গুজবের জবাবও কি প্রধানমন্ত্রী দেবেন?
১৭ নভেম্বর ২০২২ ১৬:১৯
রিজার্ভ গেল কই? কেউ খেয়ে ফেলেছে? চিবিয়ে না গিলে? ব্যাংকগুলোর পুঁজি-পাট্টা ঠিক আছে তো? গ্রাকদের টাকা ফেরত দিতে পারবে ব্যাংকগুলো? কেন এলসি হয় না? ছাত্রলীগ নেত্রী কেন গরু চুরি করতে গিয়ে ধরা খায়? দুনিয়ার যতো প্রশ্ন। সব সব প্রধানমন্ত্রীকেই দিতে হয়। বাদবাকিরা কই? মুখপাণ্ডিত্যে পাকা যে মহাশয়রা একেক সময় একেকটা বলে কাউর লাগান তারাই বা এখন কোথায়? সরকার রক্ষা, দল রক্ষার পাশাপাশি ওই দুধের মাছিদের রক্ষাও দায়িত্ব হয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রীর?
যে মূহুর্তে বৈশ্বিক মন্দা, বাংলাদেশেও দুর্ভিক্ষের চোখ রাঙ্গানি; এ সময়টাতে এমনিতেই সহনশীলতা জরুরি। সাহস দরকার। সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী অভয় দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে না। তার ভাষায়: সারা বিশ্বে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা গেলেও ‘বাংলাদেশে ইনশা আল্লাহ দুর্ভিক্ষ হবে না’। আরেক বাক্যে বলেছেন, যারা বলেছিল বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে তাদের মুখে ছাঁই পড়েছে।
অভয় দেয়ার তো আর কিছু অবশিষ্ট রাখেননি প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু, তার বলতে দেরি, এ নিয়ে অপব্যাখ্যা প্রচারে দেরি হয় না। রঙ্গ-ব্যঙ্গ, ট্রল চলছে সমানে। সেইসঙ্গে এন্তার গুজব। নাই-নাই শোরগোল চারদিকে। এ কর্মের আয়োজকরা এগিয়ে যাচ্ছে সাফল্যের সঙ্গে। স্যোশাল মিডিয়া উৎরে মূলধারার গণমাধ্যমেও এসব গুজব নিউজ আইটেম হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপক লক্ষনীয় বিষয়, সরকার পক্ষে এসবের জবাব দেয়া যেন একা প্রধানমন্ত্রীরই দায়িত্ব। পরীক্ষার্থী তিনি একাই। বাদবাকিদের দায়িত্ব কেবল পরীক্ষা পাসের সনদ নেয়া।
সময়টা এমনিতেই খারাপ। মহামারি করোনার পর রুশ-ইউক্রনে যুদ্ধ। বৈশ্বিক মন্দ পরিস্থিতির জের বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। বিশ্ববাজারে নজিরবিহীন হারে বেড়ে গেছে জ্বালানি, খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দাম। রিজার্ভ কমেছে। এ কারণে ভবিষ্যত অর্থনীতি নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এর বিপরীতে দেশে গুজবের ধুম। একটা চলতে চলতেই আরেকটাকে আছড়ে ফেলা হয়। এর মাধ্যমে রাজনীতিতে তার কুপ্রভাব ভর করেছে।
এর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত একা প্রধানমন্ত্রীকেই লড়তে হচ্ছে। গুজব পার্টি দক্ষতার সঙ্গে কখনও গণমাধ্যমে সওয়ার হয়, কখনও বেছে নেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। এরা সঙ্গবদ্ধ। পরিকল্পিতভাবে করছে প্রতিটি কাজ। তা বোঝা যায় সাদা চোখেই। সরকারি দলের তরফে বলা হচ্ছে, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এদের রুখে দেবে আওয়ামী লীগের বিশাল কর্মী বাহিনী। কই-কোথায় এ বাহিনী? এরা তো ব্যস্ত হানাহানিসহ নানান মন্দ কাজে। এতে গুজববাজদের রাস্তা আরো পরিস্তারই হচ্ছে। সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় এরা নিজেরা সংঘর্ষ করে। নিজেদের লোক হতাহত হয়। দলের বড় বড় নেতাদের সামনেও হচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে তারা চেয়ার-টেবিলের নিচে পালান। দলের সাধারণ সম্পাদককে বলতে হয়, না এমন কিছু ঘটেনি। নিহতের সঙ্গে তাদের কাউন্সিলের কোনো সম্পর্ক নেই। তা গুজব রাজ্যের রাজাদের জন্য পুলকের।
অন্তদলীয় সংঘাতসহ নানা দলীয়পনা, অনাকাঙ্খিত খবরদারির ব্যস্ততায় ক্ষমতাসীন নেতাকর্মীদের আর এসব গুজব বা অপপ্রচার রোখার সময় হয় না। নেতারা ব্যস্ত নানা কথা-কুকথার খিস্তিখেউরে। অপপ্রচারের জবাব ও গুজব রোখার ভারটা প্রধানমন্ত্রীর ওপর দিয়ে তারা নিজেরা নির্ভার। ঝড় এলে তাদের ওপর আঘাত পড়বে না, ভাবটা এমনই। ঝড়ের তেজ বেশি পড়ে বড় বটগাছে। ওই গাছের কাণ্ডকেই সব ভার দিয়ে দিলে ঢাল-পালা-লতা-পাতাদের আর কোনো দায়িত্ব থাকে না-বিষয়টি এতো সহজ? এ রকম সময়ে সরকারের চেয়ে সরকারি দলের দায়িত্ব কম নয়, বরং বেশি। নির্বাচন এগিয়ে আসছে, বিরোধী দল সরকারের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো প্রকাশ ও প্রচার বাড়িয়ে দেবে-এটাই স্বাভাবিক। ওই প্রচার মিথ্যাশ্রিত হলেও এর প্রভাব পড়ে। ক্ষমতাসীনদের তা ভালো করেই জানা। তাদের দলীয় প্রধান অনেক কিছুতেই সক্ষম-পারঙ্গম তা সত্য। তাই বলে প্রচার-অপপ্রচার-গুজবের গজব, রোখার মতো সব তারই কাজ?- মোটেই নয়।
ভেতরে-ভেতরে সময় খারাপ যাচ্ছে অনেকদিন থেকে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটানের চেয়ে বাংলাদেশে পণ্যের দাম বেশি হারে বেড়েছে। আমরা কিছুটা ভালো আছি শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের চেয়ে। পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কাকে তুলনীয় করা বাংলাদেশে জন্য সম্মানের নয়। সামনে অস্থিতিশীলতা তৈরির কুলক্ষণ আরো বেশি। অর্থনৈতিক অবস্থা আরো বিপদশঙ্কুলের বার্তা ঘুরছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট চলছে। শিল্প মালিকরা বড় সমস্যার মুখে পড়েছেন। কৃষি-শিল্প উৎপাদন ধরে রাখতে হলে শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ আবশ্যক। করোনা মহামারিতেও শিল্পের উৎপাদন অব্যাহত ছিল। এ কারণে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি খারাপ ছিল না। জ্বালানির দাম বাড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে গ্যাসের আমদানি কমে গেছে। ফলে গ্যাসের আমদানি বাড়ানোর বিকল্প নেই।
দুর্গতি-দুর্যোগ নিয়ে রাজনীতি করতে নেই। কিন্তু, হচ্ছে দেশে-দেশে। এ নিয়ে প্রচার-কুপ্রচারের ধুম। বিশেষ করে খাদ্যের মতো নিত্যজরুরি জিনিসকে ইস্যু করে সরকার ফেলে দেয়া অথবা এ ইস্যুতে কায়দা করে সরকারের টিকে যাওয়ার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি দেশেই চলমান। বাংলাদেশে কোনো বিরোধীদল কখনো এ ধরনের সুযোগ কাজে না লাগিয়ে পরহেজগারিত্ব দেখিয়েছে এ নজির নেই। এ ক্ষেত্রে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ৭৩-৭৪ এর ফুড পলিটিক্স স্মরণ না করলে মস্ত ভুল হবে। যতো দায় সব প্রধানমন্ত্রীর ওপর ছেড়ে না দিয়ে সেই পাঠ বেশি নিতে হবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের।
প্রয়োজনে তাদের নতুন করে জেনে নেয়া দরকার তখন কীভাবে কলঙ্কিত করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে? কীভাবে নিশ্চিতি করা হয়েছিল একটি পাতানো দুর্ভিক্ষ? যুদ্ধকালে পাক-হানাদাররা এ দেশের মানুষকে ভাতে মারার ‘পোড়া মাটি নীতি’ অবলম্বনে মজুদকৃত বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য নষ্ট করে দেয়। ওই সময়টায় অনেক কৃষি জমি অনাবাদি থেকে যায়। তারওপর বাংলাদেশ তখন খাদ্যে স্বনির্ভর ছিল না। ঘাটতি পূরণে তখন প্রতিবছর ৩০-৪০ লাখ টন খাদ্য আমদানি করতে হতো। উপরন্তু ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে যায় দেশের বিরাট অংশ। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কেনা খাদ্য যেন সময়মতো জনগণের হাতে পৌঁছতে না পারে সেই অপচেষ্টাও চলে। দেশি লুটেরা ও ঘাপটি মেরে প্রাণে বেঁচে থাকা রাজনীতিকদের হাত করে বিদেশি কয়েকটি শক্তি তখন চুটিয়ে ফুড পলিটিক্স করেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চালসহ বিভিন্ন পণ্য কিনে নষ্ট পর্যন্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানাশোনাদের অনেকেই এখনো জীবিত আছেন। তবে, পরে জানলে-বুঝলে করার কিছু থাকে না।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট- বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
গুজবের জবাবও কি প্রধানমন্ত্রী দেবেন? মত-দ্বিমত মোস্তফা কামাল