৭ বছরেও আমরা এই নৃশংস ঘটনার নির্দেশদাতা ও ষড়যন্ত্রকারীদের আইনের আওতায় আনতে পারিনি। এটা খুবই কষ্টের, তবে আশার সংবাদ ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ষড়যন্ত্রের তদন্ত এবং জড়িতদের বিচারের দাবি জোরালো হচ্ছে দিন দিন। গত কয়েক বছর ধরে এ বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা, গণমাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও বিশিষ্টজনের সাক্ষাৎকার ও টকশোতে দাবি উঠছে জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠনের। যদিও এই দাবি দীর্ঘদিনের স্বাধীনতাপক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে রয়েছে। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এটা করা জরুরি বলে তারা মনে করছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়। এর মধ্যে ৬ জনের মুত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। বাকি ৬ জনের ৫ জন এখনও অধরা। ২০০২ সালে মারা গেছে এক জন।

বিজ্ঞাপন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার গঠন করলে বিচার কাজ ঝুলে যায়। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে ৫ জনের এবং চলতি বছর এক জনের ফাঁসি কার্যকর হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে যাদের সাজা হয়েছে, তারা ছিলেন আত্মস্বীকৃত খুনী। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা ছিলো, কারা ষড়যন্ত্র করেছিলো, কারা খুনীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করেছে সে বিষয়ে তদন্ত কিংবা বিচার এখনও হয়নি।

আমরা স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উৎসব উদযাপন করেছি, গত বছর জন্মশতবর্ষে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছি বঙ্গবন্ধুকে অথচ ৭৫ আগস্টের খলনায়কদের বিচার করতে পারিনি। শোকার্ত আগস্ট এলেই প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মাঝে বেড়ে যায় রক্তক্ষরণ। তাই এ বিষয়ে সঠিক তদন্ত ও বিচার জরুরি বলে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, স্বাধীনতার সপক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গত কয়েক বছর ধরে এই দাবির পক্ষে তাদের সমর্থন জানিয়ে আসছে।

রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিশিষ্টজনেরা বলছেন, সামরিক বাহিনীর কিছু অফিসার ও সৈনিকের দ্বারাই শুধু এই ন্যাক্কারজনক ও দুঃসাহসিক হত্যাকাণ্ড সম্ভব ছিল না। এর পেছনে অনেক বড় ধরনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র কাজ করেছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, অর্থাৎ ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই তদন্ত ও বিচার হওয়া জরুরি।

এদিকে তদন্তের পর ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার বাংলাদেশ করতে না পারলে আন্তর্জাতিকভাবে বিচার চাওয়া যেতে পারে বলেও পরামর্শ তাদের। তারা মনে করেন দেরিতে হলেও এখনই সঠিক তদন্ত প্রয়োজন। এজন্য একটি জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও ১৪ দলের সমন্বয়ক বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আমির হোসেন আমু বলেন, ‘সঠিক তদন্ত হলে এই হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র কারা করেছিলো তা জানা যাবে। দেশবাসীর এটা জানা দরকার। এ জন্য তদন্ত হওয়া উচিত। ১৫ আগস্টের ঘটনায় কারা বেনিফিশিয়ারি, কারা খুনীদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন করেছে, বিদেশে পদায়ন করেছে তা বিশ্লেষণ করলেই এই ঘটনার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার বিষয়টি আলোতে চলে আসবে।’

আওয়ামী লীগের সাথে জোটভুক্ত না হলেও এ বিষয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান খান বলেন, “কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে প্রথমেই তারা বলেছিলেন একটা কমিশন গঠন করে তদন্ত করার। তার মতে এটা দ্রুত করা উচিত, কারণ এখনও সাক্ষী পাওয়া যাবে, অনেকেই বেঁচে আছেন। ‘সিআইএ’, ‘র’, ‘আইএসআই’ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট পর্যালোচনা করে তদন্ত করা যেতে পারে। কোনও দেশ বা ব্যক্তির জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের বিচার চাওয়া যেতে পারে। ষড়যন্ত্রের মূল নায়কদের সম্পর্কে জাতি ও বিশ্ববাসী জানতে পারবে। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই এটা জরুরি।”

১৪ দলের অন্যতম নেতা, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচার হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত ছিলো, সেটা চিহ্নিত করা দরকার। আর তা করতে হলে তদন্তের জন্য একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা দরকার। তদন্ত হলে অনেক সত্য বেরিয়ে আসবে। খল নায়কদের আসল চরিত্র দিনের আলোতে প্রকাশ পাবে। সব বিতর্কের অবসান হবে।’ এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে জন্য তদন্ত ও বিচার হওয়া জরুরি বলে মনে করেন এই প্রবীণ বামনেতা।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন সভায় তার বক্তব্যে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘জাতির পিতার হত্যায় মঞ্চের কুশীলবদের বিচার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এর বাইরে যারা ষড়যন্ত্রকারী ছিল তদন্ত কমিশন গঠন করে তাদেরও খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। নেপথ্য কুশীলব যারা, তাদের তদন্তের আওতায় আনতে হবে। নতুন প্রজন্মকে কোনও অবস্থায় অন্ধকারে রাখা যাবে না।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জননেতা ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এ প্রসঙ্গে তরুণ প্রজন্মের একজন প্রতিনিধির বক্তব্য তুলে ধরতে চাই। ১৫ আগস্ট নিয়ে যার আবেগ ও অনুভূতির মাত্রাটা অনেকটা বেশি। কারণ এই কালো রাতে মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি হারিয়েছেন তার প্রাণপ্রিয় বাবা- মাকে। শিশু বয়সে হয়েছেন এতিম। বঙ্গবন্ধুর ৪৭তম শাহাদাৎবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে মাসব্যাপী দুস্থ ও দরিদ্রদের মাঝে যুবলীগের রান্না করা খাবার বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। ১৫ আগস্টে শহীদ বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ও আরজু মণির জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ ফজলে শামস পরশ তার বক্তব্যে ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডকে গণহত্যার সামিল উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় নীলনকশা যারা তৈরি করেছিল, সেই মাস্টারমাইন্ডদের খুঁজে বের করার দাবি জানান।

যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ বলেন, ‘সেই নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারীদের এখনও বিচার হয়নি। তারা জামাত-বিএনপির আশ্রয়ে পশ্রয়ে এ দেশেই রয়ে গেছে। তাদের বিনাশ করতে হলে দেশি- বিদেশি চক্রান্তকারীদের খুঁজে বের করতে হবে তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে।’ পিতার আদর্শ বাস্তবায়নে যুবলীগের বর্তমান চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ তার সরল বক্তব্যে যেমন ইতিহাসের দায়মুক্তি, ঐতিহাসিক সত্য উদঘাটনে তদন্ত কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছেন। তেমনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় প্রতিক্রিয়াশীল স্বাধীনতা বিরোধীচক্রের রাজনৈতিক বিনাশকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এই বক্তব্যের সাথে একমত স্বাধীনতাপ্রেমী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ এদেশের গোটা যুব সমাজ।

আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, ‘সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যায় জড়িত ষড়যন্ত্রকারীদের খোঁজার বিষয়ে কমিশনের রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়েছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ হয়তো এই কমিশন চালু করা হবে। যার মাধ্যমে চিহ্নিত করা হবে খুনের ষড়যন্ত্রকারী এবং নেপথ্য কলা-কুশীলবদের।’ আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আমরা শ্রদ্ধাশীল কিন্তু কথা হচ্ছে নানা বাধা পেরিয়ে দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছর পর খুনীদের বিচার হয়েছে। তাও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আসার কারণে। তা না হলে এই বিচার হয়তো আদৌ সম্ভব হতো না।

বৈশ্বিক সংকটকে পুঁজি করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এর সাথে জড়িত রয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সুবিধাবাদী ও মাস্টার মাইন্ডরা। সময়ের প্রয়োজনে সময়ের দাবি কখনো উপেক্ষিত হতে পারে না। উন্নয়নের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু পরিবার সর্বোপরি স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে কমিশন গঠন ও এর কার্যক্রম দ্রুত চালু করা হোক। জাতির সামনে আনা হোক আড়ালে থাকা খলনায়কের। সেই সোনালি ভোরের অপেক্ষায় এ দেশের তরুণ প্রজন্ম।

লেখক: সহ-সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বঙ্গবন্ধু হত্যা; নেপথ্য কুশীলবদের চিনতে আর কত অপেক্ষা? মত-দ্বিমত মানিক লাল ঘোষ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর