পাঠকের আস্থাই সবচেয়ে বড় অর্জন
৬ ডিসেম্বর ২০২২ ১১:০০
যে কোনো সম্ভাবনাকে গলা টিপে হত্যা করতে আমাদের জুড়ি নেই। ই-কমার্স হলো তেমনই এক সম্ভাবনা। বিশেষ করে করোনা আসার পর বিশ্বজুড়েই ই-কমার্স হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গা। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতারকরা দখল করে নেয় ই-কমার্সের ক্ষেত্রটি। ই-কমার্স মানেই যেন প্রতারণা, টাকা মেরে দেয়া, এক পণ্যের কথা বলে আরেক পণ্য গছিয়ে দেয়া। তেমনই আরেক সম্ভাবনার ক্ষেত্র হলো অনলাইন নিউজ পোর্টাল। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার এই ক্ষেত্রটিকেও আমরা ধ্বংস করতে বসেছি। বাংলাদেশে সবচেয়ে সহজ কাজ হলো একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল করে সাংবাদিক বনে যাওয়া। আর সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো, সেই নিউজ পোর্টালকে বিশ্বাসযোগ্য এবং পাঠকপ্রিয় করে তোলা।
আমি একটু পুরোনো ঘরানার মানুষ। সারাদিন সংবাদেই থাকি। তাও সকালে ছাপা পত্রিকা না পেলে দিন শুরু হতে চায় না। ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই দরজার সামনে গিয়ে ঘোরাঘুরি করি, কখন আসবে দৈনিক পত্রিকা। করোনা এসে সেই অভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। সকালটা শুরু হয় ডিজিটাল ডিভাইসে ই-পেপার পড়েই। তবে অফিসে এসে প্রথম কাজ হলো পত্রিকা হাতে নেয়া। ছুঁয়ে না দেখলে আমার পড়াটা ঠিক পূর্ণ হয় না। অনেকদিন ধরেই ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানারকম শঙ্কার কথা শুনে আসছি। কিন্তু আমাদের মত পুরোনো ঘরানার মানুষ যতদিন আছে, ততদিন ছাপা পত্রিকা থাকবেই।
আমার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ যাই হোক, অনলাইন নিউজ মিডিয়া এখন বাস্তবতা। যত দিন যাবে, মানুষের অনলাইন নির্ভরতা তত বাড়বে। গণমাধ্যমের তথ্য প্রচারের যে কটি মাধ্যম তার মধ্যে সর্বশেষ এবং সবচেয়ে সম্ভাবনাময় নিঃসন্দেহে অনলাইন। ছাপা পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন হয়ে গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ এখন অনলাইনে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই এই প্রবণতাই এখন বাস্তবতা। সংবাদ সংগ্রহের জন্য মানুষের নির্ভরতা ক্রমশ অনলাইনমুখী হচ্ছে। সব ছাপা পত্রিকারই অনলাইন ভার্সন আছে, অধিকাংশ টিভিরও আছে। অনেক পত্রিকার সার্কুলেশনের চেয়ে অনলাইনে পাঠক বেশি। এখনই আমি এমন অনেক লোককে চিনি, যারা পত্রিকা পড়েন না, টিভি দেখেন না। কিন্তু তারা আবার পিছিয়েও থাকেন না। অন্তর্জাল জগতের নানা মাধ্যম থেকে তারা প্রয়োজনীয় নিউজের লিঙ্কটি ঠিকই খুঁজে নেন।
শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত; কানে শুনতে পেলেই যে কেউ বেতারের শ্রোতা হতে পারেন। টেলিভিশনের দর্শক হতে হলে, কানের সাথে দৃষ্টিশক্তিও থাকতে হবে। কিন্তু পত্রিকার পাঠক হতে হলে আপনাকে অন্তত বানান করে পড়ার মত শিক্ষিত হবে। আর অনলাইনের পাঠক হতে হলে শুধু শিক্ষিত হলেই চলবে না, কিছুটা প্রযুক্তি শিক্ষাও থাকতে হবে। সাথে থাকতে হবে ইন্টারনেট কেনার মত আর্থিক সক্ষমতাও। তার মানে অনলাইনের পাঠক হচ্ছে, সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ। আশা করা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়, সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশের মাধ্যমটিতে সাংবাদিকতাও উৎকর্ষের চূড়া স্পর্শ করবে। কিন্তু আগেই যেমনটি বলেছি, ঘটনা ঘটছে উল্টো। সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর পাঠকদের মাধ্যম অনলাইনেই হচ্ছে সবচেয়ে অনগ্রসর সাংবাদিকতার চর্চা।
আপনি বাংলাদেশের কয়টি অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিউজ বিশ্বাস করেন? আচ্ছা প্রশ্নটা আরো সহজ করে দেই। আপনি বাংলাদেশের কয়টি অনলাইন নিউজ পোর্টালের নাম জানেন? ৫টা, বড় জোর ১০টা। আমি কিন্তু ১০টার বেশি পারবো না। কিন্তু বাংলাদেশে অনলাইন নিউজ পোর্টাল আছে কয়টি? এক হাজার, ৫ হাজার, ১০ হাজার। হা হা হা। স্কাই ইজ দ্যা লিমিট। একসময় বলা হতো, আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা। এখন বলতে হবে, আকাশের যত তারা, বাংলাদেশে তত অনলাইন। সরকার অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে বটে, তবে এখনও নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছে অনেক অনলাইন।
গণমাধ্যমের কাজ হলো মানুষকে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সরবরাহ করা। কিন্তু সাংবাদিকতার পাশেই শুয়ে থাকে অপসাংবাদিকতা। পত্রিকায় নিউজ ছাপিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় অনেক পুরোনো অভিযোগ। চাঁদা না পেলে সত্য মিথ্যা মিলিয়ে নিউজ ছাপিয়ে দেয়ার অভিযোগও কম নেই। সাংবাদিকতার নামে সেই চাঁদাবাজিটা করতে আগে অনেক কষ্ট করতে হতো। অন্তত পত্রিকা ছাপতে তো হতোই। অনলাইন আসার পর এখন সবকিছু জলবৎ তরলং। কারো বিরুদ্ধে যে কোনো একটা ডটকম’এ একটা নিউজ প্রকাশ করতে হবে। তারপর সেই নিউজের লিঙ্ক ফেসবুকে শেয়ার দিতে হবে, বন্ধু-বান্ধবদের দিয়ে শেয়ার দেয়াতে হবে। আরো বেশি প্রচার চাইলে অল্প কিছু টাকা দিয়ে বুস্ট করাতে হবে। ব্যস, আপনি যাকে ঘায়েল করতে চাইছেন, তিনি শেষ হয়ে যাবেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন শত শত লিঙ্ক ঘুরে বেরায়।
পত্রিকার সার্কুলেশন নির্ধারিত হয় বিক্রির ভিত্তিতে, পত্রিকার টিআরপি নির্ধারিত হয় দর্শক সংখ্যার ভিত্তিতে। আর অনলাইনের জনপ্রিয়তা মাপা হয় ক্লিকএর ভিত্তিতে। যত পাঠক ঐ লিঙ্কে ক্লিক করবে অনলাইন তত হিট। এই হিটের জন্য পাগলপারা সব অনলাইন। আর ক্লিক পেতে মরিয়া অনলাইনগুলো যা করে, তার সাথে সাংবাদিকতার দূরতম কোনো সম্পর্কও নেই। শিরোনামের সাথে কন্টেন্টের কোনো মিল নেই। কন্টেন্ট যা থাকে তা করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার নিয়ম-কানুন মানা হয় না। গোটা দশেক বাদ দিলে বাংলাদেশের অধিকাংশ অনলাইন নিউজ পোর্টালের কোনো মা-বাপ নেই। মা-বাপ নেই বলাটা বোধহয় ঠিক হলো না। আদরের সন্তানের নামের শেষে ২৪ডটকম জুড়ে দিলেই হয়ে গেল একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। মা প্রকাশক, বাবা সম্পাদক। ব্যস সাংবাদিক পরিবার। গাড়ির সামনে ’সংবাদপত্র’ লাগিয়ে ঘুরবেন, চাঁদাবাজি করবেন, মাস্তানি করবেন। সব জায়েজ। শত শত, হাজার হাজার অনলাইনের ভিড়ে সত্যিকারের সাংবাদিকতা করা গোটা দশেক অনলাইনের মান-সম্মান নিয়ে টিকে থাকাই মুশকিল। কোনটা ভুরুঙ্গামারি২৪ডটকম, কোনটা সারাবাংলাডটনেট, আর কোনটা বিডিনিউজ২৪ডটকম বোঝা দায়।
ইন্টারনেটের বিশাল জগতে ঘুরে বেড়ানো শত শত, হাজার হাজার লিঙ্কের কোনটা নিউজ, কোনটা ফেক তা যাচাই করতে পাঠককে রীতিমত গোয়েন্দা হতে হয়। এসব লিঙ্কের এমন চটকদার শিরোনাম, দেখলেই আপনার আঙ্গুল নিশপিশ করবে ক্লিক করতে। কিন্তু ক্লিক করে দেখবেন ভেতরে আসলে কিছু নেই। আর হাতে গোনা গোটা দশেক অনলাইন ছাড়া, বাংলাদেশের বাকি সব অনলাইন ক্লিকনির্ভর। তাদের চাই হিট, যে কোনো মূল্যে। আর এই হিটের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা।
এখন যারা অনলাইন সাংবাদিকতা করছেন, তাদের একই সঙ্গে দুটি কাজ করতে হবে। নিজেদের আরো ভালো সাংবাদিকতা করতে হবে এবং আবর্জনার বিরুদ্ধে লড়াইটা চালাতে হবে। সরকারকেও অনলাইনকে একটা জবাবদিহিতা ও শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। অনলাইন হোক ভালো এবং আধুনিক সাংবাদিকতার প্লাটফরম, ব্ল্যাকমেইলের নয়।
শুরুতে যেমনটি বলছিলাম, একটি অনলাইন করা সবচেয়ে সহজ। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন হলো, সেটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে পাঠকের কাছে উপস্থাপন। সারাবাংলাডটনেট গত পাঁচবছর ধরে সেই কঠিন কাজটাই করে আসছে। সারাবাংলার সাথে আমার সম্পর্কটা ঠিক পাঁবচছরের। প্রথম দিনেই আমার কলাম প্রকাশি হয়েছিল সারাবাংলায়। নিয়মিত-অনিয়মিতভাবে পাঁচবছর ধরে সারাবাংলা ফলো করছি। সারাবাংলা কখনো ক্লিকের পেছনে ছোটেনি। তাই তারা শীর্ষেও উঠতে পারেনি হয়তো। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে অর্জন পাঠকের বিশ্বাসযোগ্যতা, সেটা তারা পেয়েছে ষোলোআনাই। সামনের পথটা আরো কঠিন। পাঠকের আস্থা ও বিশ্বাস ধরে রেখেই পাড়ি দিতে হবে বন্ধুর পথ।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি