সারাহ ইসলাম: মৃত্যুই তাকে দিয়েছে অমরত্বের ছোঁয়া
২২ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৪৪
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার কবিতায় বলেছেন, ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে। চিরস্থায়ী কবে নীর, হায় রে, জীবন নদে?’ জন্মই হয় মৃত্যুর জন্য অর্থাৎ মৃত্যু অনিবার্য। প্রত্যেকেই কোনে না-কোনো সময় মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। পৃথিবীতে কেউ কোনো দিন মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারে নি। কিন্তু মরণ যাত্রায় যারা জীবনের গান গেয়েছেন তারাই পৃথিবীতে অমরত্ব পেয়েছেন। অনেকেই নিজ কর্মের মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করেছেন। তেমনই একটি অসাধারণ সাহস দেখিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য। তিনি মৃত্যুকেও ঐশ্বর্যময় করে গেছেন। নিজের জীবন প্রদীপ নিভে গেলেও তার দেয়া দু’টি কিডনি ও কর্নিয়া দিয়ে চারজন বিপন্ন মানুষকে উপকার করে গেলেন।
মাত্র দশ মাস বয়সে দুরারোগ্য টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস রোগে আক্রান্ত হন। এবং বিশ বছর বয়সে সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্যের জীবন প্রদীপ নিভে গেল। তিনি যে মরণঘাতক রোগটি বহন করে আসছিলেন, সেখানে দ্রততম সময়ে মৃত্যুই ছিল অনিবার্য। এটা জেনেও তিনি কিন্তু বসে থাকেন নি। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করেছেন। শৈশব থেকে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে বন্ধুরা সহজে তার কাছে আসতে চাইতো না, পাশে কেউ বসতে চাইতো না। শত লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করে এগিয়ে গেছেন। দুঃসহ পথ পাড়ি দিয়ে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তিনি সুন্দর ছবি আঁকতেন। সামাজিক কাছে জড়িত ছিলেন। সারাহ যখন মৃত্যশয্যায় তখন তার মা শবনম সুলতানার একটি ফেইসবুক পোস্ট মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি লিখেন, ‘সেই অকুতোভয় মেয়েটি যে কিনা বরাবরই রক্ত শূন্যতায় ভোগে – সে কিনা কারো জরুরি রক্তদানের প্রয়োজনে ছুটে চলে যেতো রক্তের সন্ধানে – ক্লাসে কারো বমি হচ্ছে সবার আগে সেই ছুটে যায়, স্কুলে থাকা আরেকটি মেয়ের রহস্যজনক মৃত্যুতে সে-ই প্রতিবাদ করে সবার আগে—বেশ কিছু দিন আগে ঘটে যাওয়া সড়ক আন্দোলনের সময়ও সে রাস্তায় – এদেশে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কেন নিরাপদে পথ চলতে পারবে না! সেই প্রতিবাদে মশাল জ্বালিয়ে গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত সবার সাথে ও তো থাকবেই। এরকম আরও কত প্রতিবাদ কত আন্দোলন!
সারাহ ইসলামের দান করা কিডনি দিয়েই চিকিৎসা শাস্ত্রে শুরু হলো নতুন ইতিহাস। তিনি প্রথম ব্যক্তি যার মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তির কিডনি প্রতিস্থাপন হলো অন্য ব্যক্তির দেহে। এর আগে অনেকেই মরণোত্তর কিডনি দান করলেও আত্মীয়দের আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে উঠেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিডনি ফাউন্ডেশনের চিকিৎসকেরা এই কিডনি প্রতিস্থাপন করে তারাও ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন।
বাংলাদেশে অনেক লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। ডায়ালাইসিস ফি-য়ের কারণে অনেক স্বচ্ছল পরিবারও অসহায় হয়ে পড়ে। সেইসব মানুষের জন্য আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে গেলেন সারাহ ইসলাম। একসময় হয়তো তার দেখানো পথেই আরো অনেক মানুষ এগিয়ে আসবে। অনেক অসহায় মানুষের জীবন বাঁচবে। কিছুদিন পূর্বেও রক্ত দানে মানুষের ভীতি ছিল। সামাজিক ও ধর্মীয় বাধাও ছিল। কিন্তু আজ রক্তদান একটি সহজ প্রকৃয়া হয়ে গেছে। এখন আর মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করতে হয় না, বরং অনেকেই স্বেচ্ছায় মুমূর্ষু রোগীকে রক্ত দিয়ে আসে। রক্তদানের কারণে প্রতিদিন শত-শত মানুষ প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। মরণোত্তর চক্ষুদান মানুষের কাছে এখন অনেকটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। এর ফলে অন্ধত্ব জয় করে অনেকেই পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছে। হয়তো একদিন মরণোত্তর কিডনি দানও স্বাভাবিক প্রকৃয়া হবে। কিডনি জটিলতা কমে আসবে, অনেক মানুষের জীবন বাঁচবে।
কিনডি দরকার, কিন্তু আত্মীয় স্বজন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে এর থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় ‘ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট’ অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির অঙ্গ প্রতিস্থাপন। অনেক দেশে আগেই শুরু হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্যকে দিয়ে যাত্রা শুরু করলো। ক্লিনিক্যালি ডেড ঘোষণার পর বীরকন্যা ঐশ্বর্যের দুইটি কিডনি দু’জনের দেহে ও কর্নিয়া দুইটি দু-জনের চোখে সফল ভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘রিপোর্ট অন স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস -২০২০’ অনুসারে, দেশে সব ধরনের মৃত্যুর মধ্যে কিডনি জটিলতায় মৃত্যুর স্থান ৮ নম্বরে। কিডনি জটিলতায় প্রায় ৩ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। কোনো ব্যক্তি ‘ব্রেন ডেথ’ হওয়ার পর কিডনি, কর্নিয়া, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, লিভার, অগ্ন্যাশয়, অস্থিমজ্জা ও খাদ্যনালীর মতো অঙ্গগুলো অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। এগুলোকে চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় ক্যাডাভেরিক প্রতিস্থাপন বলা হয়। বাংলাদেশে ১৯৮২ সাল থেকে জীবিত দাতা ব্যক্তির কাছ থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়। তবে ব্রেন ডেড ব্যক্তির ক্ষেত্রে আইনি সীমাবন্ধ ছিল। ২০১৮ সালে আত্মীয়দের সম্মতিতে ব্রেন ডেড ব্যক্তির অঙ্গদান আইন সংশোধন করে করা হয়।
বিশ্বের অনেক দেশেই কিডনি কেনাবেচা হয়। যা সম্পূর্ণ অবৈধ। বাংলাদেশে এক শ্রেনীর মানুষ আছে যারা কিডনি বেচাকেনার মতো ভয়াবহ ব্যবসার সাথে জড়িত। তারা অসহায়ত্ব কিংবা মিথ্যা প্রলোভনে দেখিয়ে মানুষের কিডনি নেওয়ার মাধ্যমে জীবনকে অচল করে দেয়। ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট প্রকৃয়া চালু হয়ে গেলে অবৈধ ভাবে কিডনি বেচাকেনা বন্ধ হয়ে যাবে।
সারাহ ইসলামের মা শিক্ষিকা শবনম সুলতানা সাংবাদিকদের বলেন, সারাহ সত্যি সত্যি স্বর্গীয় সন্তান ছিল। যেখানে যেত ব্যবহার দিয়ে সবাইকে মোহিত করে রাখত। ও বলেছিল, ‘আমার সবকিছু গবেষণার জন্য দিয়ে দিতে পারো মা। ওর ইচ্ছা ছিল, ওর ব্রেন নিয়ে গবেষণা হোক।’ আসলেই তিনি স্বর্গীয় মানুষ ছিলেন তার আত্মত্যাগের মাধ্যমে মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি হবে। একদিন বাংলাদেশের কিডনি সমস্যা কমে যাবে। অনেক মানুষ নতুন জীবন পাবে। আর তিনি পাবেন অমরত্বের ছোঁয়া।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই
তাপস হালদার মত-দ্বিমত সারাহ ইসলাম: মৃত্যুই তাকে দিয়েছে অমরত্বের ছোঁয়া