মেট্রোরেলের পর এবার পাতালরেলের যুগে
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:৩০
বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে অর্থনৈতিক টানাপোড়ান এবং ডলার সংকটের মধ্যেও এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা। মেট্রোরেল যুগে প্রবেশের দেড় মাসের মাথায় শুরু হচ্ছে পাতালরেল নির্মাণের কাজ। এরই মধ্যে দেশের প্রথম মেট্রোরেল চলছে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত। এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এই রুটে ট্রেন চলবে মতিঝিল পর্যন্ত। দ্বিতীয় মেট্রোরেল হবে উড়াল ও পাতাল পথের সমন্বয়ে। এটির নাম ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট বা এমআরটি লাইন-১। এর দুটি রুট- বিমানবন্দর ও পূর্বাচল রুট। বিমানবন্দর- কমলাপুর করিডোরের মোট দৈর্ঘ্য ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পুরোটাই হবে পাতালপথ। এই পথে থাকবে ১২টি স্টেশন। এগুলো হল- বিমানবন্দর, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩, খিলক্ষেত, যমুনা ফিউচার পার্ক, নতুন বাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, হাতিরঝিল, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ এবং কমলাপুর।
এমআরটি লাইন -১ এর উড়ালপথের অংশে পূর্বাচল রুটের নতুন বাজার স্টেশনটি হবে পাতালে। তারপর নতুনবাজার থেকে নারায়ণগঞ্জের পিতলগঞ্জ পর্যন্ত পুরোটাই হবে উড়ালপথ। এই করিডোরের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার। এই পথে থাকছে ৯টি স্টেশন। এগুলো হলো – নতুন বাজার, যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা, পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি, মাস্তুল, পূর্বাচল পশ্চিম, পূর্বাচল সেন্টার, পূর্বাচল টার্মিনাল ও পিতলগঞ্জ ডিপো। এটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। এই প্রকল্পের মোট অনুমিত ব্যয় ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি বা জাইকা দিচ্ছে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। বাকি অর্থের জোগান দিবে বাংলাদেশ সরকার। রুপগঞ্জের পিতলগঞ্জে ৮৮ দশমিক ৭১ একর জায়গায় নির্মাণ করা হবে মূল ডিপো। এজন্য ব্যয় হবে ৬০৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বিমানবন্দর রুট ও পূর্বাচল রুটে চলাচলকারি সব মেট্রো ট্রেন এই ডিপোর সুবিধা ব্যবহার করবে। ডিপো নির্মাণ কাজের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এরই মধ্যে চুক্তি সই হয়েছে। পাতাল রুটের নির্মাণ কাজের জন্য প্রায় ৯৩ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা।
এমআরটি লাইন-৬ দিয়াবাড়ি-মতিঝিল রুটের সব কটি স্টেশন রাস্তার উপরে হয়েছে। এমআরটি লাইন-১ এর সব কটি স্টেশন হবে মাটির নীচে। এআরটি লাইন-৬ এর মতো এমআরটি লইন-১ এর স্টেশনগুলোও হবে তিনতলা। স্টেশনের তিনতলাই হবে মাটির নীচে। প্লাটফর্মে ওঠা-নামার জন্য উভয়পথের স্টেশনে থাকবে লিফট, সিঁড়ি ও এস্কেলেটর। এটি নির্মাণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। স্টেশন নির্মাণের সময় ওপেন কাট পদ্ধতিতে রাস্তার অর্ধেক অংশে প্রথমে খনন করা হবে। ওই অংশ দিয়ে সমস্ত যান্ত্রপাতি নীচে নামানো হবে। তারপর স্টিলের পুরু পাত দিয়ে ঢেকে দিয়ে যান চলাচলের জন্য সেটি খুলে দেওয়া হবে। এই পাতের উপর দিয়ে ৪০ টন ওজনের গাড়িও চলাচল করতে পারবে। এরপর অন্য অর্ধেক অংশ খনন করে কাজ করা হবে। এই কাজের জন্য সর্বোচ্চ ৬ মাস সময় লাগবে। পরে মাটির নীচে কাজ চলবে যা উপর থেকে বুঝা যাবে না। পরে টিভিএম মেশিন দিয়ে যখন টানেল কাটা হবে সেটিও মাটির উপর থেকে কোনভাবে বুঝা যাবে না। ফলে এমআরটি লাইন-৬ তৈরীতে যে ভোগান্তি হয়েছে জনসাধারণের সেটি এ ক্ষেত্রে হবে না এবং কাজও হবে দ্রুতগতিতে।
আন্তর্জাতিকভাবে ৮টি কোচ দিয়ে মেট্রোরেলের ট্রেন চলাচল শুরু করা হয়। কিন্তু এমআরটি লাইন-৬ এ ৬টি কোচ দিয়ে উত্তরা-আগারগাঁও মেট্রোরেল চলাচল শুরু করা হয়েছে। পরে আরও ২টি কোচ বাড়িয়ে ৮টি করা হবে। এমআরটি লাইন -১ এ শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ৮টি কোচ দিয়ে মেট্রো চলাচল শুরু হবে। উত্তরা-মতিঝিল লাইন-৬ রুটে সাড়ে ৩ মিনিট পরপর স্টেশনে ট্রেন আসবে। কিন্তু বিমানবন্দর- কমলাপুর রুটে ট্রেন চলবে প্রতি ১০০ সেকেন্ড পর পর। উত্তরা-কমলাপুর রুটে প্রতিদিন চলাচল করবে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ। আর লাইন-১ রুটে চলাচল করবে প্রতিদিন প্রায় আট লক্ষ যাত্রী।
২০৩০ সালের মধ্যে পুরো ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ ও সাভার মেট্রোরেল নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসবে। এই ২টি রুট ছাড়াও তখন থাকবে এমআরটি লাইন-২, এমআরটি লাইন-৫ দক্ষিণ, এমআরটি লাইন-৫ উত্তর, এমআরটি লাইন-৪। এমআরটি লাইন -৫ রুটটি ২০২৮ সালের মধ্যে নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও সম্ভবত ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হবে। পাতাল ও উড়াল পথের সমন্বয়ে গাবতলী থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত হবে এমআরটি লাইন-৫’র দক্ষিণ রুট। এই রুটের ১৭ দশমিক ৪ কিলোমিটার পথে থাকবে ১৬টি স্টেশন। এর মধ্যে ১২টি হবে পাতাল ও ৪টি হবে উড়াল স্টেশন। এগুলো হবে গাবতলী-টেকনিক্যাল-কল্যাণপুর-শ্যামলী-কলেজগেট-আসাদগেট-রাসেল স্কয়ার-পান্থপথ- হোটেল সোনারগাঁও মোড়-হাতিরঝিল-নিকেতন-রামপুরা-আফতাব নগর (পশ্চিম)-আফতাব নগর (সেন্টার)-আফতাব নগর (পূর্ব)-দাশেরকান্দি ও ভূলতা। এই রুটের প্রাথমিক সম্ভ্যাবতা এরই মধ্যে যাচাই করা হয়েছে।
এমআরটি লাইন -৫’র উত্তর হবে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত। ১৯ দশমিক ৬ কিলোমিটারের এই রুটে পাতাল পথ হবে ১৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার এবং উড়াল পথ হবে ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এই রুটের স্টেশন থাকবে মোট ১৪টি। এর মধ্যে ৯টি পাতাল এবং ৬টি উড়াল। এগুলো হবে হেমায়েতপুর-বালিয়ারপুর-মধুমতি-আমিনবাজার-গাবতলী-দারুস সালাম-মিরপুর ১-মিরপুর ১০-মিরপুর ১৪-কচুক্ষেত-বনানী-গুলশান ২-নতুন বাজার-ভাটারা। এরই মধ্যে এমআরটি লাইন-৫’ উত্তর রুটের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। এর ডিপিপি’র-ডিটেইল প্রজেক্ট প্ল্যান অনুমোদন করা হয়েছে। এটি নির্মাণে অনুমিত ব্যয় হবে ৪১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা।
এমআরটি লাইন-২’র আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে গাবতলী থেকে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত পাতাল ও উড়াল পথের সমন্বয়ে হবে আরেকটি মেট্রোরেল রুট। এটির দৈর্ঘ্য হবে ২৪ কিলোমিটার। এই লাইনটির সাম্ভাব্য রুটটি হবে গাবতলী- বসিলা- মোহাম্মদপুর বিআরটিসি বাস স্ট্যান্ড- সাত মসজিদ রোড- ঝিগাতলা- ধানমন্ডি ২ নম্বর রোড- সায়েন্সল্যাব- নিউমার্কেট- নীলক্ষেত- আজিমপুর- পলাশী- শহীদ মিনার- ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ- পুলিশ হেড কোয়াটার্স- গোলাপশাহ মাজার- বঙ্গ বাজারের উত্তর পাশের সড়ক- মতিঝিল- আরামবাগ- কমলাপুর-মুগদা- মেরাদিয়া- চট্টগ্রাম রোড। এ ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে আরেকটি মেট্রোরেল রুট হবে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত। এমআরটি লাইন-৪ এর এই রুটটি কমলাপুর- নারায়ণগঞ্জ রেল ট্র্যাকের নিচ দিয়ে পাতাল পথে হবে। এর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১৬ কিলোমিটার।
আশা করা হচ্ছে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। খুব সহজেই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন যাত্রীরা। এখন যেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে পড়ে থাকতে হয়, বাস চালক-শ্রমিক আর অটোরিকশাচালকদের ভাড়ার নৈরাজ্য সহ্য করতে হয়, সেই ভোগান্তি থাকবে না। চলাচল হবে আরামদায়ক, সময় ও অর্থ সাশ্রয়ী। বুয়েটের ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতিবছর বাড়তি খরচ হয় ৪.৪ বিলিয়ন ডলার যা টাকার অংকে প্রায় ৪৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ৫ বছর পর এই অংকের পরিমাণ এখন আরো বেশি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী যানজটের জন্য ঢাকায় প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন বা ৩৮ লক্ষ কর্মঘন্টা নষ্ট হয়। এর আর্থিক মূল্য বিপুল। মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক চালু হলে প্রতি বছর এই বিপুল পরিমাণ অংকের টাকা ও শ্রমঘন্টা বেঁচে যাবে। যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরণের ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে। এ অবস্থায় তাই বলাই যায়, মেট্রোরেলের পর এবার উন্নয়ন অভিযাত্রায় বাংলাদেশ প্রবেশ করলো পাতালরেলের যুগে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
মত-দ্বিমত মাহমুদুল হাসান শামীম মেট্রোরেলের পর এবার পাতালরেলের যুগে