জয়তু রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২০:০৪
এক কথায় বলব, বাংলাদেশ সৌভাগ্যবান এজন্য যে একজন অত্যন্ত মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী একজন মানুষকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে পেল। সরকার প্রধান শেখ হাসিনা যেমন তেমনি একজন রাষ্ট্রপ্রধান পেলাম আমরা। নিজের দেখা থেকেই বলছি, এতটা নির্মোহ মানুষ খুব কম দেখেছি আমি। তিনি নিজেকে কোথাও কখনও প্রচার বা মার্কেটিং করেননি। কোনো গণমাধ্যমের কেউ বলতে পারবে না যে তিনি কখনও কাউকে বলেছেন তোমার টিভিতে আমাকে ডেকো কিংবা তোমার পত্রিকায় আমাকে নিয়ে লেখো, প্রমোট করো ইত্যাদি। তিনি নিজেকে নিয়ে নয় বরং সবসময় দেশকে নিয়ে, দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে ভাবতেন। তাই সবসময় দেশের প্রধান জাতীয় দৈনিকগুলোতে দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে কলাম লেখার মাধ্যমে সোচ্চার ছিলেন। অন্যদিকে অনেক বিখ্যাত/অখ্যাত মানুষকে দেখেছি সেই বিখ্যাত/অখ্যাতকে প্রমোট করার জন্য টিভি, পত্রিকার লোকদের রিকোয়েস্ট করতে। এক্ষেত্রে একদম প্রচারবিমুখ এবং নিভৃতচারী একজন মানুষ নবনির্বাচিত মহামান্য রাষ্ট্রপতি। জীবনে বহু মানুষ দেখেছি সেই বিচারে তিনি একদম ব্যাতিক্রম।
তিনি তার বড়দের প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল ঠিক তেমনি আমরা যারা ছোট তাদের প্রতিও তিনি অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ। এজন্য তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। জীবনে কোনো দিন তিনি কারো সম্পর্কে কটুক্তি করে কথা বলেননি এবং অন্যকেও এমন কথা বলা থেকে নিবৃত্ত করতে দেখেছি তাকে। এ প্রসঙ্গে একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। একবার তার গুলশানের অফিসে তারই সামনে বসে তার একমাত্র ছেলে এবং আমি দেশের কোনো এক গণমাধ্যমের মালিকের নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তিনি সেই আলোচনা শুনে সাথে সাথে আমাদে দুজনকে ওই বিষয়ে আলোচনা করতে নিষেধ করেছিলেন। এই হচ্ছেন তিনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র, যুবক অবস্থায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ পাবনা জেলা সভাপতি, আজীবন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলা মানুষ মোহম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ তিনি। তার পুরো জীবন পাঠ করলে দেখা যায় পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে একজন ফুলটাইম রাজনীতিবিদ জীবনের মাঝপথে বিচারবিভাগীয় ক্যাডার সার্ভিসে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেছিলেন। চাকুরি থেকে স্বাভাবিক অবসরের পর তিনি কিন্তু ঘরে বসে থাকতে পারেননি। আবারও রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন।
মোহম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর পাবনা শহরের শিবরামপুরের জুবলীট্যাঙ্ক পাড়ায়। তার পিতা শরফুদ্দিন আনছারী ও মাতা খায়রুন্নেছা। উভয়েই প্রয়াত। পাবনা আর এম একাডেমি থেকে ১৯৬৬ সালে ম্যাট্রিক, পাবনা এ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৭২ সালে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে এম এস সি ও ১৯৭৫ সালে পাবনা আমির উদ্দিন আইন কলেজ থেকে এল এল বি পাশ করেন।
সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর ছাত্রলীগ রাজনীতিতে হাতে খড়ি হয় কিশোর বয়সেই। ’৬৬-র ছয়দফা এবং ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ওই সময় পাবনা জেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাবনায় তিনি অন্যতম প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতি মনোনীত হয়ে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাকশালের পাবনা জেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে এর প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ওই সময় একটানা ৩ বছরের জেল জীবনে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হন।
নানা ঘটনা দুর্ঘটনা পেরিয়ে একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করেন। চাকুরিকালে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সর্ভিস এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে দুইবার নির্বাচিত মহাসচিব ছিলেন। বিচারকের বিভিন্ন পদে চাকরি শেষে ২০০৭ সালে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর তিনি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী পেশায় যোগদান করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাইকোর্টের নির্দেশে ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার কারণ অনুসন্ধান, অভিযুক্তদের চিহ্নিতকরণ ও সুপারিশ প্রণয়নের জন্য তাকে চেয়ারম্যান করে তার নামেই ‘সাহাবুদ্দিন কমিশন’ নামে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠণ করা হয়। উক্ত কমিশনের রিপোর্ট সরকার গেজেট আকারে প্রকাশ করে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাহাবুদ্দিন চুপ্পু দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই পদে ৫ বছর দায়িত্ব পালন কালেই বিশ্বব্যাংকের পদ্মাসেতু দুর্নীতির তথাকথিত অভিযোগের বিরুদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। দুদকের পক্ষে এককভাবে তার দৃঢ় ভূমিকায় অবশেষে বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় এবং বিশ্বব্যাংক পিছু হটতে বাধ্য হয়। এছাড়া তার সময়ে আলোচিত আর্থিক কেলংকারি ডেসটিনি, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ঘটনা এবং কতিপয় সরকারি কর্মকর্তার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ সংঘটিত হয়।
তিনি ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদে নিয়োগ লাভের মাধ্যমে ফের সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। আবার ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত হন। মোহম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় কাউন্সিলের আগে গঠিত তিন সদস্যের নির্বাচন কমিটির একজন অন্যতম সদস্য মনোনীত হন। ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ওই কাউন্সিলে পুনরায় উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য এবং পরে একই সাথে দলের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত হন তিনি। ২০২৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি পদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আর কোনো প্রার্থী না থাকায় ১৩ ফেব্রুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্দিদ্বতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এই মহান কর্মবীর। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেও অতীতের মত তার উজ্জ্বল ভূমিকা ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরে এক বিরাট ভূমিকা পালন করবে বলেই দেশের আপামর জনগণ প্রত্যাশা করে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে গত এক বছর আলোচনার শেষ ছিল না। কে হতে যাচ্ছেন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি? এটি ছিল মূল আলোচ্য বিষয়। বিগত এক বছর যাবৎ রাষ্ট্রপতি পদে প্রায় এক ডজন নাম রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনা হলেও সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর নাম ছিল সম্পূর্ণ অনালোচিত। কিন্তু সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি সকালে নাটকীয়ভাবে তার নামটি চলে আসে। যা ওইদিন সকালে গণভবনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সাহাবুদ্দিন চুপ্পু নিজেও জানতেন না। আমি বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগ প্রধান দূরদর্শী শেখ হাসিনা একজন সঠিক মানুষকেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বলা হয়ে থাকে সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যেমন পথ হারাবে না বাংলাদেশ ঠিক তেমনি রাষ্ট্রপ্রধান মোহম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়াতে দেশের সংবিধান সমুন্নত থাকবে। দেশ এবং দল আওয়ামী লীগ কোনো ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি স্তরে অতীতে যেমন ভূমিকা রেখেছেন তিনি ঠিক তেমনি রাষ্ট্রপতি হিসেবেও অনন্য ভূমিকা রাখবেন সেটিই প্রত্যাশা। জয়তু রাষ্ট্রপতি মোহম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু।
লেখক: কলামিস্ট, তথ্যচিত্র ও টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা
[email protected]
সারাবাংলা/এজেডএস