সর্বজনীন দুর্গাপূজা কি আর সর্বজনীন আছে? দুর্গাপূজা এখন আর সর্বজনীন নয়, দুর্গাপূজা বিশ্বজনীন হয়ে পড়েছে। সর্বার্থেই দুর্গাপূজা বিশ্বজনীন। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ইউনেসকো জানায় যে দুর্গাপূজা তাদের শিল্প ও ঐতিহ্যবাহী উৎসবের তালিকাভুক্ত হয়েছে। কলকাতার দুর্গাপূজা বিশ্বজনীন হলে তো সারা পৃথিবীর দুর্গাপূজাই বিশ্বজনীন হয়ে পড়ে।
মা দুর্গার আরাধনা এবং উৎসবের আনন্দের রং তো সারা বিশ্বে একই রকম। ভাব, ভক্তি, উদযাপনের মধ্যে খুব বেশি কি পার্থক্য আছে? মোটেই নেই। ইউনেসকোর ইনট্যানজিবল হেরিটেজের স্বীকৃতি পাওয়ার পর ২০২২–এর দুর্গাপূজা খুব তাৎপর্যবহ হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন হলো, বিশ্বজুড়ে উদযাপিত দুর্গাপূজার সংগঠকরা কি এ বিষয়ে সচেতন আছেন। বিশ্বায়নের কারণে পৃথিবীর সব মহাদেশ এখন একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। ইংরেজিতে আমরা বলি গ্লোবাল ভিলেজ। আজ ঢাকা–কলকাতা, লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক কিন্তু পরস্পরের থেকে খুব বেশি দূরে নয়। রূপক অর্থে এবং ভৌগোলিকভাবে হয়তো ‘সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পার’, প্রযুক্তির শক্তিতে বাড়ির পাশের আরশিনগর। দুর্গাপূজা বিশ্বজনীন হওয়ার আরেকটি কারণ হলো সারা বিশ্বে বাঙালি হিন্দুদের ছড়িয়ে পড়া। আর বাঙালি হিন্দু যেখানে, সেখানেই তাদের প্রধান উৎসব সাধ্য অনুযায়ী জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপিত হয়ে থাকে। ভাবলে অবাক হতে হয়, মালয়েশিয়ার মতো মুসলিমপ্রধান দেশেও দুর্গাপূজা উদযাপিত হচ্ছে ১০ বছর ধরে।
দুর্গাপূজাকে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেসকো কী বলেছে? দুর্গাপূজার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব সম্পর্কে ইউনেসকো বলছে, ‘দুর্গাপূজা হলো ধর্ম ও শিল্পের সর্বজনীন অনুষ্ঠানের সর্বোত্তম উদাহরণ এবং শিল্পী ও নকশাকারীদের জন্য একটি সমৃদ্ধ ক্ষেত্র। এই উৎসব পৌর অঞ্চলে বৃহৎ স্থাপনা ও মণ্ডপের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী ঢাকের বাদ্য ও দেবীর পূজা দ্বারা পরিচিত। এই উৎসবে শ্রেণি, ধর্ম ও জাতি ভেদাভেদ মুছে যায়। ’ ইউনেসকোর স্বীকৃতিতে দুটি বিষয় খুব স্পষ্ট, একটি হলো দুর্গাপূজার মানবিক দিক, যেটি তাদের বিমোহিত করেছে। তাদের ভাষায়, দুর্গাপূজা উদযাপনে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শ্রেণি, ধর্ম ও জাতিভেদকে ভুলে যায়। আমাদের এখন ভাবতে হবে সত্যি কি আমরা সমতার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে পূজার মাধ্যমে শ্রেণি, ধর্ম ও জাতিভেদ ভুলে যাই।
দুর্গাপূজা কি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিচ্ছে ধীরে ধীরে? বুঝতে কষ্ট হয়। মনে হয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনকে দৃশ্যমান করতে আরো সময়ের প্রয়োজন। তবে শ্রেণিভেদ, বর্ণভেদ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর বিষয়টি নিয়ে পূজা সংগঠক ও সমাজকর্মীদের আরো সচেতন হতে হবে। পূজার আয়োজনের সঙ্গে যদি সচেতনা সৃষ্টির কর্মসূচিকে যুক্ত করা হয়, তাহলে বিশ্বজনীন দুর্গাপূজা উদযাপনের উদ্দেশ্য অনেকাংশেই সফল হবে।
ফিরে আসি দুর্গাপূজার বিশ্বজনীনতা প্রসঙ্গে। মা দুর্গা হলেন দুর্গতিনাশিনী অর্থাৎ সব দুঃখ–দুর্দশার বিনাশকারী। তিনি অন্যায়–অসত্যের প্রতীক মহিষাসুরকে নিধন করার জন্যই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বিশ্বজুড়ে অন্যায়, অসত্য, যুদ্ধবিগ্রহের এই ক্রান্তিকালে মা দুর্গার আদর্শ কিন্তু আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। মাতৃ আরাধনার উদ্দেশ্যকে সফল করার উদ্দেশ্যে প্রতিটি পূজার আয়োজন যদি নিবেদিত হয়, তাহলে দুর্গাপূজার মাহাত্ম্য বিশ্বজুড়ে মানুষের কাছে শ্রদ্ধার সঙ্গে গৃহীত হবে এবং বিশ্ববাসী মাতৃ আরাধনার তাৎপর্য অনুধাবন করতে সমর্থ হবে খুব সহজেই। দুর্গাপূজা তাই পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, এমনকি বৈশ্বিক সংহতি রক্ষায় এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সমায়ানুগ একটি পূজা। পৃথিবীর সব রাবণরূপী অসুরকে বিনাশের জন্য দেবী দুর্গার আরাধনার গুরুত্ব অসীম। ‘রাবণস্য বিনাশায় রামসানুগ্রহায় চ অকালে বোধিতা দেবী। ’ অর্থাৎ রাবণকে বিনাশের জন্য রামের প্রতি অনুগ্রহবশত অকালে দেবী দুর্গা বোধিত হয়েছিলেন। দুষ্ট শক্তি রাবণকে বধ করার জন্য রাম নিদ্রিত সময়ে দেবীর পূজা করেছিলেন অকাল বোধনের মাধ্যমে। আমাদের অন্তরের রাবণকে বিনাশ এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য তাই দুর্গাপূজার আয়োজন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও ভক্তিভরে করা উচিত।
লেখক : লেখক ও উন্নয়ন গবেষক