ডিজিটাল প্রযুক্তির বিশ্ব হোক নারীর সহায়ক ও ক্ষমতায়নের হাতিয়ার
৮ মার্চ ২০২৩ ১৪:৫১
৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সারা বিশ্বে নারীর প্রতি অবিচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং নারীর কাজ, উদ্যোগকে সম্মান জানানোর জন্য এ দিবসটি পালন করা হয়। নারীর অধিকার আদায় ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে অসঙ্গতিগুলোও বিশ্বব্যাপি নানা ব্যঞ্জনায় তুলে ধরা হয় সবার সামনে। বিশ্বব্যাপি লিঙ্গবৈষম্য দূর করার জন্য এই দিনটি পালিত হয়। সর্বোপরি শিল্প-সাহিত্যসহ সব ধরনের ক্ষেত্রে এবং সমাজের সমস্ত কাজে নারীদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতেই এই দিনটি পালিত হয়।
১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি নিউইয়র্কে জাতীয় নারীদিবসের আয়েজন করে। এর প্রস্তাব দিয়েছিলেন শ্রমকর্মী থেরেসা মালকিয়েল। শহরের গার্মেন্টস শ্রমিকদের এক প্রতিবাদ স্বরূপ শুরু হয়েছিল এই দিনটির যাত্রা। ১৯১০-এ আমেরিকান সমাজতন্ত্রীদের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে জার্মান প্রতিনিধিরা নারীদিবস পালন করেন। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে নারীদিবস উদযাপন শুরু করে এবং ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তখন থেকেই দিনটি উদযাপন হচ্ছে। মোটামুটি এটিই হচ্ছে নারী দিবসের ইতিহাস।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও আন্তর্জাতিক নারী দিবসের একটি থিম রয়েছে। এবারের থিম ‘ডিজিটাল উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি হোক নারী-পুরুষ বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে’। ইংরেজিতে ‘DigitALL: Innovation and technology for gender equality’। এই মুহূর্তে প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে উঠেছে। নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নারীর জন্য সহায়ক সৃজনশীল পরিবেশ এবং প্রযুক্তি উন্নয়নে নারীদের অভিগম্যতাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবছর। সেই সাথে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য ও অসমতা দূর করতে তথ্যপ্রযুক্তির প্রভাবকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য হিসেবে বাংলাদেশে সরকারিভাবে প্রচারিত হচ্ছে “ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন।”
বর্তমানে তথ্য ও প্রযুক্তিতে নানা ধরণের প্রযুক্তি পণ্য ও সাইবার স্পেসে অভাবনীয় পরিবর্তন সাধন হচ্ছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক অগ্রগতি। যার ফলে নারী ও পুরুষ সমানতালে পেশাগত কাজের বাইরেও এসব সাইবার স্পেসে বা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। আর প্রযুক্তির অগ্রগতি ও নানা সুযোগ-সুবিধার কারণে মানুষ এসব ব্যবহার করতে কিছুটা বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু হতাশার কথা হচ্ছে, যে পরিমাণে অগ্রগতি হচ্ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নারীর প্রতি অবমাননাকর ও নারী বিদ্বেষী সোশ্যাল মিডিয়া কন্টেন্ট (লেখা, ছবি, ভিডিও)। যার কারণে কিশোরী ও নারীরা সামাজিকভাবে ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাইবার স্পেসে হেনস্থার শিকার হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এই ধরণের ঘৃণ্য প্রচারণার কারণে অনেক নারী ও কিশোরী বাধ্য হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে।
সাইবার অপরাধ এবং প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহার নিয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজে নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন দেশের সাইবার অপরাধ নিয়ে একটি গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, শতকরা প্রায় ৫২ ভাগ অভিযোগই আসে নারীদের থেকে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী মেয়েরা। শতাংশের হিসাবে যা প্রায় ৭৪ শতাংশ। অভিযোগের একটি বড় অংশের অভিযোগ বাংলাদেশে বহুল জনপ্রিয় ও পরিচিত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক সংক্রান্ত। যার মধ্যে আইডি হ্যাক থেকে শুরু করে সুপার ইম্পোজ ছবি এবং পর্নোগ্রাফির মতো ভয়াবহ অভিযোগও রয়েছে৷
এছাড়াও জাতিসংঘের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের (Cyber violence against women and girls− a worldwide wake up call, a report by UN broadband commission, September, 2015) তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। ৮৬টি দেশের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, মাত্র ২৬ শতাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আর বাকি ঘটনাগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে এবং সে সকল ক্ষেত্রে দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি। জরিপে আরো দেখা গেছে, ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন। এ সময় তাদের হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়ে থাকে। আর প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন নারী এ বয়সসীমার মধ্যে ইন্টারনেটে হয়রানির শিকার হন। তবে অনলাইনে নারীদের হয়রানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে গৃহীত আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নজির খুবই কম।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২৩ উপলক্ষ্যে সরকারিভাবে প্রচারিত এবারের প্রতিপাদ্য হলো-“ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন।” এটিকে স্বার্থক করতে হলে, প্রয়োজন নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা ও যৌন সহিংসতা মোকাবেলায় গণতান্ত্রিক, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সহায়ক সৃজনশীল প্রযুক্তি। সেই সাথে বাংলাদেশের প্রান্তিক ও দুর্গম এলাকার কিশোরী ও নারীদের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে অভিগম্যতা বৃদ্ধি। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত কিশোরী ও নারীদের মধ্যে, যাদের কাছে ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা এখনো পৌঁছেনি, সেখানে ডিজিটাল প্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধাগুলো পৌছে দিতে হবে। এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধিতে প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। উদ্দেশ্যমূলক নারীর প্রতি অবমাননারকর প্রচার-প্রচারণার বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। সেই সাথে এ সংক্রান্ত হয়রানির শিকার হলে অভিযোগ জানানো ও প্রতিকার পাওয়ার প্রক্রিয়াকে সহজ ও কার্যকর করতে হবে। সর্বোপরি ডিজিটাল স্পেসে বিশেষ সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের যৌন হয়রানি ও হুমকি বন্ধে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আরো তৎপর হবে এটাই প্রত্যাশা।
তাছাড়া বর্তমান সরকার ‘‘শেখ হাসিনার বারতা, নারী পুরুষ সমতা” যে স্লোগানটি বহুলভাবে প্রচার করছে, আমিও সেটির প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দেশের পুরো নারী জাতির গর্ব ও অহংকার। নারী পুরুষের সমতার লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই। সর্বোপরি নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, অবিচারের প্রতি প্রতিবাদ এবং শক্ত হাতে প্রতিরোধে সকলের আন্তরিক সহযোগিতা ও প্রতিশ্রুতিশীল পদক্ষেপের বিকল্প নেই। স্বাধীন, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ হোক প্রতিটি নারীর জীবন। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সকল নারীর প্রতি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সকলের সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
লেখক: জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
ডিজিটাল প্রযুক্তির বিশ্ব হোক নারীর সহায়ক ও ক্ষমতায়নের হাতিয়ার মত-দ্বিমত সুমিত বণিক