Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা: প্রজন্মের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব

অরুণ কুমার গোস্বামী
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৬:৫৫

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশের যুব সমাজ ও বর্তমান প্রজন্মের সামনে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। বর্তমানের স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের বাস্তব উন্নত সমৃদ্ধ ও মনুষ্য বসবাস উপযোগী বাংলাদেশের জন্য যার নেতৃত্ব অপরিহার্য এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশপ্রেম, সততা, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষই বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন। বিষয়টি যথাযথভাবে বিবেচনার জন্য যে প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক তা হলো, যৌবনে পদার্পণ করার সাথে সাথে কিশোর-কিশোরীরা আদর্শ হিসাবে কাকে বা কাদের অনুসরণ করবেন? এবং কেন করবেন? বিখ্যাত মার্কিন মনোবিজ্ঞানী মারিলিন প্রাইস-মিচেল-এর মতে, কিশোরেরা বিভিন্ন বয়স্ক ও তার সমবয়সীদরে দ্বারা প্রভাবিত হয়। আদর্শ ব্যক্তিত্বগণ যুবকদের ক্যারিয়ারের আকাক্সক্ষা, শিক্ষামূলক লক্ষ্য এবং ভোক্তাদের আচরণের বিকাশে সহায়ক হতে পারে। বিপরীতক্রমে তারা আবার যুবকদের অস্বাস্থ্যকর আচরণের দিকেও অনুপ্রাণিত করতে পারে, যেমন গুন্ডামি, স্কুলে প্রতারণা, বা পদার্থের অপব্যবহার ইত্যাদি। যেমন দেশের প্রথম সামরিক শাসক মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে হিজবুল বহর নামের সমুদ্রগামী জাহাজে প্রমোদ ভ্রমণের মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীকালে নেতৃস্থানীয় ক্যাডার বাহিনীতে পরিণত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মোনায়েম খানের অনুসারী ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফ্রন্ট (এনএসএফ)-এর মত করে এভাবে জিয়া তার নিজের ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। যাহোক, এপ্রসঙ্গে গবেষকরা যে প্রশ্নটি নিয়ে ব্যাপৃত হচ্ছেন তাহলো, ‘কেন কিছু কিশোর-কিশোরী বা যুবক-যুবতী ইতিবাচক রোল মডেলের প্রতি আকৃষ্ট হয়, আবার অন্যরা নেতিবাচকদের দিকে আকৃষ্ট হয়?’

