Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পরাশক্তিরা বাংলাদেশে ছুটে আসছে নিজ প্রয়োজনে

মোস্তফা কামাল
২৬ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:০০

হাল নাগাদে দূর-বহুদূর থকেও এন্তার প্রশংসা বাংলাদেশের। আর সফরে এলে তো কথাই নেই। বাংলাদেশের এগিয়ে চলা কারও কাছে গল্পের মতো। কারও কাছে উপাখ্যান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করে ঢাকা থেকে বিদায় নিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের এমডি অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ আনায় ভুল স্বীকার বা দূঃখ প্রকাশ না করলেও কাছাকাছি গেছেন। তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নকে ‘অবিশ্বাস্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। উন্নয়নের ধারায় ঢাকার পাশে থাকার আশ্বাসও দিয়েছেন। এর আগে আইএমএফের প্রতিনিধি দলও বাংলাদেশের উন্নয়নে মুগ্ধতার কথা জানিয়ে গেছে।

কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভেন্যু হয়ে গেছে এশীয় অঞ্চলের বাইরে বিশ্বের নানা প্রান্তের অনেকের কাছে। একজন যেতে না যেতেই আরেকজন ছুটে আসছেন। কখনো কখনো একজন থাকতে থাকতেই চলে আসছেন আরেকজন বা অন্য কোনো জন। কেন এত ব্যস্ততা তাদের? কেনইবা নানা কথা, বন্ধুত্বের আবহে বাংলাদেশকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেওয়া? যাদের কেউ কেউ ক’দিন আগেও বাংলাদেশকে শুনিয়েছে নানা তিতা কথা। সঙ্গে নানা ছবক তো দিয়েছেই। বিশেষ করে তাদের ঢাকাস্থ কূটনীতিকরা ক্ষেত্র বিশেষে মাত্রাও ছাড়িয়েছেন। এতে সরকার যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে। ক্ষুব্ধ হয়ে কারও কারও বিরুদ্ধে চিঠি চালাচালি পর্যন্ত করেছে। বিরোধীদলসহ সরকারে বিপক্ষ মহল এতে তৃপ্তি পেয়েছে। অনেকটা ম্যাজিকের মতো সেখানেই এখন উল্টা রথ। ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি ও ভৌগোলিক নানা কারণে ঢাকাকে তোয়াজ করার লড়াই কারও কারও মধ্যে। কেবল আশপাশে বা উপাঞ্চলে নয়, বিশ্বের কয়েকটি পরাশক্তি দেশও শামিল এ কাতারে। বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে রীতিমত লড়াকু যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো পরাশক্তি। যার আগে-পিছে রয়েছে নানা ঘটনা ও রহস্যে ভরা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।

গত কয়েক সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ প্রতিনিধি দল, মার্কিন ও চীনা কর্মকর্তাদের ঢাকা সফরের মাঝে কূটনৈতিক অনেক তথ্য লুকানো। তারা এখানে পর্যটক হয়ে আসেন না। কারও কারও আকাঙ্খা মতো সালিশ করতেও আসেন না। সবাই ছুটে আসছেন যার যার প্রয়োজনে। বাংলাদেশকে পাশে পেতে অপেক্ষার কথা জানাচ্ছেন জায়গা দৃষ্টে। গত ১৪ জানুয়ারি ঢাকা সফর করেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। রাজনৈতিক নেতা, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন তিনি। এর আগে সফর করে গেছেন হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়ার জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার। তিনি ছিলেন চারদিন। ৯ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে মোমেনের সঙ্গে দেখা করার পরদিনই ঢাকায় বিমানবন্দরে নামেন চীনের নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং। দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার পথে একঘন্টা বিরতি দিয়েছেন বলে জানানো হয় কূটনৈতিক ভাষায়। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এটাই ছিল তার প্রথম বিদেশ সফর। কূটনীতি বোঝাশোনা কারও কারও মতে, নবনিযুক্ত চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত সেই সফর দেশটির কূটনৈতিক ঐতিহ্যে টোকা পড়েছে। আর হাইলাইট হয়েছে বাংলাদেশ। কিনের সেই সফরের পরপরই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের উপ-প্রধান চেন ঝো’র নেতৃত্বে সিসিপির একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। সফরে প্রতিনিধি দলটি ২০তম সিসিপি জাতীয় কংগ্রেসের স্পিরিট তথা মূল কথা ব্যাখ্যা করে নানা বক্তৃতা দেয়।

