আমার বন্ধু রাউফুন বসুনিয়া
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২২:০০
আমার বন্ধু রাউফুন বসুনিয়ার মৃত্যু হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী। এই দিনে স্বৈরাচারী এরশাদের ভাড়াটিয়া খুনিদের গুলিতে শহীদ হন বসুনিয়া। আজকের এই দিনে পরম মমতার সাথে স্বরণ করি তৎকালীন জাতীয় ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রাউফুন বসুনিয়াকে। স্বৈরাচার এরশাদ তার ক্ষমতা তৃনমূল পর্যন্ত বিস্তৃত করার লক্ষ্যে উপজেলা নির্বাচন করার উদ্দ্যোগ নেয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও রাজনৈতিক দল সমূহ তা প্রতিহত করার ডাক দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ.এফ রহমান হল এরশাদের ছাত্র সংগঠন নতুন বংলা ছাত্র সমাজের দখলে ছিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐ দিন সকালে নিয়মিত মিছিল শেষে স্যার এ এফ রহমান হল অভিমুখে রাতে মিছিলের সিদ্ধান্ত নেই। এ ছিল এক কঠিন সিদ্ধান্ত। মিছিলে আক্রমন হবে এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ছিলাম।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা সূর্যসেন হল ও মোহসিন হলের গেইটে জমায়েত হই। মিছিলটি মোহসিন হল থেকে বের হয়ে জহুরুল হক হলের মোড় পর্যন্ত অগ্রসর হতেই, একটি মোটর সাইকেলে কালো কোট পরা দুই যুবক মিছিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক রাউন্ড গুলি করে চলে যায়। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বন্ধু বসুনিয়া আমার হাত ধরা ছিল । কিন্তু আমি বুজতে পারিনি। এফ রহমান হল ও মোহসিন হল এর মাঝখানে তখন সংঘর্ষ চলছে। আমার বন্ধু প্রয়াত কাজী জামিল হক রাজা চিৎকার দিয়ে উঠল বসু আর নাই। আমি বসুনিয়ার নিথর দেহে হাত দিয়ে দেখলাম সব শেষ।
আমাদের এক সহকর্মী মুকুল ঘটনাটির বর্ননা দিয়েছে নিম্নরূপ-
১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে এরশাদের গুন্ডা বাহিনীর হাতে নিহত হন রাউফুন বসুনিয়া
১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে সূর্য সেন হলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিটিংয়ের দায়িত্ব ছিল বাসদ ছাত্রলীগের। আমরা সন্ধ্যা থেকেই রুমে রুমে যেয়ে মিটিং-এ আসার জন্য সবাইকে বলতে থাকি। রাত সাড়ে আটটা নয়টার দিকে বসু ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হয় হলের ভিতরে। আমাকে জিজ্ঞেস করে রানা হামিদ কোথায়। আমি বলি সামনে যান রানা ভাই আর শফি ভাই সামনেই বসে আছে। আমাদের কারো এক জনের রুমে ডিমের তরকারী আর ভাত রান্না হয়েছিল, সেখানে আমারও খাওয়ার কথা তাই বসু ভাইকে বলি ভাই মিটিংয়ের দেরি আছে ডিমের তরকারি দিয়ে ভাত খাবেন? তিনি না বলে গেটের বাইরে চলে যান। যথারীতি সভার প্রস্তুতি চলাকালে আমি উনাদের কাছে গেলে শফি ভাই বলেন তার ঠাণ্ডা লেগেছে। আমি বললাম তাহলে সিগারেট খাচ্ছেন কেন? আমার উদ্দেশ্য ছিল সিগারেটের বাকি অংশটায় ভাগ বসানো। সেই সভায় সে রাতে সভাপতিত্ব করে আমাদের হল শাখার সভাপতি কামিদ ।
নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখার পর এরশাদের উপজেলা নির্বাচন বন্ধ সহ আগামী কাল ১৪ ফেব্রুয়ারি বটতলার জমায়েতে যোগদানের আহবান জানিয়ে আমরা স্লোগান দিতে দিতে মহসিন হল পার হয়ে সামনে এগুতে থাকি। সংখ্যায় ৩০/৩৫ জন ছিলাম। মিছিলের সামনে ছিল শফি ভাই রানা হামিদ বসু ভাই ও অন্যান্যরা। মহসিন হল পার হতেই শফী ভাই দ্বিতীয় সারিতে এসে দুই একবার স্লোগান দিতেই তার গলা বসে যায়। তারপর বসু ভাই জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো বলতেই তার গলার স্বরও দুর্বল হয়ে যায়। সাধারণত প্রায় সব মিছিলে আমি অন্যান্যদের সাথে শ্লোগান দিতাম। খানিকটা লজ্জায় আমি বসু ভাইকে বলি ভাই আপনে সামনে যান আমি স্লোগান ধরছি। তখন আমি স্লোগান ধরি দ্বিতীয় সারি থেকে। জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো ,খুনি এরশাদের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবনা। ততক্ষণে মিছিলটা বড় রাস্তায় উঠে গেছে। একটা হুণ্ডা সামনে দিয়ে খুব জোরে শব্দ করে এফ রহমান হলের দিকে চলে গেল। ঠিক তখন সামনের সারিতে পাশাপাশি বসু ভাই, শফী ভাই ও রানা হামিদ ভাই । তারপরই এফ রহমান হলের সামনে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে একজন কেউ গুলি করেছিল। ধুপ করে একটা শব্দ শুনেছিলাম। নিচু হয়ে তাকিয়ে দেখি বসুভাই,রক্তে ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ঢেকে গেছে চোখ আর কপাল।
বসুনিয়ার নিষ্প্রাণ নিথর দেহ আমরা ক্রলিং করে মোহসিন হলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। মোহসিন হল থেকে ছাত্রদলের নেতা কর্মীরা এফ রহমান হলের দিকে শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে। অবশেষে লাশ মোহসিন হলের গেষ্টরুমে নিয়ে আসতে সমর্থ হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অন্যান্য শিক্ষকগণ ও কেন্দ্রীয় ছাত্র নেতাদের মধ্যে অনেকেই মোহসিন হলে পৌঁছান। পুরো ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। নিস্তব্ধ ক্যাম্পাসেও নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের গুলি বর্ষণ চলতে থাকে। পরে পুলিশ প্রহরায় লাশ ঢাকা মেডিক্যাল এর মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরদিন সকালে শহীদ বসুনিয়ার লাশ নিয়ে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য মিছিল শুরু হয়। মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা শেষ করে পুরনো ঢাকার দিকে যেতে থাকলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। ছাত্ররা ছত্রভংগ হয়ে রাজপথে বিভিন্ন সরকারী যানবাহন ও স্থাপনার উপর হামলা চালায়। ফলশ্রুতিতে স্বৈরাচারী এরশাদ উপজেলা নির্বাচন স্থগিত ঘোষোনা করতে বাধ্য হয়।
বসুনিয়ার আত্মদান নয় বছরের সামরিক শাষণ বিরোধী আন্দোলনে এক নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করে। আজ স্বৈরাচারের পতনের ২৮ বছর পরেও আমরা ঠিক যে আকাংখা নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারিনি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে, বছরের শেষ নাগাদ সংবিধান অনুযায়ী সকলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠ নির্বাচন হোক এই আমাদের প্রত্যাশা। বসুনিয়া বিশ্বাস করত বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, সেই বিশ্বাস যেন বাস্তবায়িত হয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে।
“ বসুনিয়ার বুকের তপ্ত লাল রক্তে ভেসে যাক সব অন্যায়,
ফাগুনের প্রথম দিন প্রকৃতি যেন সেই পরিবেশেই সেজে উঠে। ”
লেখক : ৯০এর গণ আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় নেতা ও আওয়ামীলীগ নেতা
সারাবাংলা/এজেডএস