প্রাণের উৎসব— বই উৎসব
১ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:১৩
বছরের প্রথম দিন- বই উৎসব। বাংলাদেশের স্কুল শিক্ষার্থীদের অনন্য এক উৎসব। নতুন নতুন বই হাতে শিশুরা মেতে উঠে আনন্দে। নতুন বইয়ের মৌ মৌ গন্ধে তাদের স্বপ্নেও ছড়ায় নতুন রং। এমন উৎসব অন্য কোন দেশে কি আছে? প্রতি বছর প্রায় সোয়া চার কোটি শিক্ষার্থীকে সাড়ে ৩৫ কোটিরও বেশি নতুন বই বিনামূল্যে কি দেয়া হয় অন্য কোন দেশে?
আমাদের সময়ে এ উৎসব ছিল না। তখন বাজারে নতুন বই আসতে আসতে মার্চ মাস পেরিয়ে জুনও হয়ে যেতো। উপরের শ্রেনির পরিচিত কারোর কাছ থেকে অথবা আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ছেড়া বিবর্ণ বই এনে পড়তে হতো। অনেকেই নতুন বই কিনতে পারতো না। পুরনো বই-ই পড়তে হতো। কারণ নতুন কেনার সামর্থ্য তাদের ছিল না। এসব দৈন্যতা, সীমাবদ্ধতা শিক্ষাক্ষেত্রের প্রতিবন্ধকতা এখন ফেলে আসা দিনের ইতিহাস। বছরের প্রথম দিনেই এখন স্কুলের শিশুদের কাছে দারুণ উপহার হয়ে আসে নতুন বই।
বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যদিয়ে এই ‘বই উৎসব’ পালন করা হয়। আমরা প্রতিবছরই নানান উৎসব পালন করি। বৈশিষ্ঠ্য, ইতিহাস, গণমানুষের সম্পৃক্ততার মাত্রায় এগুলো সামাজিক উৎসব, ধর্মীয় উৎসব, জাতীয় উৎসব এবং প্রাণের উৎসব হিসেবে পরিচিত। বাঙ্গালীর প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ, একুশে বই মেলা। বই উৎসবও এখন প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। বই উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে কোটি কোটি স্কুল শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাকর্মী, শিক্ষাবিদ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা, নতুন আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। এটি শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষাবিদ-লেখক-জনপ্রতিনিধি-প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-জাতীয় প্রকাশনা-মুদ্রণ-সংশ্লিষ্ট সবার এক ধরণের সম্মিলন। সম্মিলিত শিক্ষা বিপ্লব।
এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নতুন বছরের ১ জানুয়ারি আসার অনেক আগে থেকেই স্কুলের শিশুরা নতুন বই নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কখন পাবে নতুন বই, কখন পাবে নতুন বই — এই অধীর প্রতিক্ষায় সময় কাটে তাদের। ‘নতুন বছর নতুন দিন, নতুন বইয়ে হোক রঙ্গিন’, ‘নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে ফুলের মতো ফুটবো, বর্ণমালার গরব নিয়ে আকাশজুড়ে উঠব’ নানান প্রেরণাদায়ী শ্লোগানে শিশুদের, স্কুল পড়ুয়াদের কাছে অনন্য হয়ে উঠে এ উৎসব। বাংলাদেশ কোন সমাজতান্ত্রিক রাস্ট্র নয় কিন্তু এই অয়োজনের মধ্যদিয়ে সরকারের কল্যাণমুখী রাস্ট্র বিনির্মাণের প্রচেষ্টাটি ফুটে উঠে। ইতোমধ্যেই বিশ্বের প্রশংসা অর্জন করেছে বিনামূল্যে প্রতিটি স্কুল শিক্ষার্থীকে বই দেয়ার সরকারের এই জনকল্যাণকর উদ্যোগটি। বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, জাইকা, ইউনিসেফ, জাতিসংঘ বাংলাদেশের সব উন্নয়ন সহযোগী সরকারের এই বিশাল উদ্যোগ ও তার সফল বাস্তবায়ন দেখে বিষ্মিত।
আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সাল থেকেই প্রাক প্রাথমিক, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের সব মাধ্যমের শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে নতুন বই দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ২০১২ সালে শুরু হয় নতুন উৎসব- বই উৎসব। প্রতিবছর প্রধানমন্ত্রী শিশুদের হাতে বই তুলে দিয়ে বই উৎসবের উদ্বোধন করেন। এরপরই দেশ জুড়ে বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালিত হয় বই উৎসব। স্কুলে স্কুলে উৎসবের মধ্য দিয়ে শিশুদের হাতে নতুন বই তুলে দেয়া হয়। বিশ্বে এটি এক নজীর বিহীন ঘটনা। এ জন্য প্রতিবছর সরকারের খরচ হয় ১ হাজার কোটিরও বেশি টাকা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা ন্যাশনাল কারিকুলাম এন্ড টেক্সটবুক বোর্ড(এনসিটিবি) এবং দুই – মন্ত্রণালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এই বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করে। ২০১০ থেকে ২০২২ এই ১৩ বছরে প্রায় ৪৩৫ কোটি ২৪ লক্ষ্ ৯০ হাজার বই বিনামূল্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দেয়া হয়েছে। ২০২৩ সালেও সোয়া সাড়ে চার কোটিরও বেশি শিশুর হাতে দেয়া হচ্ছে ৩৫ কোটি ৭০ লক্ষ বই। সব ধারার অর্থাৎ বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি ভার্সন, মাদ্রাসার তিন ধারা,দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি, বিদেশের বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী সবাইকেই দেয়া হয় বিনা মূল্যের এই বই।
এনসিটিবির তথ্য অনুযায়ী
*২০১০ সালে প্রাথমিক (বাংলা ও ইংরেজী ভার্সন), মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজী ভার্সন), ইবতেদায়ি, দাখিল ও দাখিল (ভোকেশনাল), এসএসসি (ভোকেশনাল) এর মোট ২ কোটি ৭৬ লাখ ৬২ হাজার ৫২৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিতরণ করা হয় ১৯ কোটি ৯০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬১টি বই।
* ২০১১ সালে ৩ কোটি ২২ লাখ ৩৬ হাজার ৩২১ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ২৩ কোটি ২২ লাখ ২১ হাজার ২৩৪টি বই। *২০১২ সালের মোট ৩ কোটি ১২ লাখ ১৩ হাজার ৭৫৯ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ২২ কোটি ১০ লাখ ৬৮ হাজার ৩৩৩টি বই। * ২০১৩ সালে ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৮৬ হাজার ১৭২ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ২৬ কোটি ১৮ লাখ ৯ হাজার ১০৬টি বই। *২০১৪ সালে ৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫৩ হাজার ২০১ জন শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ৩১ কোটি ৭৮ লাখ ১২ হাজার ৯৬৬টি বই। * ২০১৫ সালে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৫২ হাজার ৩৭৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে বিতরণ করা হয় ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৩টি বই। * ২০১৬ সালে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৭২৮ শিক্ষার্থী বিনামূল্যে বই পায় ৩৩ কেটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৬০টি।
* ২০১৭ সালে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে । এ বছরই প্রথমবারের মতো অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচীতে যুক্ত করা হয় প্রাক-প্রাথমিক, প্রাক-প্রাথমিক (৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায়: মারমা, চাকমা, গারো, সাদ্রি ও ত্রিপুরা), এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল (ট্রেড বই), দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক নির্দেশিকা (প্রাথমিক) শিক্ষক শিক্ষাক্রম নির্দেশিকা (মাধ্যমিক)। ফলে ওই বছর শিক্ষার্থীদের সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে বিতরণকৃত বইয়ের সংখ্যাও। মোট ৪ কোটি ২৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯২৯ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি বই।
*একই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে ৪ কোটি ২৬ লাখ ৯৮ হাজার ৬৬৩ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই দেয়া হয় ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি। * ২০১৯ সালে ৪ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২টি বই। * ২০২০ সালে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হয় ৬ষ্ঠ শ্রেণীর জন্য সম্পূরক কৃষি শিক্ষা বইটি। ওই বছর ৪ কোটি ২৭ লাখ ৭২ হাজার ৭৪৭ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ৩৫ কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৭টি বই।
এর পরপরই অতিমারী করোনার সর্বব্যাপী আক্রমণে বিপর্য়স্ত হয়ে পড়ে পুরো পৃথীবি। জীবন বাঁচানো নিয়ে শংকা দেখা দেয় বিশ্বজুড়ে। লকডাউন-শাটডাউনে স্থবির হয়ে পরে বিশ্ব। কিন্তু এই বিপর্যস্ত পরিস্থিতেও বাংলাদেশে চলমান থাকে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে বিতরণের জন্য বই ছাপার কাজ। তবে এ সময় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যায়। ফলে কমে ছাপানোর বইয়ের সংখ্যাও। ২০২১ সালে মোট ১ কোটি ৮৫ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫৩ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে দেয়া হয় ২৪ কোটি ১০ লাখ ৭৯ হাজার ৮৫৭টি বই।
* ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে ২০২২ সালেও পৃথীবির অর্থনীতি ছিল বিপর্যস্ত। ডলার সংকট,আমদানী জটিলতা, কাগজ ও মুদ্রণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বিনামূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচী অব্যাহত রাখে সরকার। এ বছর মোট ৪ কোটি ১৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৫৬ শিক্ষার্থীকে ৩৪ কোটি ৭০ লাখ ২২ হাজার ১৩০টি বই পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্কুল শিক্ষা শিক্ষাক্রমে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হচ্ছে এবছর। চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। আধুনিক ও যুগোপযোগী করা হচ্ছে দেশের শিক্ষাক্রম। এ বছর প্রথম ও দ্বিতীয় এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেনিতে চালু হচ্ছে নতুন পাঠ্যসূচি। ২০২২ সালে ৬২ টি স্কুলে এর পাইলটিং হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন পাঠ্যসূচির আলোকে বই পাচ্ছে। নতুন পাঠ্যসূচিতে তাত্ত্বিক জ্ঞানের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের পারদর্শিতার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। মুখস্থ নির্ভর পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। এজন্য চার শ্রেণির জন্য সম্পূর্ণ নতুন পাঠ্যসুচির বই ছাপানো হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর রুপকল্প- ডিজিটাল বাংলাদেশ এরই মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। নতুন রুপকল্প-২০৪১, স্মার্ট বাংলাদেশ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এজন্য যে ধরণের জনশক্তি গড়ে তোলার দরকার তারই আলোকে নতুন শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম চালু করা হয়েছে এবছর। আর সেই জনশক্তি তৈরির সূচনা ক্ষেত্র স্কুলের প্রতিষ্ঠানগুলো। এখানে শতভাগ শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে সরকার। বই উৎসব-বিনামূল্যে বই বিতরণ সেই মহাপরিকল্পনার একটি বড় উদ্যোগ।
২০১০ সালের আগে প্রাথমিক স্তরে অর্ধেক বই বিনা মূল্যে দেওয়া হতো। বাকি বই কিনে পড়তে হতো। আর মাধ্যমিক স্তরে সব বই কিনতে হতো। কখনো কখনো সব শিক্ষার্থীর বই পেতে জুন পর্যন্ত সময় লেগে যেত। অনেকে সামর্থ্যের অভাবে কিনতেও পারত না। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি হতো। অসংখ্য শিক্ষার্থী ঝরে পড়ত। এখন সবাইকে বই উৎসবের মধ্য দিয়ে সব শিশুকে একসঙ্গে বিনা মূল্যে বই দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য যেমন কমছে, তেমনি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক—দুই স্তরে বিনা মূল্যের বই দেওয়া শুরুর ১৩ বছরের মাথায় দেড় কোটির বেশি শিক্ষার্থী বেড়েছে। আবার ঝরে পড়াও কমছে। আরেকটি বিষয় হলো, আগে দেখা যেত, শ্রেনি কার্যক্রম শুরু হতেই এক–দুই মাস চলে যেত। এখন বছরের শুরুতেই শ্রেনি কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হচ্ছে। ইতিবাচক এই পরিবর্তনের বড় কারণ স্কুলের সব শিশুর হাতে বিনা মূল্যে বই দেওয়া।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি