ফুটবল সমর্থনের হৃদ্যতা থেকে কূটনৈতিক মৈত্রী
২৩ ডিসেম্বর ২০২২ ১৪:০১
খবরটি পুরনো। সবাই জানেন। ১১ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার পররাস্ট্রমন্ত্রী সান্তিয়াগো ক্যাফিয়েরো বাংলাদেশে দূতাবাস খোলার ঘোষণা দেন। খবরটি জানিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দক্ষিণ আটলান্টিকের সংবাদ সংস্থা মেরকোপ্রেস। তারা জানায় “কাতার ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২-এ খেলা লিওনেল মেসি ও আর্জেন্টিনা দলের প্রতি বাংলাদেশের প্রশ্নাতীত সমর্থনের কারণেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
সবশেষ খবর- ঢাকাতে দূতাবাস স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো অ্যাঞ্জেল ফার্নান্দেজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা এক চিঠিতে এই ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ২২ ডিসেম্বর ভোরে ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। চিঠিতে আলবার্তো বলেছেন, ২০২৩ সালে ঢাকায় আর্জেন্টিনার দূতাবাস স্থাপনের মাধ্যমে দুই দেশের জনগণ ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির দৃঢ়বন্ধনে আবদ্ধ হবে বলে মনে করেন তিনি।
আর্জেন্টিনার এই কূটনৈতিক উদ্যোগের নেপথ্যের পটভুমি সবারই জানা। বাংলাদেশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার ফুটবলের অগণিত ভক্ত রয়েছে অনেক আগে থেকেই। তাদের উন্মাদনার কথা এতদিন তেমনভাবে জানতো না পৃথীবি। জানতো না আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের মানুষজন। কাতার বিশ্বকাপের সময় এটি বিশ্বের নজর কাড়ে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে মেসির গোলে উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশি সমর্থকদের উল্লাস করার একটি ভিডিও ফিফার অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে পোস্ট করার পর। পোস্টটি দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায় এবং ইন্টারনেটে ট্রেন্ডিংয়ে পরিণত হয়। এটি দৃষ্টি কাড়ে আর্জেন্টিনা মিডিয়ার। পরে, আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের অফিসিয়াল পেইজে বাংলাদেশ সম্পর্কে টুইট করা হয়- “থ্যাংক ইউ ফর সাপোর্টিং আওয়ার টিম!!! দে আর ক্রেজি লাইক আস।” (আমাদের দলকে সমর্থন করার জন্য তোমাদের ধন্যবাদ!! ওরাও আমাদের মতো পাগল!
আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনও ধন্যবাদ জানায়। বিশ্বকাপে সংবাদ সম্মেলনে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচ লিওনেল স্কালোনিও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানান বাংলাদেশের মানুষকে। মেসির স্ত্রী, আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা তাদের পেইজগুলোতে ধন্যবাদ জানান বাংলাদেশকে। আর্জেন্টিনার প্রতিটি টিভি চ্যানেলে, প্রিন্ট মিডিয়ায় একের পর এক বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা সমর্থকদের কর্মকান্ড এবং বাংলাদেশ নিয়ে ব্যাপক প্রচারিত হয়।ফলে আর্জেন্টিনার ঘরে ঘরে বাংলাদেশের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগ দেন আর্জেন্টাইনরাও। আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের প্রতি বাংলাদেশের অন্তহীন ভালোবাসার কৃতজ্ঞতা হিসেবে, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের জন্য একটি আর্জেন্টিনা ফ্যান গ্রুপ তৈরি করা হয় ফেসবুকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের খবর ধেয়া হয় তাতে। ভারতের বিরুদ্ধে ওয়ান ডে ম্যাচে জয়ের পর লেখা হয় শক্তিশালী ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের জয়। তারা বাংলাদেশের জয় নয় লিখেছে আমাদের জয়। আর্জেন্টাইনরা বলছে বাংলাদেশ আর্জেন্টিনা আমরা ভাই ভাই।
বিশ্বকাপ জয়ের পর আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের পক্ষ থেকে সমর্থনের জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। ধন্যবাদ জানিয়েছেন মেসির মা, স্ত্রী, ভাই। ফাইনালের পর তারা ও মেসির ছেলেরা মিডিয়ার সামনে বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে শ্লোগান দিয়েছেন।
আর্জেন্টিনার জেতা বিশ্বকাপটি বাংলাদেশে আনতে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনকে প্রস্তাব দেয়ার কথা ভাবছে বাংলাদেশ। কিন্তু এরই মধ্যে হাজার হাজার আর্জেন্টাইন তাদের ফেডারেশনকে বলেছে কাপটি বাংলাদেশ থেকে ঘুরিয়ে আনার জন্য।
ফুটবল সমর্থনের মধ্য দিয়ে দুই দেশের জনগণের মধ্যে গড়ে উঠা এই সম্প্রতিকে অন্যতর উচ্চতায় নিয়ে গেছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একটি চিঠি। ১৯ ডিসেম্বর, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো অ্যাঞ্জেল ফার্নান্দেজকে লেখা চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ও আমার নিজের পক্ষ থেকে আর্জেন্টিনার ফুটবলের দুর্দান্ত জয়ে আপনাকে ও আর্জেন্টিনা প্রজাতন্ত্রের বন্ধুত্বপূর্ণ জনগণকে এবং ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপ জয়ী দলকে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন। আন্তরিক অভিনন্দন জানাতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন – ফুটবলের প্রতি স্নেহ ও ভালোবাসা, বিশেষ করে আর্জেন্টিনা ফুটবল দল, দুই দেশের মানুষকে গভীরভাবে সংযুক্ত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনার জাতীয় ফুটবল দলের বিশ্বকাপ ফুটবল জয়ের স্বতঃস্ফূর্ত উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রশংসা ও ভালোবাসার পরিচয় দিয়েছে।’ বলেন- দুই দেশের ফুটবলপ্রেমী জনগণের মধ্যে অভূতপূর্ব ভালোবাসা ও স্নেহ দৃঢ় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পথ প্রশস্ত করেছে। তিনি আগামী দিনে একে অপরের রাজধানীতে মিশন খোলার মাধ্যমে সম্পর্ককে আরো সুসংহত করার আশা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছাবার্তার জবাবে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। বলেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের প্রাণোচ্ছল উদ্যাপন আর্জেন্টিনার জনগণ ও তাঁকে অভিভূত করেছে। প্রেসিডেন্ট আলবার্তো বলেন, খেলাধুলা মানুষের মধ্যে বন্ধন-সম্প্রীতি বৃদ্ধির একটি অর্থবহ ও শক্তিশালী মাধ্যম। ব্রাজিলে বাংলাদেশের দুতাবাসে পাঠানো সেই চিঠিতে ঢাকায় দূতাবাস খোলার ঘোষণা দেন তিনি।
বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা জয়ের পর দুই দেশের সরকার প্রধানের এই শুভেচ্ছা বার্তা বিনিময় একটি ইতিবাচক ব্যাপার। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টের ঢাকায় দূতাবাস খোলার ঘোষণা দক্ষিণ আমেরিকায় বাংলাদেশের একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য।
ঢাকায় আর্জেন্টিনার দূতাবাস চালু হলে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়েসহ দক্ষিণ আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল মারকোসারভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও রপ্তানি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। মারকোসারভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ওষুধ, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক ও তৈরি পোশাক আমদানি করতে পারে। পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে আর্জেন্টিনার উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে আর্জেন্টিনার বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে আগে থেকেই। এটা একতরফা আর্জেন্টিনার অনুকূলে। ২০২১ সালে, আর্জেন্টিনা বাংলাদেশে ৮৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। যার বেশিরভাগ গম, ভুট্টা ও সয়াবিন তেল। বাংলাদেশ আর্জেন্টিনায় রপ্তানি করেছে মাত্র ১৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। সম্পর্কের নতুন প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য সংকট হলে দেশটি থেকে বাংলাদেশের জন্য সয়াবিন তেল, গম, ভুট্টা আমদানি সহজতর হবে। একই সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য জোট মারকোসারের বাজারে বাংলাদেশের প্রবেশ বেগবান হবে।
এরই মধ্যে ভারতে আর্জেন্টিনার দূতাবাস ( যারা বাংলাদেশেও আর্জেন্টিনার কূটনৈতিক সম্পর্ক দেখে) এর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য বিভাগের প্রধান ফ্রাঙ্কো অগাস্টিন সেনিলিয়ানি মেলচিওর জানিয়েছেন, এশিয়া থেকে অনেক পরিমাণে টেক্সটাইল পণ্য আমদানি করে আর্জেন্টিনা। এ জন্য বাংলাদেশ বস্ত্র ও প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানির জন্য আর্জেন্টিনাকে সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।
দূতাবাসের কৃষিবিষয়ক অ্যাটাশে মারিয়ানো বেহেরান জানিয়েছেন, আর্জেন্টিনা থেকে তুলা, গুঁড়া দুধ, রসুন আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। পাশাপাশি বাংলাদেশের কৃষি খাতের সক্ষমতা বাড়াতে কৃষিপ্রযুক্তি সরবরাহ করতে পারে আর্জেন্টিনা। তিনি আরো জানিয়েছেন বাংলাদেশে সয়াবিন, গরুর মাংস ও সার রপ্তানির জন্য প্রস্তুত আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশ সয়াবিন তৈল, সার ও তুলা বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে আমদানি করে। নতুন করে বড় সোর্স কান্ট্রি হতে পারে আর্জেন্টিনা। বিশ্বে গরুর মাংসের বড় এক রপ্তানিকারক দেশ আর্জেন্টিনা। ইউরোপেগুরুর মাংসের বিশাল বাজার রয়েছে তাদের।
ফুটবল সমর্থনের হৃদ্যতায় গড়ে উঠা দুই দেশের জনগণের আন্তরিক মৈত্রী ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনার মধ্যে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচন করছে। শুধু বাণিজ্য ও অর্থনীতিই নয় পর্যটন, ফুটবল ও ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও সহযোগিতার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দুই দেশের সরকার প্রধানের শুভেচ্ছা পত্র বিনিময় ও আগ্রহের মধ্য দিয়ে সেটি ভিন্নতর মাত্রা পেয়েছে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এজেডএস