প্রভাতফেরির প্রথা কি তবে উঠেই গেলো?
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:৩৫
এক.
যখন নোয়াখালী ছিলাম, আধো গ্রাম, আধো শহর মাইজদীর কথা বলছি, সেই সময়টায় একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে আমরা প্রভাতফেরি করতাম। নগ্ন পায়ে একুশের গান—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ গেয়ে শহীদ মিনারের অভিমুখে এগিয়ে যেতাম। মাথাটা সবসময় শ্রদ্ধায় নুয়ে থাকতো। এগুলো হয়তো এখন কালপুরাণের গল্প শোনাবে নব প্রজন্মের কাছে।
ঢাকায় আসার পর প্রভাতফেরিকে সেইভাবে আর কাছে পেলাম না। বেশির ভাগ সময়ে রাতেই শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি, কিন্তু মনের ভেতর একটা হাহাকার হতো, খচখচানি লেগে থাকতো। সাম্প্রতিককালে আমি মধ্যরাতে একুশকে ফেরি করা থেকে বিরত থাকছি।
দুই.
বাঙালির ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে আছে ‘প্রভাতফেরি’র নাম। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এর পরের বছরেই চালু হয় এই প্রভাতফেরি। শব্দটির আভিধানিক অর্থ প্রভাতে উদ্বোধনী সংগীত গেয়ে জনগণকে জাগানো। প্রভাতফেরি আমাদের দেশেই প্রথম।
ইতিহাসমতে, ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো শহিদ দিবস পালিত হয়। বিস্ময়কর বিষয় হলো, এই দিবসটি পালন শুরুই হয় প্রভাতফেরি দিয়ে। সেটা সব ছাত্র সংগঠনের সিদ্ধান্তেই হয়। কারো কোনো একক সিদ্ধান্তে তা হয়নি। প্রভাতফেরির ওই দিনটিতে ঢাকার বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা খুব ভোরে মূলত ছাত্রাবাসগুলো থেকে বের হয়ে খালি পায়ে ফুল হাতে, কেউ ফুল ছাড়াই একুশের গান গাইতে গাইতে আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে শহিদদের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর তারা আসেন শহিদ মিনারের যে প্রতিকৃতি করা হয়েছিল সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। এভাবেই প্রভাতফেরির মাধ্যমে শহিদ দিবস পালন শুরু হয়েছিল।
‘একুশের পটভূমি ও একুশের স্মৃতি’ গ্রন্থে ‘শহীদ মিনারের কথা’ শীর্ষক নিবন্ধে ভাষাসংগ্রামী অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের একটা লেখা আছে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম শহিদ দিবসে প্রভাতফেরি করা হয় নগ্নপদে। কণ্ঠে ছিল গাজীউল হক রচিত গান, ‘ভুলবো না, ভুলবো না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবো না’। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কালো পতাকাও তোলা হয় সেদিন। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে যে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল ভাষা শহীদদের রক্তে সেই রাজপথে জুতা পায়ে হেঁটে শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যাবেন না —এমন চিন্তা থেকেই খালি পায়ে প্রভাতফেরির প্রথা চালু হয়েছিলো।
তিন.
এক সাক্ষাৎকারে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেন, ‘বাংলা বর্ষ গণনায় দিনের শুরু হয় সূর্যোদয় থেকে। কিন্তু খ্রিস্টাব্দ গণনার ক্ষেত্রে দিন শুরু হয় রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খ্রিস্টাব্দ অনুসরণ করে এলেও এটা যেহেতু ভাষা ও স্বাধিকারের বিষয়, সেহেতু প্রভাতফেরিটা ভোরবেলায়ই করা উচিত বলে আমি মনে করি।’
অনেক দিন থেকে ঐতিহ্য বিকৃতি আর ইতিহাস হারিয়ে ফেলার কথা বলা হচ্ছে। যখন বঙ্গবন্ধু, মওলানা ভাসানী প্রমুখ নেতার ছবি দেখি, তখন বুঝতে পারি তারা বাঙালি সংস্কৃতির নিয়ম মেনে প্রত্যুষকে একুশের প্রথম প্রহর মানতেন আর নগ্নপায়ে প্রভাতে প্রভাতফেরি নিয়ে শহীদ মিনারে যেতেন। এখন তাদেরই উত্তরসূরিরা পাশ্চাত্যেও প্রথা মেনে মধ্যরাতকে একুশের প্রথম প্রহর মানছেন। মধ্যরাতে ‘প্রভাতফেরি’ করে কেন্দ্রিয় শহিদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করছেন। যখন এরশাদ নিজ নিরাপত্তার স্বার্থে প্রভাত থেকে প্রভাতফেরিকে মধ্যরাতে নামিয়ে আনলেন তখন অনেকেই হায় হায় করেছিলাম। অথচ ক্ষমতাবানরা এরপর থেকে অবলীলায় এরশাদকেই অনুসরণ করতে থাকলেন। অথচ একবারও ভাবলাম না এতে একুশের ঐতিহাসিক সত্য ও সংস্কৃতি বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। প্রভাতফেরি নামটি থেকে যাচ্ছে অথচ প্রজন্ম প্রভাত খুঁজে পাচ্ছে না। আরও সংকট বড় হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের মানুষ ভাষা দিবস উদযাপনের সময় উৎস দেশটিকে অনুসরণ করতে চাইবে।
জাতীয়তাবাদী গল্পের মধ্যে ভাষা আন্দোলনটা এমনভাবে লীন হয়ে আছে যে আমরা সেই সামরিক অশ্বারোহীর মতো একই আলংকারিক ভঙ্গিতেই বলে যাচ্ছি। এখন আমরা দেখছি যে আমরা বরং উল্টো কাজ করেছি। মধ্যরাতের প্রভাতফেরির ভুল সংস্কৃতি নির্দেশ করছি। একটি মাত্র জাতীয় দিবস যার সঙ্গে ‘প্রভাতফেরি’ নামটি জড়িয়ে আছে। আমরা স্বাধীন দেশে অচেনা করে দিচ্ছি এই সংস্কৃতিটিকে। মধ্যরাতের আয়োজন সম্পন্ন করেও সংখ্যায় অল্প হলেও কোনো কোনো সংগঠন প্রভাতফেরি করছে। কিন্তু ‘চেতনা’-টা বড় আকারে খুব জাগাতে পারছে না। কারণ মধ্যরাতকে ওরা বর্জন করতে পারেনি। আমাদের পূর্বপুরুষ বুকের রক্ত দিয়ে ঐতিহ্য গড়ে দিলেও আমরা সচেতনভাবেই যেন একুশের ‘চেতনাবিচ্ছিন্ন’ হয়ে পড়ছি।
লেখক: রাজনীতিবিদ, সংগঠক
সারাবাংলা/এসবিডিই