বাংলাদেশ নিয়ে পরাশক্তিগুলোর এ ব্যস্ততা- ঝানু কূটনীতিকদের কাছে বিশ্লেষণের অনেক খোরাক। এর নেপথ্যও বেশ গভীরে। তবে, দুর্বোধ্য নয়। নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সময় পুরানো অনেক হিসাব পাল্টে গেছে। বদলে গেছে শত্রু-বন্ধুর সংজ্ঞাও। কাউকে ছোট বা গুরুত্বহীন ভাবার দিন ফুরিয়ে গেছে। কারও জন্য যা মঙ্গলের, আরেকজনের জন্য তা আশির্বাদের। এছাড়া, পুরানো স্নায়ুযুদ্ধে অভিজ্ঞ সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় এবার কৌশলের মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন তার মতো করে বিশ্ব-ব্যবস্থা তৈরি করছেন। বাইডেনকে সামনে রেখে পশ্চিমাদের আরেক হিসাব। এতে দুনিয়ার কোনো দেশই হিসাব থেকে বাদ যাচ্ছে না। উগান্ডাও বাদ থাকছে না এ স্নায়ুর রেশ, তাপ বা চাপ থেকে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি যে নীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছে, তা হলো- ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। পররাষ্ট্রনীতির এই কৌশল সম্প্রতি বাংলাদেশের জন্য আরও আশীর্বাদ ডেকে আনছে। দিন যত যাচ্ছে বড় পরাশক্তিগুলো তাদের বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাবু করতে মিত্র বাড়াচ্ছে। সেখানে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি বাংলাদেশকে সোনার পাথরবাটি করে তুলেছে।

বাংলাদেশকে ‘মার্কিন ইন্দো-প্যাসিফিকে’ কৌশলে টানতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা অন্তহীন। চীনের জন্য আবার এটি কষ্টের। ঢাকাকে কোনো একতরফা জোটে না যেতে চাপ দিয়ে আসছে বেইজিং। চাপের সঙ্গে অফারও কম নয়। চীন তার গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ-জিডিআই এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভে-জিএসআইতে বাংলাদেশকে খুব আশা করে। বাংলাদেশের এখন হাই রেট যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কাছেও। এ নিয়ে বাগযুদ্ধও চলছে পরাশক্তির দেশ দুটির মধ্যে। বিশ্ব ভূগোলের এমন হাই প্রোফাইলে উঠে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলবার্তার পাশাপাশি শনির ইঙ্গিতও দেয়। ব্যালান্স একটু এদিক ওদিক হলেই বিপদ। আর এই ব্যালান্স পুরোপুরি নির্ভর করছে কূটনৈতিক কৌশলের ওপর। এখন পর্যন্ত বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার চিপায় চ্যাপ্টা হওয়ার বদলে অবিরাম সক্ষমতার জানান দিয়ে চলছে বাংলাদেশ।

নানা কৌশল চর্চায় বেশ পরিস্কার সরকারের সতর্কতা। রাজায় রাজায় যুদ্ধের মাঝে উলু খাগড়ার দশায় পড়তে দিতে চায় না ঢাকাকে। নাগরিকদের অধিকারের প্রতি যত্নবান হওয়ার অজুহাতে ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে কারও প্রভাব বিস্তারের সুযোগ রাখতে চায় না সরকার। বরং বাংলাদেশও বিশ্বে এখন একটা ফ্যাক্টর তা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা বেশ স্পষ্ট। সেই সামর্থ এরই মধ্যে বাংলাদেশ আয়ত্ব করেও নিয়েছে। চলমান স্নায়ুচাপে বিভক্ত বিশ্বে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক দিন দিন গভীর হচ্ছে। ভারত আছে ব্যালেন্সে। ইউরোপের রণাঙ্গনে রাশিয়াকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরোধ করছে ইউরোপীয় জোট ন্যাটো দিয়ে। আর এশিয়ায় চীনকে অ্যালায়েন্স দিয়ে রুখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে মিয়ানমার ক্রমশ ধেয়ে চলছে আরেকটি ভিয়েতনামের পথে। এসবের ডামাডোল থেকে কেবল রক্ষা নয়, লাভবান হওয়ার সোপানে বাংলাদেশ। মিলছে সম্ভাবনাও। ভালো-মন্দ মিলিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে ও ভূগোলে বাংলাদেশের অবস্থানটা এখন ভিন্ন উচ্চতায়। বহু মান্যজনের ঢাকা যাতায়াতের রহস্য এখানে। এর ফাঁকে কেউ যেন আবার বাংলাদেশকে পেয়ে না বসে সেই সতর্কতাও জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক; বাংলাভিশন

সারাবাংলা/এসবিডিই

টপ নিউজ পরাশক্তিরা বাংলাদেশে ছুটে আসছে নিজ প্রয়োজনে মত-দ্বিমত মোস্তফা কামাল


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

এখনো সালমানকে মিস করেন মৌসুমী
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৩

সম্পর্কিত খবর