বিজ্ঞাপন

জীবনে নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে মানসিকতা নিয়ে একজন যুবক গড়ে উঠছের তার সেই লক্ষ্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে এপ্রশ্নের উত্তর। উদাহরণস্বরূপ, ইতিবাচক রোল মডেল দ্বারা তরুণদের অনুপ্রাণিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে যখন তাদের মধ্যে উন্নতি করার মানসিকতা থাকে- যখন তারা নিজেদেরকে সক্রিয় শিক্ষার্থী এবং অর্জনকারী হিসেবে দেখে এবং কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। এই ধরনের মানসিকতাসম্পন্ন যুবকেরা তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার দ্বারা কোন কিছু অর্জন করার চেষ্টা করে থাকে। তারা চায় বড়রা তাদের এই পথই প্রদর্শণ করুক। বৃদ্ধির মানসিকতার বিপরীতে অবস্থান প্রতিরোধ মানসিকতা। যুবকরা যখন জীবনে দুর্যোগ এবং নেতিবাচক ফলাফল প্রতিরোধ বা এড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করে, তখন তারা এমন রোল মডেলের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে যারা তাদের (যুবকদের) এড়ানোর কৌশল শিখতে সাহায্য করবে। এই কৌশলগুলির মধ্যে থাকতে পারে পরীক্ষায় প্রতারণা করা বা জীবনের চ্যালেঞ্জগুলি এড়াতে ড্রাগ এবং অ্যালকোহল ব্যবহার করা। যখন তাদের প্রতিরোধের মানসিকতা থাকে, তখন তারা রোল মডেল বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে যারা তাদের প্রতিরোধমূলক কৌশল শিখতে সাহায্য করে। অপরদিকে, যখন তরুণদের একটি বৃদ্ধির মানসিকতা থাকে, তখন তারা রোল মডেল বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে যা তাদের চিন্তাভাবনাকে সমর্থন করে এমন ধরনের কৌশল প্রদান করে। সফলতা অর্জনের জন্য যেসব বৈশিষ্ট্যাবলী ইতিবাচক রোল মডেলের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় সেগুলো হলো, ১) অন্যদের অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা, ২) স্পষ্ট মূল্যবোধ, ৩)দেশবাসী তথা মানব জাতির প্রতি প্রতিশ্রুতি, ৪)অন্যদের গ্রহণযোগ্যতা, এবং ৫)বাধাগুলি অতিক্রম করার ক্ষমতা রয়েছে। তারা তরুণদের জন্য সফল লক্ষ্য অর্জনের একটি উপায় এবং স্ব-মূল্যবোধের চিত্র তুলে ধরে।যে যুবকদের বৃদ্ধির মানসিকতা রয়েছে তারা এই ধরনের ইতিবাচক রোল মডেরের দিকে অভিকর্ষিত হতে পারে। নেতিবাচক রোল মডেলগুলিও তরুণদের অনুপ্রেরণা বাড়ায়, তবে ইতিবাচকদের চেয়ে ভিন্ন উপায়ে। ব্যর্থতা এড়ানোর কৌশলগুলির দিকে তারা যুবকদের পরিচালিত করে। ব্যর্থতার গভীর ব্যক্তিগত ভীতি তাদের মধ্যে প্রায়ই থাকে এবং যেকোন মূল্যে দুর্ভাগ্য এড়াতে তারা বিভিন্ন মোকাবিলার পদ্ধতি এবং কৌশল খুঁজে পেয়ে থাকে। অল্পবয়সী যারা প্রতিরোধের মানসিকতা গড়ে তুলেছে তারা সম্ভবত এই ধরনের রোল মডেলগুলিকে খুব সহায়ক বলে মনে করে কারণ তারা একই রকম ভীতি শেয়ার করে।

বিজ্ঞাপন

‘একটি জাতির জন্য যুবসমাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি চাই যুবকরা প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চ মানের হোক। আমাদের যুবসমাজ আমাদের জন্য একটি বড় শক্তি এবং তারাই বাংলাদেশকে জাতিরপিতার স্বপ্নের একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে পারে।’ গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে ‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার এওয়ার্ড- ২০২২’ প্রদান অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধ’ কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হচ্ছে এবং সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তরের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। … আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত হওয়া এবং তরুণরাই সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে, কারণ তারাই ২০৪১ সালের মূল স্থপতি।’ তিনি বলেন, এই দেশটা এগিয়ে যাবে, শত বাধা অতিক্রম করে। পৃথিবীর অনেক দেশ এখন বয়োবৃদ্ধদের দেশে পরিণত হয়েছে। আমরা সেটা হতে চাই না। কাজেই আমাদের এই যুব সমাজই পারবে সারা বাংলাদেশটাকে উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলে জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ করতে। দেশের যুব সমাজকে এভাবে এগিয়ে নিতে হলে তাদের সামনে অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন। যার জীবনাদর্শ অনুসরণ করে তারা এগিয়ে যেতে পারবে। এধরনের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব বা রোল মডেল-এর বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী উল্লেখ করা যেতে পারে। যেসব বৈশিষ্ট্য একজন ব্যক্তিকে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বে বা ইংরেজিতে যাকে বলে ‘রোল মডেল’এ পরিণত করে সেগুলো হচ্ছে আত্মবিশ^াস ও নেতৃত্ব দেয়ার গুণাবলী; যিনি সৎ ও দেশপ্রেমিক; দেশ ও জাতির প্রতি যিনি অঙ্গীকারাবদ্ধ; বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি যার আপসহীন অঙ্গীকার; গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি যিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; যিনি সবার সাথে যোগাযোগ রাখেন ও নিরন্তর পরস্পরিক মিথস্ক্রিয় থাকেন; যিনি অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সহানুভূতিশীল ও উদ্বিগ্ন থাকেন; যিনি বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন এবং সুমার্জিত; যার মধ্যে বিনয় ও ন¤্রতা থাকে; নিজের কাজের বাইরেও যিনি দায়িত্ব পালন করে থাকেন এবং জীবন ও কর্মস্থলের চ্যালেঞ্জগুলোকে যিনি সততা ও দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করেন। প্রসঙ্গক্রমে, দেশরত্ন শেখ হাসিনার সংগ্রামী জীবন ও কর্ম সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হচ্ছে।

জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেছার পাঁচ সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম সন্তান বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী, দেশরত্ন শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। শৈশবের বেশীরভাগ সময় শেখ হাসিনা তার নিজ জন্মস্থান গ্রামেই অতিবাহিত করেন। ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু যখন প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তখন তাদের পরিবার ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। তাঁর ছাত্র জীবনে শেখ হাসিনা ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলনে এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। উল্লেখ্য, গণঅভ্যুত্থানের ফলেই জেনারেল আইয়ুব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। শেখ হাসিনা ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এছাড়া তিনি ইডেন ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র লীগের সদস্য ছিলেন এবং রোকেয়া হল ছাত্র লীগের সেক্রেটারি ছিলেন।

১৯৬৮ সালে তিনি খ্যাতনামা পরমানু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই তাদের প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় জন্ম গ্রহণ করেন। তার দ্বিতীয় সন্তান সায়মা ওয়াজেদ হোসেন ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পুরো পরিবারকে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা নিষ্ঠুরতমভাবে হত্যা করেছিল। তিনি ও তার ছোট বোন বিদেশ থাকার কারণে বেঁচে গিয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হতে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বন-এ হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসভবনেই অবস্থান করছিলেন। পরে, ১৯৭৫-এর ১৯ আগস্ট ভারতের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা এবং তাদের পরিবারবর্গ দিল্লী পৌঁছান।

ভারতে বাধ্যতামূলক প্রবাস জীবন: পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ১৯ দিন পর তাঁরা ভারত আসেন। প্রায় ছয় বছর তিনি ভারতে অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এসময় জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। বাংলাদেশে একটি শত্রুভাবাপন্ন সরকার, বাবা, মা, ভাই, ভ্রাতৃবধু, আত্মীয়স্বজন হারানো শোকে কাতর শেখ হাসিনা তখন জার্মানী থেকে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সহযোগিতায় দিল্লীর লাজপত নগর-৩ এ ৫৬ নম্বর রিং রোডের বাসভবনে এবং পরে পান্ডারা মার্কেট এর নিকট পান্ডারা রোডের বাসভবনে থাকতেন। এসময় তিনি, তার বোন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা, তার স্বামী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পপন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী ড.এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া, দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুল দিল্লীতে থাকতেন।

১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে পার্টির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এর তিন মাস পরে ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি সরাসরি দিল্লী থেকে স্বদেশ বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। স্বদেশ ফিরে আসার পর থেকেই শুরু হয়েছিল দেশরত্ন শেখ হাসিনার সংগ্রামবহুল আর এক জীবন।

প্রথমে জেনারেল জিয়া এবং পরে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরায় শুরু করার জন্য তিনি এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি ১৫-দলীয় ঐক্যজোট সংগঠিত করেন। এই ঐক্যজোটের কারনেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠা সামরিক শাসন বিরোধী তীব্র ছাত্র আন্দোলন দমানোর জন্য ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পসে প্রবেশ করে নির্বিচারে লাঠি চার্জ ও গুলি বর্ষণ করতে থাকে। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৫-দলীয় ঐক্যজোটের এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে তিনি (শেখ হাসিনা) থেকে গ্রেফতার করে চোখ বেঁধে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেনানিবাসে তাঁকে ১৫দিন বন্দী করে রাখা হয়েছিল। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং নভেম্বরে তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালের মার্চ মাসে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং একনাগাড়ে তিনমাস কারাবন্দী করে রাখা হয়েছিল।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টাসহ ১৯ বারেরও বেশী তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। মহান স্রষ্টার অসীম করুণা, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রচেষ্টা এবং জনগণের ভালোবাসার কারণে এসব আক্রমনের হাত থেকে তিনি বেঁচে গিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন শেখ হাসিনাকে এপর্যন্ত ৩৭টির বেশি সম্মাননা পুরষ্কার প্রদান করেছেন।

দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর বাংলার মানুষের মনের একান্ত চাওয়া ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার’এর পথ সুগম হয়। জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার থেকে রক্ষার জন্য খুনী খোন্দকার মোশতাক কর্তৃক জারিকৃত, জাতীয় সংসদে জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক পাসকৃত, জেনারেল এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার সরকার কর্তৃক বহালকৃত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করার জন্য ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর তৎকালীন আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু দ্য ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬ শিরোনামে একটি সংসদে উত্থাপন করেন। ওইদিনই মানবতাবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয়। এই অধ্যাদেশ বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের বিচারের পথ সুগম হয়।

১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ঘটনায় ঢাকার দায়রা জজ গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় প্রকাশ করেন। আপিল নিষ্পত্তির পর ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর এই মামলায় বিভক্ত রায় আসে বিচারপতিদের কাছ থেকে। বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ১০ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন। অপরপক্ষে, বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশই বহাল রাখেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। ছয়জন মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ব্যক্তি পলাতক আছে অবশিষ্টদের শস্তি কার্যকর করা হয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার এই আইনটি অকার্যকর করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। জিয়াউর রহমানের পরে এমনকি জেনারেল এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়াও এই বিচার যাতে না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০০৯ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (বাংলাদেশ)। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাতৃভূমির বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ২০০৮ সালে তারা একটি রিপোর্ট জমা দেয়। এই রিপোর্টে সন্দেহভাজন ১,৬০০ জন যুদ্ধাপরাধীকে চিহ্নিত করা হয়। এর পরে ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচী ২০০৯ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠনে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। অপরাধ সংঘটিত করার পর পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য সরকার ২০০৯ সালে কিংবা তার পরে সংশোধনীর মাধ্যমে আইনটির কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন করেন। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ অফিসিয়াল গেজেট-এর মাধ্যমে তিনজন বিচারকের সমন্বয়ে ‘ট্রাইব্যুনাল’ গঠিত হয়। এই তিনজন বিচারকের একজন চেয়ারম্যান। একই সাথে সরকার আইনের ৭ নং সেকশন অনুযায়ী অভিযোগ গঠনের লক্ষ্যে ‘প্রোজিকিউশন টিম’ এবং সেকশন নং ৮ অনুযায়ী ‘ইনভেস্টিগেশন এজেন্সী’ গঠন করেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচার করার লক্ষ্যে যা যা করা প্রয়োজন সরকার সেইসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

অব্যাহতভাবে সংগ্রাম করে দেশরত্ন শেখ হাসিনা প্রথমে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০০৮ এর ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকাকালে উপরোল্লিখিত বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার ছাড়াও দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে গিয়েছেন। দারিদ্র্যের হার হ্রাসকরণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, আর্র্থ-সামাজিক উন্নয়ন সূচকগুলোতে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি লাভ করার ফলে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে। এমনকি বিশ্বের জনপ্রিয় ফোর্বস ম্যাগাজিন করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল নারী নেতৃত্বের তালিকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম স্থান পেয়েছে। এতে বলা হয়েছে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের শুরুতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা এখনো এমনকি যুক্তরাজ্যও কার্যকর করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় ফোর্বস ম্যাগাাজিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের প্রশংসা করে লিখেছে, প্রায় ১৬ কোটিরও বেশী মানুষের বসবাস বাংলাদেশে। সেখানে দুর্যোগ কোনো নতুন ঘটনা নয়।। আর এই করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে দ্র্রুত সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেননি তিনি। তার এই ত্বরিত সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম বিষষয়টিকে প্রশংসিত বলে উল্লেখ করেছে।

দেশপ্রেম, সততা, মানবিকতা, আন্তরিকতা, সকলের প্রতি সৌজন্যবোধ, অসহায় ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হওয়ার শিক্ষা শেখ হাসিনা কোথা থেকে লাভ করেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর তার নিজের কথা থেকেই আমরা জানতে পারি। একাদশ জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমার বাবার নির্দেশ ছিল, একজন রিক্শা ওয়ালাকে আপনি করে কথা বলতে হবে, বাড়ীর ড্রাইভারকে ড্রাইভার সাহেব বলতে হবে। আর কাজের যারা লোকজন তাদের কখনো চাকর বাকর বলা যাবে না, হুকুম দেয়া যাবে না। তাদের কাছে সম্মান করে ভদ্রভাবে চাইতে হবে। যে জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে পারি কিন্তু এখনও, আমার বাড়ীতে যে ছোট কাজের মেয়েগুলি বা যারাই আছে কারও কাছে যদি কখনও একগ্লাস পাানিও চেতে হয়। যতদূর পারি নিজে করে খাই আর যদি চেতে হয় তাহলে কিন্তু তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি, আমাকে এইটা একটু দিতে পারবে? এই শিক্ষাটা আমরা নিযে আসছি, এটা এখনও আমরা মেনে চলি। এটা আমার বাবারই শিক্ষা। তিনি শুধু বলে গেছেন তা নয়, তিনি সে শিক্ষাটা আমাদের দিয়েও গেছেন, আমরা দিয়ে যাই। কাজেই সেই দিক দিয়ে, আমরা মনে করি যে আমাকে সকলেরই মানুষ গরীব দেখলে বা ভালো পোষাক না পড়লে তাকে আবহেলা করতে হবে। আমাদের কাছে কিন্তু সেটা না, আমাদের কাছে সবাই সমান সমাদর পায় বরং যাদের কিছু নাই তাদের দিকে আমরা একটু বেশি নজর দেই, দৃষ্টি দেই।”

‘আর জিজ্ঞাসা করছেন যে সকালে উঠে আমি কী খুঁজি? আমি জায়নামাজ খুঁজি। সকালে উঠে নামাজ পড়ি। নামাজ পড়ার পর কোরআন তেলওয়াত করি। তারপরে এককাপ চা নিজে বানিয়েই খাই। চা বানাই কফি বানাই যা আমি নিজে বানিয়ে খাই। আমার ছোট বোন আর আমি দুইবোন যে আগে ওঠে সে বানায়। এখন পুতুল আছে আমার মেয়ে আছে, যে ঘুম থেকে আগে ওঠে সেই বানায়, নিজেরা করে খাই। তার আগে বিছানার থেকে নামার সাথে সাথে নিজের বিছানাটা গুছিয়ে রাখি নিজের হাতে। এরপরে বই টই যা পড়ার পড়ি আর ইদানিং এই করোনা ভাইরাসের পর যখন সকালে একটু হাঁটতে বেরই। তবে, আর একটা কাজ করি এখন, সেটা আবার বললে কী হবে?, গণভবনে একটি লেক আছে মাননীয় স্পীকার, যখন হাঁটতে যাই হেঁটে হেঁটে যখন লেকের পাড়ে বসি তখন একটা ছিপ নিয়ে বসি, মাছও ধরি!’ এক অনন্য সাধারণ অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের অতি সাধারণ ও প্রজন্মের জন্য অনুসরণযোগ্য জীবন যাপনের কাহিনী।

উপরের আলোচনার পরে উপসংহারে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশের বর্তমান যুব সমাজ প্রজন্মের সামনে দেশরত্ন শেখ হাসিনা প্রকৃতই অনন্য এবং অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। উন্নত সমৃদ্ধ ও মনুষ্য বসবাস উপযোগী বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য যা প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপকার এবং যুবসমাজ ও প্রজন্মের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ৭৬তম জন্মদিনে তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।

লেখক: সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অরুণ কুমার গোস্বামী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা: প্রজন্মের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

নতুন বার্সেলোনায় মুগ্ধ মেসি
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৫৫

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর