জিতেছে সবাই: খেলিছে কে?
১১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৩:২২
দশ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে বাংলাদেশে বাজিমাত, জয়ে জয়কার। সবাই জয়ী। কেই পরাজিত হননি। রাজধানীর পূর্বপ্রান্তে গরুর হাট বসা গোলাপবাগ মাঠও জিতেছে। পেয়েছে ঐতিহাসিক মর্যাদা। সমাবেশকারীরা জিতেছেন। নয়াপল্টন থেকে দাবড়িয়ে নানান জায়গা দেখিয়ে শেষতক তাদের ওই মাঠে নিয়ে ঠেকাতে পারা ক্ষমতাবানরাও জিতেছেন। সিংহবিক্রমে পুলিশ তো জিতেছেই। কী অসাধ্যটাই না সাধন করে দিতে পেরেছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিনটিতে নতুন করে ৯টি দেশের ৪০ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ স্যাংশন তালিকায় এবার এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নেই, যা ছিল গত বছর। অতএব মানবাধিকারের রেটিংয়েও বাংলাদেশ জিতে গেছে। রাস্তাঘাট বন্ধ করে সমাবেশ করে মানবাধিকার রক্ষা করা হয়েছে। টানা কয়েকদিন নয়াপল্টনসহ আশপাশ অবরুদ্ধ রেখে সমাবেশ করতে না দিয়ে মানুষকে দুর্ভোগ ও আতঙ্কের আজাব দিয়েও মানবাধিকারকে জয়ী করা হয়েছে।
এ দেশে এখন আর কেউ হারে না। তাই তলে চাপা পড়া ব্যক্তিও যুক্তিতে জিতে গেছেন। নীচ থেকে আরামে চাঁদ-সুরুজ এনজয় করেছেন। এছাড়া তিনি উপরের জনকে প্রচুর খামচি মেরেছেন।
১০ ডিসেম্বর সামনে রেখে আটকের ঘন্টা কয়েক আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মন্তব্য ছিল: দশ তারিখে এমন কিছু ঘটবে যা ভাবনার বাইরে। সরকারের দাবি ছিল, এগুলো বিএনপি নেতাদের কথার কথা। তর্জন-গর্জন। তেমন কিছু তো ঘটেইনি, উপরন্তু ফখরুল-আব্বাসদের জেলে যেতে হয়েছে। অতএব ফখরুলরাই হেরেছে। আর জিতেছে সরকার। কিছু রক্তারক্তি, ধরপাকড়, জনভোগান্তি, দেশকে যুদ্ধের দশায় নিয়ে আসা এগুলো কোনো বিষয়ই নয়। মানে বিএনপি শেষ। এর বিপরীতে নয়াপল্টনে না হলেও টিকাটুলি-গোপীবাগ পেরিয়ে গোলাপবাগে মাত্র কয়েক ঘন্টার প্রস্তুতিতে বিশাল জমায়েত ঘটানো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলে জয়ের সুখটান ছাড়ছে বিএনপি।
বাংলাদেশে জয়-পরাজয় মূল্যায়ন ও ইতিহাস এখন এ তলানিতেই নেমে এসেছে। ফকিরাপুল বাজার বা কাঁঠালবাগান ঢালও ঐতিহাসিক। কক্সবাজারের বদি থেকে ভুরুঙ্গামারির আবুল, কুড়িগ্রামের মদনও ঐতিহাসিক। ইতিহাসের বাইরে কে? সুখ-দু:খও আপেক্ষিক। জয়-পরাজয়ও আপেক্ষিক। সবই যার যার জুইত মতো। একেক জনের এক এক ব্যাখ্যা। গত ৮/৯ ডিসেম্বর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশে অঘোষিত পরিবহণ ধর্মঘট, তল্লাশিসহ পুলিশের উৎপাতে কারো মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়নি। এটি জননিরাপত্তা রক্ষা। পথচারীদের আটকে তার মোবাইলের কল লিস্ট, চ্যাটিং, গ্যালারি চেক করলেও কারো প্রাইভেসি নষ্ট হয় না। পুলিশের পাশাপাশি কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও তল্লাশি কর্মে শামিল হয়েছেন। বিরক্তি-ক্ষোভ থাকলেও তল্লাশির নামে এমন নাজেহাল সহ্য করাই নিয়তি। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার এ হালত সামনে আরো কোথায় গড়াবে কে জানে?
এ প্রশ্ন করায়ও ভয় আছে। মারাত্মক সব বুদ্ধিমানের কিলবিল চারদিকে। আওয়ামী লীগের কথায় একমত না হলেই আমি বিএনপি-জামায়াত। আবার বিএনপি-জামায়াতের কথায় একমত না হলেই আমি আওয়ামী লীগার। এই বুদ্ধিবিবেকদের কাছে পৃথিবীতে এর বাইরে আর কিছু নেই।
এমন গড়পড়তা বিচার পেশাদার লেখক-কলামিস্টদের জন্য চরম কষ্টের। ঝুঁকিরও। তারওপর এমন গড়ে হরিবলের ধুমে চলছে আচানক নিরাপত্তা সেবা ও জয়ের খেলা। এর খেলোয়াড় বা রেফারি কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। দেশকে একটা বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ রাখছে রাজনীতিকরা। তাদের কাছে ক্ষমতাই মূখ্য, যদিও তারা এর নাম দেয় ’গনতন্ত্র’, ‘মানুষের অধিকার’। কিন্তু ক্ষমতা দখলের বাইরে তাদের আর কোনো ভাবনা নেই।
ক্ষমতায় যেতে পারলে সেটি যে কোনো ভাবে আগলে রাখা- এই বৃত্তের বাইরে দেশের রাজনীতির আর কী কোনো ভাবনা আছে! নিজেদের বুদ্ধিজীবী ভাবাপন্নদের অধিকাংশও এই দুই চিন্তার রাজনীতিকদের হয়েই ভাবেন, নিজেদের মতো করে আলাদা কিছু ভাবতে পারেন না। দেশ- মানুষ- তাদের কাছে গুরুত্বহীন। স্বার্থপরতার কলুষিত এই রাজনীতি থেকে মুক্তির আশা করারও স্বাধীনতা থাকতে নেই?
এ কাঠিন্যের জের ভালো হয় না। তারওপর কথায় কথায় বিদেশিদের কাছে নালিশ নিয়ে ছুটে যাওয়া, তাদের আমন্ত্রণ করে অতিথি সেবা দেওয়া, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের অবিরাম উদ্বেগ, তাদের তাচ্ছিল্য করে মন্ত্রীদের বাঙালিপনা মন্তব্য চলছে হরদম। নয়াপল্টন ঘটনা আন্তর্জাতিক গুরুত্ব এনে দিয়েছে। আবার নয়াপল্টনই শেষ নয়। গোলাপবাগ নয়াপল্টন থেকে বেশি দূরেও নয়। আর্জেন্টিনার জার্সি পরে গুলি ছোঁড়ার বীরত্বেরও জের থাকে। এগুলো ভালো বার্তা দিচ্ছে না। সামর্থ্য নিয়ে বাহাদুরি, মনিচ্ছা মতো জয় আবিস্কার কঠিন কাজ নয়। দুর্বল দলের সামর্থ নিয়ে বেশি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য আবার সেই দলটির এক কর্মসূচিতেই খালি পেটে সুগার ১৬-১৭তে উঠে যাওয়া কিডনিতে গোলমালের বার্তা দেয়। ভয় দিয়ে জয় হাতানো দীর্ঘদিন সম্ভব না হওয়ার ইতিহাস বিশ্বে ভুরি ভুরি। তা অবিরাম সম্ভব হলে আজকের দৌড় খাওয়া বিএনপিও এতোদিন ক্ষমতায়ই থাকতো। পেরেছে থাকতে?
তার চেয়ে বড় কথা সমাবেশ, সংঘর্ষ আর আতঙ্কের এমন ডিসেম্বর সাম্প্রতিককালে কখনো দেখেনি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জন্য ডিসেম্বর মাসটা বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা আর ১৯৮০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও বিজয় এনেছিল ছাত্রজনতা। কিন্তু বেদনার সঙ্গেই বলতে হয় দুটো বিজয়ই হাতছাড়া হয়ে গেছে সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে। গণতন্ত্র যেন এখনো অধরাই রয়ে গেল। এবারের ডিসেম্বর এসেছে আতঙ্ক আর উত্তেজনা নিয়ে। শেষ কী দিয়ে হবে- সেই তাড়না অনেকের। এর মূল্যটাই বা কতো? শোদ দেবে কে?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি