মেগা প্রকল্পে মেগা গাফিলতি
১৭ আগস্ট ২০২২ ১৬:২৫
অফিসের গাড়িতে রোজ উত্তরা থেকে কর্মক্ষেত্রে যাই, আবার ফিরি। পথেই বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের বিভিন্ন ধাপের কাজ চলমান। এতোদিন ধরে এটাই দেখে আসছি। গত সোমবার জসীমউদ্দিন রোডের উল্টা পাশে যেখানে বক্স গার্ডারের চাপায় কফি কালারের প্রাইভেট কারটি ভেতরে থাকা যাত্রীসহ দুমড়ে যায়, ঠিক সেই জায়গাটি দিয়ে কতবার যে পার হয়েছি তার হিসাব নেই। গতকাল অফিসে আসার পথে খেয়াল করলাম, আমাদের গাড়ির চালক রাস্তার বামপাশ ঘেঁষে চালাচ্ছেন। অথচ ডানপাশে বিআরটি প্রকল্পের নীচের জায়গাটা অনেকটাই ফাঁকা। কিন্তু বাস থেকে শুরু করে প্রাইভেট কার সবাই এড়িয়ে চলছে প্রকল্পের নীচের জায়গাটা। যেন এখনই ভেঙ্গে পড়বে উপরের গার্ডার। বিরক্ত হয়ে একপর্যায়ে চালককে বললাম, ‘ওই পাশ তো তুলনামূলক খালি। ওপাশ দিয়েই যান।’ জবাব পেলাম, ‘ডর লাগে স্যার। কখন উপর থেকে ভেঙে পড়ে।’ আমিসহ গাড়িতে থাকা আরেক সহকর্মী বোঝালাম, আরে উপর থেকে তো গার্ডার ভেঙে পড়েনি। ভারী গার্ডার উঠাতে গিয়ে ক্রেন উল্টে দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ড্রাইভারের এক কথা, ‘ডর লাগে স্যার। কখন কী ঘটে যায়!’
সাদা চোখে এই ‘ডর’ বা ভয় অমূলক হলেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নগরবাসী এখন বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের আতঙ্কে ভুগছে। আজও দেখলাম, রাস্তায় জ্যাম। গাড়ি এগুতে পারছে না। কিন্তু অনেক গাড়িই উত্তরা এলাকায় চলমান ওই বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের নীচে যাচ্ছে না। রাস্তার বামপাশ দিয়ে চলতে গিয়ে জ্যাম সৃষ্টি করছে। গার্ডার পড়ে প্রাইভেটকারের ৫ আরোহী নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর রাজধানীবাসী এখন যেন এই মেগা প্রকল্পের আতঙ্কে ভুগছে। বিআরটি ও মেট্রোরেল প্রজেক্টের আশপাশ দিয়ে চলাচলের সময় মানুষের চোখে-মুখে ফুটে উঠছে গার্ডার দুর্ঘটনার শঙ্কা।
রাজধানীর উত্তরার ঘটনাটিকে কোনো অর্থেই দুর্ঘটনা বলার সুযোগ নেই। বিশৃঙ্খলা, অবহেলা ও গাফিলতির চূড়ান্ত প্রদর্শন হিসেবে ঝরে গেছে দুই শিশুসহ পাঁচটি প্রাণ। বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সোমবারের এই ‘দুর্ঘটনা’ বিআরটি প্রকল্প ঘিরে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা নয়। দেশের ব্যস্ততম সড়কে প্রায় এক দশক ধরে চলা এই মেগা প্রকল্পে নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়টি বলতে গেলে কখনোই গুরুত্ব পায়নি। নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়াই সড়ক খুঁড়ে পাইলিং, পিয়ার ও ভায়াডাক্ট নির্মাণ করা হয়েছে।
সোমবারের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজেও দেখা গেছে, যে স্থানে ক্রেন কাত হয়ে গার্ডারটি প্রাইভেটকারের ওপর পড়েছিল, সেখানেও নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল না। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করার সময়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ না করেই গার্ডারটি ক্রেন দিয়ে তোলা হচ্ছিল। নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকার পরও গার্ডার তোলার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ চলাকালে যদি যান চলাচল বন্ধ রাখা হতো, তাহলে হয়তো এই মর্মান্তিক প্রাণহানি দেখতে হতো না আমাদের। সাধারণত কোনো উন্নয়নকাজে এ ধরনের গার্ডার বসানোর কাজ যখন চলে, তখন ওই সড়কটি বন্ধ রাখা হয় এবং সাময়িক চলাচলের আরেকটি বিকল্প পথ তৈরি করা হয়। কিন্তু সেখানে এমনটি করা হয়নি। মেগা প্রকল্পটি ঘিরে এমন মেগা অবহেলার আরও প্রমাণ বের হয়ে আসছে। এ ঘটনায় দেশজুড়ে চলছে সমালোচনার ঝড়। সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রকল্পের কাজ।
বিআরটি প্রকল্পে এই দুর্ঘটনাই কিন্তু প্রথম নয়। আগেও ঘটেছে। গত মাসেই গাজীপুরে একই প্রকল্পের ‘লঞ্চিং গার্ডার’ চাপায় এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন দুজন। এর আগে ২০২১ সালের মার্চে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে এই প্রকল্পের গার্ডার পড়ে চীনা নাগরিকসহ চারজন আহত হন। শুধু তাই নয়, ওই বছরেই উত্তরার আবদুল্লাহপুরে এই প্রকল্পের কাজ চলাকালীন গার্ডারের একটি অংশ ধসে পড়েছিলো। তবে গভীর রাতে ওই ঘটনা ঘটায় সেখানে কেউ হতাহত হয়নি। সোমবারের বড় এই দুর্ঘটনাটির পর আগের ঘটনাগুলোও আবার উঠে আসছে সংবাদমাধ্যমে।
দেশের প্রচলিত আইন ও নিয়ম অনুযায়ী, সড়কে নির্মাণকাজ চলার সময় যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার দায়িত্ব প্রকল্প কর্তৃপক্ষের। এছাড়া যানবাহন ও মানুষের নিরাপত্তা বিধান করাও প্রকল্পের কাজের অংশ। এজন্য আলাদা বরাদ্দ থাকে। এ ধরনের প্রকল্পের কাজের ক্ষেত্রে সাধারণত বলা থাকে, ‘সেফটি ফার্স্ট’ বা ‘নিরাপত্তাই প্রথম’। কিন্তু এটা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট, এই প্রকল্পে সেটি যথাযথভাবে মানা হয়নি। যে ক্রেন দিয়ে গার্ডারটি তোলা হচ্ছিল সেটির যথাযথ সক্ষমতা ছিল না। সক্ষমতা থাকলে এই দুর্ঘটনাটি ঘটতো না। এখন তদন্ত কমিটি এটা বের করবে, ক্রেনের সক্ষমতা নাকি কোনও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এই দুর্ঘটনা!
উত্তরার দুর্ঘটনার পর এর পেছনের চার কারণের কথা জানিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী। প্রথম কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলা। শোক দিবসের কোনো ‘ওয়ার্ক প্ল্যান’ ছাড়াই কাজ চালানো হয়। দ্বিতীয় কারণ, এই ধরণের কাজে নিরাপত্তার জন্য ট্রাফিক পুলিশকে জানানোর কথা। যা জানানো হয়নি। তৃতীয় কারণ, দুর্ঘটনাস্থলে সড়কের ত্রুটি। ওই সড়কের একাংশ উঁচু এবং অপর অংশ নিচু ছিল। ক্রেনটি চালানোর সময় একটি চেইন উঁচু অংশে এবং আরেকটি নিচু অংশে ছিল। যার ফলে ক্রেনটি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। আর চতুর্থ কারণ, বিকালের দিকে হঠাৎ যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং সেগুলো ক্রেনের খুব কাছাকাছি চলে আসে। ফলে অপারেটর বিচলিত হয়ে হঠাৎ ব্রেক করলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটে। এতো বড় এই দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে সেটিও জানিয়েছেন সড়ক সচিব। তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট আসার পর দুর্ঘটনার কারণে চুক্তি অনুযায়ী জরিমানা, কাজ বাতিল করে দেওয়া, ব্ল্যাকলিস্টে অন্তর্ভূক্ত করাসহ কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলেছেন তিনি।
ইতোমধ্যে উত্তরার এই ট্রাজেডির পর ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগে মামলা হয়েছে চীনা ঠিকাদার কোম্পানি, ক্রেনচালক এবং প্রকল্পের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে। হাইকোর্টেও কয়েকটি রিট দায়ের করা হয়েছে। রিটে ঘটনার তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং এ ধরনের নির্মাণকাজের সময় জনগণের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
তবে এই মেগা গাফিলতির ফলে প্রাণহানির পর যথারীতি দেখা গেছে দায় এড়ানোর প্রবণতাও। সড়ক সচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, এর দায় তিনি নেবেন না। তিনি এর বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিআরটির প্রকল্প পরিচালককে প্রশ্ন করার পরামর্শ দিয়েছেন। ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন, চীনা ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে। এই প্রকল্পে কাজ করা দুটি চাইনিজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক রাখছে না বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। প্রায় একইভাবে চীনা প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় দিয়েছেন, এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আক্তারও। গতকাল গণমাধ্যমের কাছে তিনি বলেছেন, ক্রেন থেকে গার্ডার পড়ে প্রাইভেটকারের পাঁচ যাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনের (সিজিজিসি) দায় আছে। তারা নিরাপত্তার বিষয়টি বারবার লঙ্ঘন করেছে। এ বিষয়ে ঢাকার চীনা দূতাবাসকে জানানো হবে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। এদিকে আবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক না করা পর্যন্ত সব কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। আগে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক করে এরপর আবার কাজ চালু করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
দেশব্যাপী আলোচিত এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং। প্রাণঘাতী এই দুর্ঘটনার পর বিআরটির প্রকল্প পরিচালক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তদন্তের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সরকার প্রধান যাদের তদন্তের আওতায় আনার কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে বিআরটির প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলামও রয়েছেন। তবে এই দায় নিতে নারাজ বিআরটি এমডি। গতকাল গণমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটিই ঠিক করবে দায় কার। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এই প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ থাকবে। জনসাধারণের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার পর আবার কাজ শুরু হবে।
কিন্তু সত্যি কথাটি হচ্ছে, শুধু দায় দিয়েই তো আর দায়িত্ব সেরে ফেলা যায় না। আমাদের দেশের প্রকল্প, রাস্তায় চলতে গিয়ে নিহতরা আমাদের দেশেরই মানুষ। এই প্রকল্পের দেখভালের দায়িত্বও স্বাভাবিকভাবে আমাদের। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও আমাদের। এখানে চীনা প্রতিষ্ঠান ‘কোনোভাবেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক রাখছে না’ বলে আমাদের অংশের দায়িত্বটুকু কোনোভাবেই এড়ানোর সুযোগ নেই।
চীনা প্রতিষ্ঠান যদি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক না রাখে, তাহলে আমাদের জনগণের নিরাপত্তা দেখার দায়িত্ব যাদের ছিল তারা কী করেছে? দুর্ঘটনায় নির্মাতা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান বিআরটি কর্তৃপক্ষ ও তদারকি প্রতিষ্ঠান সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়- দায় আছে তিন পক্ষেরই। যে সাবধানতাগুলো মেনে কাজ করার কথা ছিল, সেগুলো না হওয়ার কারণেই এটি ঘটেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণেই পাঁচজন মানুষ অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। এটা কোনোভাবেই দুর্ঘটনা নয়, বরং কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্ত। এ ধরনের প্রকল্পে কিন্তু প্রকল্প ম্যানেজমেন্টের জন্য একটা বড় ব্যয় ধরা থাকে। কিন্তু বিআরটি প্রজেক্টে প্রথম থেকেই ‘কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিসের’ যে গ্রামারটা আছে, সেটা ঠিকভাবে কেউ মেনে চলেনি। আমাদের দেশে মেগা প্রকল্পের ইতিহাসে অতীতে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং নিহতের ঘটনাও আছে। ওইখান থেকেও আমাদের একটা শিক্ষা নেয়ার দরকার ছিল।
আসলে এই দুর্ঘটনার দায় কেউ এড়াতে পারেন না। কেউই না। সিটি করপোরেশন, সড়ক মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদে দায়িত্বশীল থেকে শুরু করে প্রকল্পের দায়িত্বশীলরা, প্রকল্প তদারকি যাদের করার কথা ছিল তারা এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কেউই এড়াতে পারেন না। মেগা প্রকল্পে এই মেগা গাফিলতির মামলায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত তৈরি করা হোক। বড় ধরনের জরিমানা করা হোক। এর ফলে কেউই যেন ভবিষ্যতে নাগরিক নিরাপত্তার প্রশ্নে গাফিলতি করার দুঃসাহস না দেখায়।
লেখক: গবেষক, উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি