কুখ্যাত শরীফ শিক্ষা কমিশন ’৫৯ ও মহান শিক্ষা দিবস
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮:৩৮
জাতীয় শিক্ষা কমিশন, ১৯৫৯, বা, ১৯৫৯-এর শিক্ষা কমিশন হলো তৎকালীন পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি সম্পর্কিত একটি নীতিমালা তৈরির জন্য গঠিত সরকারি কমিশন, যা এর সভাপতি প্রফেসর এস এম শরীফ-এর নামানুসারে শরীফ কমিশন এবং শরীফ শিক্ষা কমিশন নামেও পরিচিত। এই কমিশনটি ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর গঠিত হয় এবং ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট প্রতিবেদন উপস্থাপন করে।
শরীফ কমিশন এর সদস্যবৃন্দ:
১০ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও তৎকালীন পাকিস্তানের শিক্ষাসচিব ড. এস এম শরীফ। ৪ জন বাঙালি শিক্ষাবিদ সদস্য হিসাবে যুক্ত ছিলেন; তারা হলেনঃড. মোমতাজউদ্দিন আহমেদ (উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়), আবদুল হক (সদস্য, ঢাকা মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড), অধ্যাপক আতোয়ার হোসেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এবং ড. এম এ রশীদ (অধ্যক্ষ, ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ)।
শরীফ কমিশন এর সুপারিশ সমূহ:
২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত শরীফ কমিশনের ওই প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ, পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, হরফ সমস্যা, প্রশাসন, অর্থবরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ এবং তা ১৯৬২ সাল থেকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে।
(ক) শিক্ষাখাতে ব্যয়কে শিল্পে মূলধন বিনিয়োগের দৃষ্টিতে দেখার সুপারিশ করে কমিশন শিক্ষা সস্তায় পাওয়া সম্ভব নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করে অবৈতনিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে সরকারী অর্থের পরিবর্তে জনগণের অর্থ বিনিয়োগের জোর দেয়া হয়।
(খ) শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ভাষার প্রশ্ন জটিলতা সৃষ্টি করে পূর্বাঞ্চলে বাংলার সাথে উর্দুকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসাবে গণ্য করে উর্দু ভাষায় ব্যাপক বিস্তৃতি ও উন্নয়নের জন্য উর্দু উন্নয়ন বোর্ড গঠনসহ রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ও উর্দুর সংমিশ্রণে এক নতুন বর্ণমালা উদ্ভাবনের সুপারিশ করে। এমনকি বাংলা বর্ণমালা সংস্কারসহ উর্দু ও বাংলার জন্য একটি রোমান বর্ণমালা সৃষ্টির কথাও বলে।
(গ) ৬ষ্ঠ শ্রেণী হতে ডিগ্রী পর্যন্ত ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক ভাষা করা।
(ঘ) এস.এস.সি পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণদের জন্য পরবর্তী শিক্ষার দ্বার রুদ্ধকরণ।
(ঙ)দু বছরের ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছরে বৃদ্ধি করার এক অবৈজ্ঞানিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে।
(চ) বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগে পাঠ্যসূচির অবৈজ্ঞানিক সুলভ ও স্কুলসমূহের কারিকুলাম অযৌক্তিকভাবে রদবদলের এক ভৌতিক সুপারিশ করে।
(ছ) বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব ।
(জ)শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিল।
এই বিমাতাসুলভ শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আমাদের ছাত্র সমাজ দ্রুতগতিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে। ছাত্র সমাজ এই শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান করে তা বাতিলের দাবী জানায়। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদদের দ্বারা একটি বেসরকারি বিকল্প রিপোর্ট প্রণয়ন করে সরকারের কাছে উত্থাপন করলে তা সরকার গ্রহণ করেনি।
ইতোপূর্বে ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহ ও খোকা রায়ের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে আইয়ুব খাঁর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৬২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসেই আন্দোলনের সূচনার পরিকল্পনা করেন তারা।
১৯৬২ সালের ৮ জানুয়ারি ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীরা শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল করে অনতিবিলম্বে তা বাতিলের দাবী জানায়। পুলিশ বাধা দেয় ও লাটিচার্জ করে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে।
১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে করাচিতে গ্রেফতার করা হয়। সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের পরিপ্রেক্ষিতে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি ও চার বছরের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ আন্দোলনের সূচনা করে।
১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের ডাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধর্মঘট ও সামরিক আইন অমান্য করে রাজপথে মিছিল বের করলে পুলিশ লাটিচার্জ-টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে বহু ছাত্রকে গ্রেফতার করে।
৭ ফেব্রুয়ারি কার্জন হলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনজুর কাদের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে এলে ছাত্র সমাজ কর্তৃক বাধাগ্রস্ত ও চরমভাবে লাঞ্ছিতসহ তার গায়ে থু থু ছিটিয়ে দেয় ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পর ছাত্ররা হল ত্যাগ করছে না দেখে পুলিশ ও সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও করে ছাত্রদের জোর করে বের করে দেয়। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে পুলিশবেষ্টনির মাঝে আটকা পরেছিল আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। এদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা আগেই জারি হয়েছিল। যা বহুদিন পর্যন্ত বহাল ছিল।
৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২৯ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে।
সকল বন্দী রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের মুক্তিদান, বাংলা হরফের রদবদলের বন্ধের দাবী জানিয়ে ছাত্র সমাজ সরকারকে ৭ দিনের চরমপত্র দেয়ায় ৩১ মে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃ বন্ধ ঘোষণা করে।
দেশব্যাপী এই শিক্ষা আন্দোলনকে গতিময় করে তুলতে ৬২-র ২ আগস্ট তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি, ডাকসুর সহ-সভাপতি শ্যামা প্রসাদ ঘোষ ও জি.এস. এনায়েতুর রহমান সহ বাম সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে জেলাসমূহে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি গ্রেফতার হন।
১৯৬২’র দ্বিতীয়ার্ধে সরকার ঘোষিত শিক্ষানীতির প্রতিবাদে আন্দোলন আবার বেগবান হয়ে ওঠে।প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর ১০ আগস্ট ঢাকা কলেজের ক্যান্টিনে বিভিন্ন কলেজ প্রতিনিধিদের নিয়ে একসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভা থেকে ১৫ আগস্ট দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট ও ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ছাত্র সমাজের দাবী পূরণে স্বৈরাচার সরকারের অনীহার প্রতিবাদে ১৫ আগস্ট সমগ্র দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয় এবং ২৮ তারিখ পর্যন্ত ধর্মঘট ও মিছিল অব্যাহত থাকে।
বরাবরের মতোই সেই দুঃস্বপ্নের সময়ে বাংলার দিশেহারা লাখো শিক্ষার্থীর স্বপ্নের সারথি হয়ে রাজপথে নামে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া এই ছাত্র সংগঠনটি ইতোপূর্বে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে সফলতা অর্জন করে গণমানুষের আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়। ফলে, কুখ্যাত শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছাত্রলীগ হয়ে উঠে ছাত্র-জনতার দুর্দিনের কান্ডারী।
সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। পূর্ব বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে প্রতিবাদ কর্মসূচী চলতে থাকে। আন্দোলনের দাবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল শিক্ষানীতিতে প্রস্তাবিত তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স এবং উচ্চ মাধ্যমিক ইংরেজির অতিরিক্ত বোঝা বাতিল করার বিষয়টি।
একের পর এক ধর্মঘট সমাবেশের কর্মসূচি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেমন অচলাবস্থার সৃষ্টি করে, তেমনি ক্রমেই এই আন্দোলনের শ্রমজীবী ও পেশাজীবী বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ, আন্দোলনটিকে ‘গণ-আন্দোলনে’ রূপান্তরিত করে।
কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবী সম্বিলিত এক চরমপত্র পেশ করে। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবীসমূহ হল :
১) শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিল, (২) ৩ বছরের পাস ডিগ্রি কোর্সকে ২ বছর করা, ৩) দ্বাদশ শ্রেণি প্রবর্তন বন্ধকরণ, ৪) বর্ধিত ছাত্র বেতন ও পাঠ্য পুস্তকের মূল্য হ্রাস, ৫) কলা ও বিজ্ঞান বিভাগ হতে যথাক্রমে বিজ্ঞান ও কলা বিষয় বাদ দেয়া, ৬) দ্বাদশ শ্রেণির ৭টি ইংরেজি বইয়ের স্থলে ২টি করা, ৭) উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগকে ডিগ্রী কলেজের সাথে পুনঃ একত্রীভূতকরণ, ৮) জনগণের গড়পড়তা আয় অনুপাতে শিক্ষার ব্যয় হ্রাস করা, ৯) বন্দী ছাত্রদের মুক্তিসহ হুলিয়া ও বহিস্কারাদেশসহ রুজুকৃত মিথ্যা মামলাসমূহ অবিলম্বে প্রত্যাহার করা, ১০) কলেজ শিক্ষকদের মর্যাদা সি.এস.পি অফিসার পদের সমমর্যাদাকরণ ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধিকরণ এবং ১১) পূর্ব পাকিস্তানে প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করে অবিলম্বে জনসংখ্যা ভিত্তিতে ন্যায্য অধিকার দেয়া।
কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবি ১৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মেনে নেয়ার সময় বেঁধে দেয়, কিন্তু পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল কাদের চৌধুরী দাবী সমূহকে অযৌক্তিক বলে প্রত্যাখ্যান করে ১০ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে।
১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের সামনে অবস্থানের ঘোষণা দেওয়া হয়। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১০ সেপ্টেম্বরের কর্মসূচি বাতিল করে। তবে তার পরিবর্তে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে।
১০ সেপ্টেম্বর সরকার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। সরকারের প্রত্যাশা ছিল সোহরাওয়ার্দী মুক্ত হলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়বে। কিন্তু এই আশা-দুরাশায় পরিণত হয়।
১১ সেপ্টেম্বর সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবীর প্রতি সমর্থন করে তা মেনে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে অন্যথা এর পরিণতি কঠোর হবে বলে হুঁশিয়ারী জ্ঞাপন করেন।
১৭ সেপ্টেম্বর সারাদেশে অভূতপূর্ব হরতাল ও ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। রাজপথে নেমে আসে রাজধানী ঢাকার লক্ষ লক্ষ মানুষ। সকাল ১০ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হয়। সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়ে যায়। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে এ গুজব শুনে মিছিল দ্রুত নবাবপুরের দিকে ধাবিত হয়। হাইকোর্টে পুলিশের সাথে সংঘাতে না গিয়ে মিছিল আব্দুল গনি রোড ধরে যেতে থাকে। পুলিশ তখন পিছন থেকে মিছিলে হামলা চালায়। লাঠি চার্জ, কাঁদুনে গ্যাস ও গুলি চালায়। পুলিশের সাথে দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষ বাঁধে ঢাকা কোর্টের সামনে। এখানেও পুলিশ ও ইপিআর গুলি চালায়। এতে তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হন বাবুল এবং বাস কন্ডাক্টর মোস্তফা। গৃহভৃত্য ওয়াজিউল্লাহ গুরুতর আহত হয় এবং তিনি ১৮ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৭ সেপ্টেম্বর কার্যত ছাত্রসমাজের অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ঐ দিনের বিক্ষোভ মিছিলে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণই প্রধান হয়ে ওঠে।ওই দিন শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে মিছিলের উপর পুলিশ হামলা চালায়। টঙ্গিতে ছাত্র-শ্রমিক মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে হত্যা করে সুন্দর আলী নামে এক শ্রমিককে।
১৭ সেপ্টেম্বরের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড দমন-পীড়ন ও প্রতিকূলতার মধ্যেও ছাত্রসমাজ আন্দোলন অব্যাহত রাখে। একপর্যায়ে সরকার নমনীয় হতে বাধ্য হয়। ছাত্রসমাজ ও আন্দোলনকারী জনগণের পক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর গোলাম ফারুকের সাথে আলোচনায় বসেন।
২৪ সেপ্টেম্বর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম পল্টন ময়দানে জনসভা আহ্বান করে। ঐ জনসভা থেকে সরকারের প্রতি ‘চরমপত্র’ দেওয়া হয়।
ইতোমধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে গভর্নর গোলাম ফারুকের কয়েক দফা বৈঠক হয়। ছাত্রসমাজের এই ‘চরমপত্র’ দেওয়ার তিন দিন পর, সরকার শরীফ কমিশন রিপোর্ট স্থগিত ঘোষণা করে। ডিগ্রি কোর্সের ছাত্রদের, যাদের দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছিল এবং তৃতীয় বর্ষে উঠেছিল তাদের বিনা পরীক্ষায় সবাইকে পাস ঘোষণা করা হয়। গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তি দেওয়া হয়।
অবশেষে বিজয়ের ভেতর দিয়ে বাষট্টির গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে।
১৯৬৩ সাল থেকে ছাত্রসমাজ ১৭ সেপ্টেম্বর দিনটিকে প্রতিবছর ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। সেই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
১৭ সেপ্টেম্বর জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে সেই ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শেখ ফজলুল হক মণি সহ অন্যদেরকে এবং ১৭ সেপ্টেম্বর এর আন্দোলনের শহীদ বাবুল, মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহ কে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে।
লেখক: তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
কুখ্যাত শরীফ শিক্ষা কমিশন ’৫৯ ও মহান শিক্ষা দিবস মত-দ্বিমত মো. শামছুল আলম অনিক