Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাজনীতির উল্টোপথ সোজা হোক

সাজ্জাদ কাদির
৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৫:২৬

অতীতে দেশের জন্য কিংবা মানুষের ন্যায্য দাবি আদায়ের সংগ্রামে রাজনৈতিক নেতারা জেলে গিয়ে জামিনে মুক্ত হলে ভক্ত, নেতা, কর্মী, সমর্থক দল বেঁধে এসে নেতাকে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি করা রাজনৈতিক নেতাও ফুলের মালা গলায় দিয়ে বিশাল শোডাউন করে জেল থেকে বেরুচ্ছে। এমনই একটি ঘটনা দেখা গেল ক’দিন আগে। অবৈধ ক্যাসিনো চালানো, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা মামলায় প্রায় তিন বছর পেরিয়ে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে হাজার হাজার মানুষ নিয়ে বিশাল শোডউন করে রাস্তাঘাট অচল করে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে দেখা গেছে। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন- নানা অভিযোগে অভিযুক্ত একজন বিচারাধীন আসামীর পেছনেও এত লোক কেন? তাহলে কী স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়েও রাজনীতি সোজা পথে হাঁটা শিখেনি? এমনতো হবার কথা ছিল না।

বিজ্ঞাপন

এই সম্রাটতো দেশের স্বার্থে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা থেকেও মুক্তি পাননি। বরং তার বন্দীত্ব নিকৃষ্ট কাজের জন্য, দেশের স্বার্থবিরোধী কাজের জন্য, তার বন্দীত্ব চরম ঘৃণা এবং লজ্জার। চুরি ডাকাতি করে ধরা পড়ার বন্দীত্ব। এই বন্দীত্ব থেকে জামিনের পর অনেকগুলো মামলা চলমান থাকা একজন আসামীর আবার কিসের শোডাউন? সম্রাটের ক্ষেত্রে হবার কথা ছিল মাথা নিচু করে নিরবে মামলা ফেস করা। তা নয় লজ্জা, শরমের মাথা খেয়ে হাজার হাজার মানুষ নিয়ে শোডাউন! ভবিষ্যতে আরও কী দেখার অপেক্ষা আছে কে জানে? এই যদি হয় এখনকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিংবা রাজনীতি যদি এভাবেই এগোয় তাহলে আগামী প্রজন্মের মধ্যে সম্রাট হবার প্রবনতাই বাড়বে। ইতোমধ্যে সেদিকেই যাচ্ছে প্রজন্ম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারো কারো পোস্টেও দেখা গেছে সম্রাটের পক্ষে সাফাই গাইতে। তাদের যুক্তি হচ্ছে- সামনে নির্বাচন তাই বিরোধী শক্তি দমন করতে হলে মাঠে সম্রাটের মত মানুষ প্রয়োজন আছে! সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের কোন সুবিবেচনাপ্রসূত মানুষ এমন সম্রাটীয় রাজনীতি দেখতে চায় বলে মনে হয় না। অবশ্য সেটাই বলি কেমন করে? তাহলে তো রাজনীতি আর এভাবে উল্টোপথে হাঁটত না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- রাজনীতিতে এখনও সম্রাটরা বিরাজ করে কেন? কেনইবা সম্রাটদের রাজনীতির মাঠে বড় বড় শোডাউন হয়? রাজনীতিকে সোজাপথে হাঁটতে দিতে হলে এর কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞানভিত্তিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে যত উন্নয়নই করা হোক না কেন সেই উন্নয়ন ধরে রাখা যাবে না কোনভাবেই।

বিজ্ঞাপন

যে মহান নেতাকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ রাজনীতি আবর্তিত হয় সেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনোই এমন সম্রাটদের নিয়ে রাজনীতি করেননি। পরপার থেকে তিনি দেখতে পান কি না জানি না। যদি দেখতে পান তবে এসব দেখে তার আত্মা কষ্টই পায় বৈকি। আর সেদিন সম্রাটের মত অভিযুক্তর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনে তার আত্মা কষ্টই পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের রাজনৈতিক সচিব, আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদের ২০১৭ সালের ৭ মার্চ জাতীয় সংসদে দেওয়া বক্তব্যে জানা যায়, ৫৪ বছর বয়সের জীবনে বঙ্গবন্ধু চার হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন। এমনও হয়েছে জামিনে বেরিয়ে জেলগেট থেকেই আবারও গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু তার জামিনের পর রাস্তা-ঘাট অচল করে দেওয়া বড় কোন শোডাউনের খবরও পাওয়া যায় না কোন নথিপত্রে। অথচ আজকাল চুরি, ডাকাতি, ঘুষ, দুর্নীতির দায়ে জেলে যাওয়া রাজনৈতিক নেতা, পাতি নেতাও রাস্তাঘাট অচল করে দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে শোডাউন করে।

পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু দু’বার মন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর গঠিত শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় কৃষিমন্ত্রী হন প্রথমবার। আবার ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও গ্রাম সহায়তা বিষয়ক দপ্তরের মন্ত্রী হন দ্বিতীয়বার। কিন্তু দল গঠনের কাজে সার্বক্ষণিকভাবে আত্মনিয়োগ করার জন্য ১৯৫৭ সালে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এখনকার দিনে বাধ্য না করা হলে দলের জন্য মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। দু’বার মন্ত্রী হয়েও ঢাকা শহরে বঙ্গবন্ধুর কোনো বাড়িঘর ছিল না। এমনকি সরকারবিরোধী রাজনীতি করার কারণে অনেক বাড়িওয়ালা তার পরিবারকে বাড়ি ভাড়াও দিতে চাইতেন না। এমন পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধু ঢাকায় কোনো জমি বরাদ্দ নিতে চাননি। মূলত বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের উদ্যোগেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের প্লটটির ব্যবস্থা হয়; সেটিও ছিল ১০ কাঠার, যেখানে বেশিরভাগের প্লট ছিল ২০ কাঠার। বেগম মুজিব সেই প্লটে কয়েক ধাপে একটি বাড়ি করেন হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে। এই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবন ও ত্যাগ।

আজ যারা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলে দাবি করেন তাদের ক’জন বঙ্গবন্ধুর এই সহজ-সরল জীবন-যাপন ধারণ করেন? আজকের অবস্থাটা এমন যে প্রায় সব মন্ত্রী-এমপি সাহেবদেরই ঢাকায় বাড়ি না থাকলেও নিদেনপক্ষে ফ্ল্যাট আছে। আবার অনেকের বিদেশেও বাড়িঘর আছে। এমনকি স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি যারা সারা দেশের জেলা পরিষদ, উপজেলা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র এমনকি ইউপি চেয়ারম্যানদেরও অনেকের ঢাকায় ফ্ল্যাট আছে। জেলা-উপজেলা নেতাদের ঢাকায় ফ্ল্যাট আছে। প্রত্যেকেই গাড়ি-বাড়িসমেত বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। এ যেন বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন এবং রাজনীতির পুরো উল্টোপথ। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও যে সমস্ত নেতা বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে আজীবন জড়িয়ে থাকবেন তাদের মধ্যে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অন্যতম। তার জীবনযাপনও ছিল খুবই অনাড়ম্বর। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটিয়েছিলেন ঢাকা থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইলের সন্তোষে এক অতি সাদামাটা কুঁড়েঘরে। আমাদের জাতীয় চার নেতার কথা যদি বলি তাদেরও রাজনীতির বিনিময়ে বিশাল কোন সম্পদ অর্জনের কথা শোনা যায় না। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়- বঙ্গবন্ধুর সরল জীবনযাপনের রাজনীতি কিংবা ভাসানীর কুঁড়েঘরের রাজনীতি এখন বিলাসবহুল অট্টালিকার রাজনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।

দেশকে সোজা পথে চালাতে হলে রাজনীতির উল্টো পথ পরিহার করতে হবে। নইলে আমাদের প্রিয় দেশটা ভালো চলবে না। তাই রাজনীতির উল্টোপথ সোজা হোক সেটিই কাম্য।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

মত-দ্বিমত রাজনীতির উল্টোপথ সোজা হোক সাজ্জাদ কাদির

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর