মহামন্দার পদধ্বনি, সংকটের বছর ২০২৩
১৩ নভেম্বর ২০২২ ১৫:১১
বিশ্বজুড়ে মহামন্দায় পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ২০০৮ অর্থনৈতিক সংকট এবং ২০২০ সালের করোনা সংকটের চেয়েও চাপে আছে বিশ্ব অর্থনীতি। ২০২৩ সালে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করবে। বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে দেশি-বিদেশি সংস্থা, বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক বিশ্লেষকরা এই আশঙ্কার কথা বলছেন। জাতিসংঘও সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলেছে বিশ্ব মন্দার দ্বারপ্রান্তে। এতে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো মন্দার ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। সম্প্রতি বাণিজ্য ও উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (আঙ্কটাড)। জাতিসংঘের এ সংস্থাটির মহাসচিব গ্রিনস্প্যান এক বিবৃতিতে বলেছেন, আজ আমাদের সতর্ক করা দরকার যে আমরা একটি বৈশ্বিক মন্দার দ্বারপ্রান্তে।
এদিকে আগামী বছর মন্দা হতে পারে বলে বারবার সতর্ক করেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে পর পর দুদিন তিনি এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আগামী বছরের সম্ভাব্য মন্দা নিয়ে সতর্ক করে সবাইকে যে যা পারেন উৎপাদন করতে আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে সবাইকে সঞ্চয়ী হতে, সাশ্রয়ী হতে পরামর্শ দিয়েছেন।
কয়েকদিন আগের মিডিয়ায় খবর হয়েছে যে ব্যাঙ্কগুলো বড় এলসি খুলতে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু বিমানে বিজনেস ক্লাসের টিকেটের প্রবল সংকট। আর গেল ছুটিতে দেখা গেছে কক্সবাজার সৈকতে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। যেন মানুষ সমুদ্র দেখতে যায়নি, সমুদ্র মানুষকে দেখেছে। এই দুই চিত্র থেকে বোঝা যায় কিছু মানুষের হাতে প্রচুর টাকা। অর্থনৈতিক সংকট, মন্দা তাদের জন্য কিছুই না। কিন্তু সামগ্রিক চিত্র অন্যরকম। ৯৯% ভাগ মানুষের পকেটেই এখন টান পড়েছে। করোনার সময় অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। অধিকাংশই এখনও চাকরি পাননি। যাদের চাকরি আছে, যারা চাকরি পেয়েছেন তাদের অনেকেরও বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের সাশ্রয়ী হওয়া সঞ্চয়ী হওয়া তো দূরের কথা। সঞ্চয়ে হাত পড়ে তাদের এখন বেঁচে থাকাই কঠিন এক সংগ্রাম যেন।
অন্যদিকে লাগামহীন দ্রব্যমূল্যে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। যৌক্তিক কারণেই সরকার তেলের দাম বাড়িয়েছে। অবশ্য বাড়ানোর মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু তেলের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি অসৎ ব্যবসায়ীদেরকে মানুষের পকেট কাটার সুযোগ করে দিয়েছে। তেলের মূল্যের সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি আনুপাতিক হারে হয়নি। অসৎ ব্যবসায়ীরা লাগামহীনভাবে দাম বাড়িয়েছে। কাপড় ধোওয়ার যে এক কেজি হুইল পাউডারের দাম ছিল ৮০ টাকা, তেলের দাম বাড়ানোর পর সেটি লাফিয়ে হয়েছে ১১০ টাকা। আর গেল সপ্তাহে কোন কারণ ছাড়াই ১৪০ টাকা। নিয়ন্ত্রণহীন এই মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে সব ধরণের পণ্য-দ্রব্যেই। ফলে সাধারণ মানুষের সাশ্রয়ী হওয়ারও কোন সুযোগ নেই। শুধু এই টিকে থাকার লড়াই।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সব মানুষকে নিয়েই এই মন্দা মোকাবিলা করবে সরকার। করোনা সংকটে প্রধানমন্ত্রীর এই নীতিতে চমৎকার সাফল্য দেখা গেছে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায়ও মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হবে। তবে সবচেয়ে বড় দরকার সরকারের সক্রিয়তা, যথাযথ নীতি ও কর্মপন্থা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেলের ও এলএনজির দাম বাড়ার কারণেই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট। মাঝে কিছুটা দাম কমতে শুরু করেছিল কিন্তু এখন সেটি আবার লাফিয়ে বাড়বে। কারণ নর্ডস্ট্রিম-২ পাইপলাইনে নাশকতার কারণে ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো বর্তমান চাহিদা ও ভবিষ্যতের মজুতের জন্য মরিয়া হয়ে বিশ্ববাজার থেকে তেল ও এলএনজি কিনছে।
২০২১ সালের চেয়ে গ্যাসের চাহিদা ফ্রান্সে ৮৮%, নেদারল্যান্ডে ১০৯%, বেলজিয়ামে ১৫৭% বেড়েছে। বড় অর্থনীতির দেশ জার্মানি ও ইংল্যান্ডের কথা বলাই বাহুল্য। রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের চেয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোকে ৪৪২% আরও বেশি দামে বিশ্ব বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে। এদিকে তেল উৎপাদনকারী জোট ওপেক প্লাস দৈনিক তেল উৎপাদন ২ লক্ষ ব্যারেল কমিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তে দাম আরও বাড়বে। সেই সঙ্গে প্রাপ্তি সংকটও প্রকট হবে। উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক সামর্থ্য ভালো। তারা প্রচুর ব্যয়ে এই সংকট মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই মূল্য বৃদ্ধি ও প্রাপ্তি সংকটের কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জ্বালানী সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে এবং জ্বালানীর দাম বাড়ায় সার্বিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ ও অর্থনীতি। অন্যদিকে উন্নত দেশগুলো সুদের হার বাড়ানোর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৩৬০ বিলিয়ন ডলার আয় কমবে। এরই মধ্যে এ বছর প্রায় ৯০টি দেশের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে দুর্বল হয়েছে।
ঋণ বাড়ছে, আমদানি ব্যয় বাড়ছে। বাড়ছে দ্রব্যমূল্য, কমছে রিজার্ভ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর প্রবল প্রতিঘাত রয়েছে। আগামীতে এ পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে বলে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের ধারণা। করোনা সংকটের বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। অর্থনৈতিক সংকটের মূলকেন্দ্র ইউরোপ। কিন্তু এর প্রতিঘাতে বিপর্যস্ত হচ্ছে বিশ্বের সব প্রান্তের অর্থনীতি।
আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং মৌলিক ভিত্তি অন্য দেশের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। ফলে বিশ্বমন্দার প্রভাব প্রবলভাবে আমাদের আঘাত হয়তো নাও করতে পারে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস প্রবাসী আয় ও পোশাক রপ্তানি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত সংকটে ইউরোপ আমেরিকা ও কানাডায় প্রায় আড়াই লক্ষ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। গুগল, ফেইসবুক ও বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা ভাবছে। এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো থেকে আসা প্রবাসী আয় কমবে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের প্রধান উৎস মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া। তেল ও এলএনজির দাম বাড়ায় ঐ অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থনীতি লাভবান হচ্ছে। ফলে ঐ অঞ্চল থেকে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমার আশংকা নেই।
পোশাক রপ্তানির আয় নিম্নমুখী হতে পারে। তবে বাংলাদেশ উচ্চমূল্যের পোশাক নয় সাধারণ মূল্যের পোশাক রপ্তানির উপর নির্ভরশীল। এটিও বাংলাদেশের জন্য খানিকটা স্বস্তির ব্যাপার। কারণ অর্থনৈতিক সংকটে পড়া উন্নত দেশগুলোর ক্রেতারা হয়তো এ সময়ে উচ্চমূল্যের বিলাসী পোশাক কিনবেন না। বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে না। সংকটে থাকলেও সাধারণ মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পোশাক কিনতে হবে। সে ক্ষেত্রে ক্রেতারা হয়তো ২টি শার্ট, ২টি টিশার্ট , ২টি প্যান্টের জায়গায় ১টি করে কিনবেন। এতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমে যাবে কিন্তু একেবারে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে না।
অন্যদিকে প্রাণীজ ও উদ্ভিদজাত খাদ্যদ্রব্যের জন্য বাংলাদেশের বিদেশ নির্ভরতা ব্যাপক নয়। এসব দ্রব্যের সিংহভাগ দেশেই উৎপন্ন হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা শুনে সংশ্লিষ্টরা সতর্ক হলে এবং সরকারি নীতি সহায়তা ও আর্থিক সহায়তা পেলে উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতায় করোনা সংকট বাংলাদেশ সফলভাবে মোকাবিলা করেছে। যখন টিকা উৎপাদন শুরু হয়নি, কেবল গবেষণা চলছে তখন অগ্রিম টাকা দিয়ে বাংলাদেশ টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে। একই সঙ্গে অর্থনীতির চাকা সচল রেখে এবং পরিকল্পিত লকডাউন করে করোনা প্রকোপ সীমিত রাখার চেষ্টা সফল হয়েছে। আর্থিক প্রণোদনা ও সহায়তা দিয়ে প্রান্তিক পর্যায়েও অর্থনীতির চাকা সচল রাখা হয়েছে।
মন্দার ব্যাপারেও অনেকের আগেই প্রধানমন্ত্রী চিন্তা ভাবনা শুরু করেছেন। জ্বালানির জন্য প্রচলিত উৎসের বাইরে অন্য উৎস থেকে আমদানির জন্য আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ। আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও আমদানির ক্ষেত্রে জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এগুলো কার্যকর হওয়ায় রিজার্ভের দ্রুত পতন ঠেকানো গেছে। এখন লড়াই মুদ্রাস্ফীতি সামলানোর।
আঙ্কটাড মহাসচিব বলেছেন মন্দার ঝুঁকি থেকে সরে আসার সময় আছে। যদি দেশগুলো তাদের কাছে থাকা কৌশলগুলোকে মুদ্রাস্ফীতি প্রশমিত করতে ও ঝুঁকিতে থাকা গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তার জন্য ব্যবহার করে। বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতার কৌশলগুলো থেকে নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী যথাযথ উদ্যোগ নেবেন। এ ক্ষেত্রে চাকরি হারানো মানুষদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি, ক্ষুদ্র ঋণ সরবরাহ আরও জোরদার করে গ্রামীণ ও প্রান্তিক অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতা এবং সহায়তা বাড়াতে হবে। অর্থ পাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর এবং আপোষহীন হতে হবে।
বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও করোনার মতো ভয়াবহ সংকট বাংলাদেশ সফলভাবে মোকাবিলা করেছে। সতর্ক হলে এবং এখন থেকেই প্রস্তুতি নিলে বিশ্ব মন্দার সংকটও বাংলাদেশ সফলভাবে সামলাতে সক্ষম হবে ।
লেখক: জেষ্ঠ্য সাংবাদিক ও সংবাদ বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
মত-দ্বিমত মহামন্দার পদধ্বনি- সংকটের বছর ২০২৩ মাহমুদুল হাসান শামীম