নারী নির্যাতন একটি সামাজিক ব্যাধি। দেশের সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছে। এমনকি নারীর অনেক ক্ষমতায়নও হয়েছে। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে নারী নির্যাতন কমছে না। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের কঠোর আইন আছে, সে আইনের প্রয়োগও আমরা দেখি। কিন্তু সামাজিকভাবে নারী আজও নির্যাতনের শিকার। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিই এর মূল কারণ। সমাজ মানে ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্র। ফলে, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কথা বলতে গেলে ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কথা বলতে হবে।
আজ (২৫ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে রাষ্ট্র আইন করেছে, নীতি প্রণয়ন করেছে। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য রাষ্ট্র নারী শিক্ষায় প্রণোদনা দিচ্ছে, কর্মসংস্থানে তাদের এগিয়ে নিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে। তাদের জন্য চাকরিতে ‘কোটা’ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আয়কর দেওয়ার ক্ষেত্রেও নারীর জন্য রয়েছে বিশেষ সুবিধা। কাজেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, নারীর ক্ষমতায়ন ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র তার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও নারী নির্যাতন কমছে না। কারণ, ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে নারী তার মর্যাদা আজও ফিরে পায়নি।
পরিবার আজও নারীকে অধস্তন সদস্য হিসেবেই দেখে। ব্যক্তি মানুষ দিয়েই পরিবার। কাজেই ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে রাষ্ট্রে আপনা-আপনিই নারী তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা পাবে। নারী নির্যাতনের মূল কারণ পুরষতান্ত্রিক মানসিকতা, যেখানে নারীকে অধস্তন মানুষ হিসেবেই দেখা হয়— হোক তা পরিবার, অফিস-আদালত বা যেকোনো কর্মক্ষেত্র।
নারীর নিরাপত্তাহীনতা ও অসহায়ত্বই নারী নির্যাতনকারীদের মূল পুঁজি। আসলে কেবল নারী কেন, সব নির্যাতনেরই পেছনেই রয়েছে একই বাস্তবতা।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন হয়েছে, কিন্তু সে আইন নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রতিবছর অনেক মামলায় আমরা নির্যাতনকারীদের শাস্তি হতে দেখি। কিন্তু শাস্তির ভয়ে নির্যাতনের পরিমাণ ও মাত্রা কমছে বলে মনে হয় না। গবেষকরা বলেন, আইনের ফাঁক-ফোকড়ের পেরিয়ে অনেকে বেরিয়ে আসেন। এমন একটি ধারণাও কিন্তু নারী নির্যাতনকারীদের উৎসাহিত করে। সেই সাথে বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতাতো আছেই।
আইন বলছে, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিচার হতে হবে ১৮০ দিনের মধ্যে। কিন্তু তা হচ্ছে না। বাস্তব কারণেই অনেক সময়ই এই সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। সরকার দেশের সব জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতনের বিচার করার জন্য পৃথক আদালত করেছে। কিন্তু তারপরও ছয় মাসের মধ্যে অনেক মামলারই বিচার হয় না। অপরাধের তদন্ত ও প্রতিবেদন দাখিল, মামলা রুজু, সাক্ষী শুনানি শেষেই আদালত রায় দেন। এর প্রতিটি পর্যায়ে আদালতকে বাদী-বিবাদী, তাদের আইনজীবী, সাক্ষী, প্রতিবেদন, ও প্রমাণের ওপর নির্ভর করতে হয়। এটি একটি স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়া। ফলে ন্যায়বিচার পেতে হলে আদালতকে সবার সহযোগিতা করতে হবে। একথা সত্যি, মামলার জট ও আদালতের নিজস্ব কিছু সীমাব্ধতার জন্য অনেক মামলা দীর্ঘদিনেও নিষ্পত্তি হয় না। অনেক মামলায় দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারে না রাষ্ট্র।
আমরা জানি, প্রতিবছর যত মামলা হয় তত রায় হয় না, সাজা তো পরের কথা। অধিকাংশ মামলার অগ্রগতিই হতাশাজনক। আদালতের সীমাবদ্ধতা আছে, আমরা জানি। কিন্তু এর মধ্যেও আদালত আরেকটু উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে পারে। আদালত নিজেই তার কাছে দায়ের করা মামলাগুলোর অগ্রগতি যাচাই করার জন্য নির্দিষ্ট সময় পর পর একটি পর্যলোচনা করতে পারে। এ ছাড়া সরকারও এসব মামলার অগ্রগতি জানতে বিশেষ সেল করতে পারে।
একটি ফৌজদারি মামলায় পুলিশের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশের অভিযোগের ওপর নির্ভর করে মামলা ভবিষ্যত। অভিযোগপত্র দাখিলের পর সাক্ষীদেরও হাজির করতে হয় পুলিশের। এছাড়া মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে আছে পুলিশের ভূমিকা। কিন্তু অভিযোগ আছে, কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ তার নিজের ভবিষ্যতের জন্য মামলার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেয়। দক্ষতা ও সততা নিয়ে কাজ করার অবকাশ আছে।
যত মামলা দায়ের হয়, তার প্রায় অর্ধেকেই নাকি আসামি বেকসুর খালাস হয়ে যায়। তবে কি এসব মিথ্যা মামলা? কিন্তু মূল কারণ ‘মিথ্যা মামলা’ নয়, বরং অভিযোগ দায়ের থেকে শুরু করে তার তদন্ত ও সাক্ষ্য উপাস্থাপনে ঘাপলা। আবার অনেক মামলায় সাক্ষীরা আদালত পর্যন্ত আসতে চায় না। আদালত সাক্ষ-প্রমাণ ছাড়া শুধু ধারণার ওপর ভিত্তি করে রায় দিতে পারেন না। সাক্ষী আসতে না চাওয়ার অনেক কারণ আছে, সেগুলো দূর করা জরুরি। নিম্ন আদালতে মামলা নিষ্পত্তি ও সাক্ষী হাজির করার ক্ষেত্রে কারো গাফলতি থাকলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারেন উচ্চ আদালত। বিচার প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান এ সমস্যাগুলো দূর করতে পারলে নারী নির্যাতন দমন আদালতে গতি আসবে। সরকারকে এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে হবে।
নারী নির্যাতন প্রতিকারে আইনের প্রয়োগ ও প্রতিরোধে মানসিকতার পরিবর্তনই নারী নির্যাতন প্রতিরোধের ব্রহ্মাস্ত্র।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট