সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন বনাম মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
১ অক্টোবর ২০২২ ১৯:১৪
ফেসবুকে ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ সন্ত্রাসী হামলার লাইভ স্ট্রিমিং ঘটনা সন্ত্রাসীদের দ্বারা যে কোনো সময় অসৎ উদ্দেশ্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহৃত হতে পারে বলে স্পষ্ট বার্তা দিয়ে গেছে। ইন্টারনেটে সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছে সন্ত্রাসবাদের প্রচার ও প্রসার করতে সোশ্যাল মিডিয়াকে সন্ত্রাসীরা এখন প্রায় প্রতিনিয়ত কোন না কোনভাবে ব্যবহার করছে এবং বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলিতে বিভিন্ন অবৈধ ও ক্ষতিকর কনটেন্ট ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবল হুমকি তৈরি করেছে।
ফলশ্রুতিতে ক্রাইস্টচার্চ ঘটনার নাটের গুরু সন্ত্রাসী ব্রেন্টন ট্যারান্টের আল নূর মসজিদে ৫১ জন মুসলিম উপাসককে হত্যার লাইভ ভিডিও সম্প্রচারের পরপরই দুনিয়াজুড়ে অনলাইনে প্রদর্শনযোগ্য বিষয়বস্তু নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে আইন তৈরিতে জনমত তীব্র রাজনৈতিক গতি পায়। তার আগে, বৈশ্বিক সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো সাধারণত তাদের নিজস্ব নীতিমালার মাধ্যমে স্বেচ্ছায় অবৈধ ও ক্ষতিকর কনটেন্ট অপসারণ করত এবং এ কাজে সাধারণত তারা আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স প্রযুক্তি ও সাধারণ ব্যবহারকারীদের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নিত। তবে ক্রাইস্টচার্চ হামলা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলিকে স্বেচ্ছায় গৃহিত ব্যবস্থা থেকে বাধ্যতামূলক আইনী হস্তক্ষেপে যেতে বাধ্য করেছে।
গত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী ৪০টিরও বেশি নতুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ আইন গৃহীত হয়েছে এবং এই মূহুর্তে আরও অন্তত ৩০টি আইন প্রণয়ন বিভিন্ন রাষ্ট্রে সক্রিয়ভাবে বিবেচনাধীন রয়েছে। এই আইনগুলির সাধারণ লক্ষ্য হল অনলাইন সেবাপ্রদানকারীদের তাদের প্ল্যাটফর্মের বিষয়বস্তু সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে আইনগত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা এবং অনলাইনে চরমপন্থা প্রচারে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার রোধ করা। এই আইনগুলি অবৈধ এবং ক্ষতিকারক কিন্তু সরাসরি অবৈধ নয় এমন উভয় ধরণের কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। অবৈধ কনটেন্ট বলতে সকল ধরনের কনটেন্ট যা সরাসরি কোন আইন লঙ্ঘন করে; যেমন: ঘৃণা ছড়ানো বক্তৃতা, সহিংসতার প্ররোচনা, শিশু নির্যাতন, প্রতিশোধমূলক পর্ন প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করে। অপরদিকে, ক্ষতিকারক কনটেন্ট বলতে এমন সব তথ্যকে বোঝায় যা সরাসরি বা কঠোরভাবে আইনি নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে না; কিন্তু সমাজে এটির যথেষ্ট ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে; যেমন: অনলাইনে আত্ম ক্ষতি চিত্রিত করা, আত্মহত্যার চেষ্টা তুলে ধরা, সাইবার বুলিং, ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন ইত্যাদি।
ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার পরপরই অস্ট্রেলিয়ান পার্লামেন্ট ২০১৯ সালের মার্চ মাসেই তাদের the Criminal Code Amendment (Sharing of Abhorrent Violent Material) Act আইন প্রণয়ন করেছিল। এই আইনটি অনলাইন কনটেন্ট ও হোস্টিং পরিষেবা প্রদানকারীদের দায়িত্বশীল ও তাদের স্ব স্ব প্ল্যাটফর্ম নিরাপদ করার জন্য নতুন অপরাধ এবং দায়বদ্ধতা তৈরি করেছিল। উক্ত আইনটি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলিকে দ্রুত অবৈধ এবং ক্ষতিকারক কনটেন্ট অপসারণ করতে বাধ্যকরী আইনি দায় আরোপ করেছে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (সাধারণত ২৪ বা ৪৮ ঘণ্টা) কনটেন্ট সরাতে ব্যর্থ হলে কোম্পানির বার্ষিক লাভের ১০% পর্যন্ত জরিমানা ও কারাদণ্ডের ব্যবস্থা রেখেছে। পুনরায় ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়া তার ব্যবহারকারীদের জন্য অনলাইন জগত আরও নিরাপদ করতে নতুন আরও একটি স্বকীয় অনলাইন নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছে; যা বিশ্বের মধ্যে প্রথম শিশুদের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও সাইবার অপব্যবহার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করেছে।
অনুরূপভাবে; জার্মানি, ফ্রান্স, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), তুরস্ক, ব্রাজিল, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) পরিচালনার জন্য অনুরূপ আইনি কাঠামো পাশ করেছে না হয় আইন পাশের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে এসকল আইনের অধীনে বিশ্বব্যাপী একটি চলমান বিতর্ক রয়েছে যে বিচার বিভাগ নাকি তৃতীয় পক্ষ বেসরকারি প্রযুক্তি কোম্পানি কোন বিষয়বস্তু বৈধ নাকি অবৈধ তা নির্ধারণ করবে? কারণ দুনিয়াজুড়ে অনলাইন নিরাপত্তা আইনের সাম্প্রতিক প্রবণতা হল বেসরকারি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির ওপর বিষয়বস্তুর বৈধতা মূল্যায়ন করার ভার অর্পন করা। তথাপি এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আলোচ্য আইনসমূহ বিশাল বিশাল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং তাদের অবৈধ ও ক্ষতিকারক কনটেন্টের বিরুদ্ধে নিজস্ব ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ে স্বচ্ছ বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করতে এবং ব্যবহারকারীদের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পরিপূর্ণ আইনি কাঠামো প্রদান করেছে।
তবে একথাও সত্য যে, এ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনগুলির বিরুদ্ধে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করার এবং সেন্সরশিপ আরোপের মতো ভয়াবহ অভিযোগ রয়েছে। কারণ প্রতিটি আইনেই সত্যিকারের ভয় রয়েছে যে অনেক হোস্টিং সেবাপ্রদানকারী কোম্পানি ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম শাস্তি ও আইনি দায়বদ্ধতা এড়াতে বিষয়বস্তুর ক্ষতিকর দিক প্রকৃতভাবে মূল্যায়ন না করেই সরকারি সংস্থা বা কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে অভিযোগ পাওয়া মাত্রই বিষয়বস্তু সরিয়ে ফেলতে পারে। উপরন্তু, এ দায়িত্বে স্বাধীন বিচার বিভাগকে পাশ কাটিয়ে বেসরকারি প্রযুক্তি সংস্থার অন্তর্ভূক্তকরণ সোশ্যাল মিডিয়াতে ভিন্নমত সীমাবদ্ধ করার আশঙ্কা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশে ইতোপূর্বে জনপ্রিয় সামাজিক মিডিয়াতে আত্মহত্যার সরাসরি সম্প্রচার, প্রতিশোধমূলক পর্ন প্রকাশ, সাইবার বুলিং থেকে শুরু করে হয়রানি, ঘৃণাত্মক বক্তব্য, অপব্যবহার, সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি ইত্যাদির মতো বেআইনি এবং ক্ষতিকারক কনটেন্ট ছড়িয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। এদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বাড়লেও অদ্যাবধি বেআইনি ও ক্ষতিকর কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে কোন নির্দিষ্ট আইন করা হয়নি। যদিও সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে কিছু বিতর্কিত আইন; যেমন: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, আইসিটি আইন প্রণইয়ন করা হয়েছে; তথাপি সেসকল আইনসমূহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেআইনি ও ক্ষতিকারক বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণের জন্য মোটেই উপযোগী ও যথেষ্ট নয়।
এখন, বাংলাদেশ মূলত নির্দেশ এবং নিয়ন্ত্রণ (কমান্ড ও কন্ট্রোল) পদ্ধতিতে সোশ্যাল মিডিয়ার অবৈধ ও ক্ষতিকর বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ করছে। যেখানে সরকার এবং আদালত উভয়ই টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা সংস্থাকে যেকোনো বিতর্কিত (যার কোন আইনি মানদণ্ড নেই) বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অপসারণ করতে বা বাংলাদেশ থেকে একটি নির্দিষ্ট লিঙ্কে প্রবেশ করতে বাঁধা দেয়ার নির্দেশনা জারি করে। সুতরাং, এ ভূ-খণ্ডে বেআইনি এবং ক্ষতিকারক বিষয়বস্তু নির্ধারণের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট ও পরিষ্কার মানদণ্ডের অভাবে সংবিধান কর্তৃক রক্ষিত মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মতের বহুত্ব এবং ভিন্নমতকে সীমিত করার প্রকৃত ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০২১ সালে একটি খসড়া প্রবিধান প্রকাশ করে। যদিও বাংলাদেশের উচ্চ আদালত একটি মামলায় শুধুমাত্র ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য নীতি প্রণয়নের জন্য একটি আদেশ দিয়েছিল; অন্য কোন মাধ্যমের জন্য নয়। তবে বিটিআরসি কর্তৃক সুপারিশকৃত প্রবিধানের সঙ্গে ভারতের তীব্র সমালোচিত Indian Information Technology (Intermediary Guidelines and Digital Media Ethics Code) Rules, 2021 এর প্রভূত মিল রয়েছে। খসড়া প্রবিধান প্রকাশের পরপরই এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতা পরিপন্থী মর্মে অধিকারকর্মী ও বাংলাদেশের সুশীল সমাজ কর্তৃক ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। উক্ত খসড়া প্রবিধানে এমন অনেক অসম্পূর্ণ ও অস্পষ্ট শব্দমালা রয়েছে যেগুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রবিধানে দেয়া নেই; যেমনঃ দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা বা নিরাপত্তা, শালীনতা বা নৈতিকতা, বিদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, বা মানহানি। সঠিক ও নির্দিষ্ট সংজ্ঞার অভাব এবং অপরাধ গঠনের উপাদানগুলির অজ্ঞতা মতামত প্রকাশের জন্য একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করবে। কারণ এর আগে এদেশে জনগণকে জেলে পাঠানোর জন্য এই শব্দমালার অযৌক্তিক ব্যবহারের বেশ কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে।
আবার খসড়ায় বার্তা পরিষেবা প্রদানকারীর মতো মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে (যেমনঃ মেসেঞ্জার, হোয়াটসএ্যাপ প্রভৃতি) ব্যবহারকারীদের বার্তার গোপনীয়তা উন্মুক্ত করতে এবং বার্তার প্রথম প্রেরককে খুঁজে বের করে তার সম্পর্কে তথ্য দিতে বাধ্য করা হয়েছে, যা নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে নাগরিকের যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। সুতরাং, এই খসড়া প্রবিধানের মাধ্যমে বিটিআরসিকে এই ক্ষমতা দেয়ার মাধ্যমে তার যথেচ্ছ ব্যবহারের আশংকা তৈরি হয়েছে। উল্লিখিত প্রবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগে আরও বেশ কিছু সুযোগ রয়েছে, যা সংবিধান প্রদত্ত নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তার অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘন করতে পারে।
তাই, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড, প্রতিষ্ঠিত সর্বোত্তম চর্চা নিশ্চিতকরণ এবং কারও অধিকার লঙ্ঘন না করে দেশবাসীর জন্য নিরাপদ অনলাইন পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে সরকারের উচিৎ নতুনভাবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ আইন তৈরি করা। যাতে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও রক্ষা পায় আবার অপরদিকে অনলাইনে অবৈধ ও ক্ষতিকর কনটেন্ট যৌক্তিক ও আইনগতভাবে অপসারণ করা যায়।
লেখক: শিক্ষক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মত-দ্বিমত রাইসুল সৌরভ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন বনাম মতপ্রকাশের স্বাধীনতা