মেট্রোরেল: স্মার্ট গণপরিবহনের ক্ষেত্রে অনন্য মাইলফলক
২৮ ডিসেম্বর ২০২২ ১৪:২৭
মেট্রোরেল বাংলাদেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচিত হলো। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, উড়ালসেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অসংখ্য নির্মান কার্য যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। এবার মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। স্বপ্নের পদ্মাসেতুর পর নতুন বিস্ময় মেট্রোরেল।
২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে স্বপ্নের মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু হলো। তিনিই হলেন মেট্রোরেলের প্রথম যাত্রী। প্রথম যাত্রী হিসেবে টিকিট কেটে মেট্রোরেলে উঠলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। প্রথম পর্যায়ে উত্তরার দিয়া বাড়ি থেকে মেট্রোরেল যাবে আগারগাঁও পর্যন্ত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগেই মেট্রোরেলের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ কমিটিতে (একনেক) পাশ হয় ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প বা মেট্রোরেল। সরকার মেট্রোরেলের পরিকল্পনা, সার্ভে, ডিজাইন, অর্থায়ন, নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২০১৩ সালে ঢাকা র্যাপিড কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম পর্যায়ে নির্মানের জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১০ কিলোমিটার এমআরটি -৬ পথ নির্ধারণ করা হয়। ২০১৬ সালের ২৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম উড়াল সড়ক এমআরটি-৬ কাজের উদ্বোধন করেন। মাত্র ছয় বছরে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার জনগণের চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হলো।
উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার পথে উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ী), উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও এই নয়টি স্টেশন আছে। স্টেশন গুলোতে লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা যাবে। তিনতলা স্টেশনের দ্বিতীয় তলায় টিকিট কাউন্টার। তৃতীয় তলায় প্লাটফরম, সেখানে শুধু টিকিটধারী ব্যক্তিরাই যেতে পারবেন। মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ টাকা। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ভাড়া ৬০ টাকা। সাপ্তাহিক, মাসিক ও পারিবারিক টিকিট আগে থেকেই কেনা যাবে। যারা স্মার্ট কার্ডে ভাড়া পরিশোধ করবে তাদেরকে ১০ শতাংশ ছাড় দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ছয় বগির ট্রেনটিতে একটি বগি নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এছাড়া অন্য বগি গুলোতেও নারীরা উঠতে পারবেন। গর্ভবতী নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য আসন সংরক্ষিত করা আছে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা বিনা ভাড়ায় ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিরা প্রতিবার বিশেষ ছাড়ে ভ্রমণ করতে পারবেন।
মেট্রোরেলে চলাচলের জন্য টিকিট কাটার দু’টি পদ্ধতি আছে। (এক) সিঙ্গেল জার্নি টিকিট (দুই) এমআরটি পাস। টিকিট অপারেশন মেশিন (টিওএম) থেকে টিকিট বিক্রয়কারীর সহায়তায় সিঙ্গেল জার্নি টিকিট এবং এমআরটি পাশ কেনা যাবে। টিকিট ভেন্ডিং মেশিন (টিভিএম) থেকে যাত্রীরা নিজে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সিঙ্গেল জার্নি টিকিট এবং এমআরটি পাস রিচার্জ করতে পারবেন। মোবাইল ও ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন্সের মাধ্যমেও এমআরটি পাস রিচার্জ করা যাবে।
যানজটের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। কর্মঘন্টার মূল্য বিবেচনায় ক্ষতির পরিমান ব্যাপক আকার ধারণ করে যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ২০১৮ সালে বুয়েট পরিচালিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে যানজটের জন্য বার্ষিক ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলেছে, যানজট বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫ শতাংশ ক্ষতি করেছে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৮৭ হাজার কোটি। মেট্রোরেল-৬ পুরোপুরি চালু হলে ক্ষতির পরিমান ২০ শতাংশ কমে আসবে এবং আগারগাঁও পর্যন্ত চালু হওয়ার কারণেও ক্ষতি ৯ শতাংশ কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মেট্রোরেলের ইতিহাসের সাথে নাম দুইজন নারীর নাম লেখা হয়ে গিয়েছে। একজন প্রথম দিনের চালক নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারয়ে স্নাতকোত্তর মরিয়ম আফিজা আরেকজন তিতুমীর কলেজ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক করা আসমা আক্তার স্টেশন কন্ট্রোলার। মেট্রোরেল স্টেশন থেকে ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয় করবেন স্টেশন কন্ট্রোলার। মেট্রোরেল চলাচল, স্টেশনে থামা, কোথায় কত গতিতে চলবে এর পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করা হবে একটি সসফটওয়্যারের মাধ্যমে উত্তরার দিয়াবাড়ি অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার থেকে। এই দুই নারীর হাত ধরেই শুরু হয়েছে মেট্রোরেলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা।
সরকারের মূল লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা মহানগরীর যানজট সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনা। এজন্যই ৬ টি রুটে ১২৮ কিলোমিটার মেট্রোরেল চলাচলের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যার প্রথম যাত্রা শুরু হলো। সময়ের সাথে সাথে রাজধানীর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জেলার গুলোর শহর কিংবা উপশহরে মেট্রোরেল সেবা সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা নিযেছে সরকার। শুরুতে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার কিছু জায়গাকে অগ্রাধিকার দিয়ে তালিকা করা হয়েছে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলার সঙ্গেও সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা রযেছে। প্রথম ধাপের কাজ শেষ হলে গাজীপুর চৌরাস্তা, সাভারের বাইপাইল, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও বরপা, কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের নির্মান কাজ শুরু হবে। এ গুলো শেষ হলে মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য আড়াইশ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে ঢাকার আশেপাশের জেলা গুলোর বিভিন্ন মেট্রোরেলের আওতায় আনা।
মেট্রোরেল যাতায়াতে নতুন মাত্রা যোগ করবে ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) হাব। যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন সহ উন্নত দেশের মতো মেট্রো স্টেশন সংলগ্ন টিওডিকে থাকবে বহুতল বিশিষ্ট পার্কিং ব্যবস্থা। তখন ব্যক্তিগত গাড়ি রেখে যাত্রীরা মেট্রোতে ভ্রমণ করতে পারবেন। এতে শহরে গাড়ির চাপ কমবে। টিওডিতে থাকবে বিপণিবিতান, হোটেল, বিনোদন কেন্দ্রসহ বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এসব বিষয় মাথায় রেখেই প্রাথমিক ভাবে উত্তরা ও গাবতলীতে দুইটি টিওডি নির্মাণের কাজ চলছে। পর্যায় ক্রমে প্রতিটি বড় স্টেশনেই টিওডি তৈরি করা হবে।
ঢাকা শহরের অন্যতম প্রধান সমস্যা যানজট। প্রতিদিন ভয়াবহ যানজটে লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মঘণ্টা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অসহনীয় যানজটে শুধু মানুষেরই দুর্ভোগ হচ্ছে তা নয়, বরং দেশের অর্থনীতিকেও মারাত্মক ক্ষতি করছে। যানজট নিরসনে বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা অতি জরুরী হয়ে পড়ে। মেট্রোরেল এ ক্ষেত্রে জনগণকে যানজট থেকে স্বস্তি দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে। পুরোপুরিভাবে মেট্রোরেল চালু হয়ে গেলে মানুষের চলাচলে ভোগান্তি কমবে। শুধু সময় কমবেই না, যোগাযোগ ব্যয়ও সাশ্রয়ী হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে স্মার্ট যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকল্প নেই। সে লক্ষ্যেই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। মেট্রোরেল নিঃসন্দেহে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের অন্যতম বড় সাফল্য।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
তাপস হালদার মত-দ্বিমত মেট্রোরেল: স্মার্ট গণপরিবহনের ক্ষেত্রে অনন্য মাইলফলক